কাঁদে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া, নিজ অঙ্গ আছাড়িয়া
লোটায়ে লোটায়ে ভূমিতলে।
ওহে নাথ কি করিলে, পাথারে ভাসায়ে গেলে
একা মুই এ ভুবনমণ্ডলে।
আজও যেন সেই কান্নায় নবদ্বীপের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে জানতে চাইছে, গৌরহরি তুমি কোথায়? মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বিবাহের মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে যখন তাঁর স্বামী সমাজ সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসের পথে যাত্রা করে তখন সেই কিশোরী, যুবতীর দশা কি যে হতে পারে তা বোধ করি আমাদের পাঠকদের অজানা নয়। আজ থেকে পাঁচশত বছরের অধিক পূর্বে সেই সমাজ ব্যবস্থা আর বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এক নয়। আমাদের দর্শন, ভাব বা বিজ্ঞান বা চিন্তা যাই বলুন না কেন সবকিছু সময় আর স্থানের নিরিখে আপেক্ষিকভাবে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তাই সনাতন হিন্দু ধর্মের ভাবধারা বর্তমান প্রজন্ম কেমনভাবে গ্রহণ করবেন তা অতীতের সাথে না মেলানোই শ্রেয়। আজকের দিনে তো অনেকেই অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ধর্মের নামে কুৎসা রটিয়ে নিজের ধর্মের কাছে নিজেই বিধর্মী হয়ে ওঠেন শুধুমাত্র আধুনিক তকমা পাবার নেশায়। আজকের নারী যখন নিজের অধিকার বুঝে নিতে স্বামী বা তাঁর সংসারকে ছুঁড়ে ফেলতে পারেন, সেই সময় বিষ্ণুপ্রিয়া রাজপরিবার থেকে এসে একের পর এক ত্যাগ আর উদারতা দেখিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের তথা বিশ্বের নারীজাতির মধ্যে ত্যাগের মূর্ত দেবী। তাঁর স্বামীর গৃহত্যাগের সংবাদে আছাড় খেয়ে পড়ে কাঁদছেন এবং বড় আক্ষেপ করে বলছেন, যে ওহে নাথ এ কেমন ধারার কাজ তোমার? এই বিশ্বভুবনে তুমি আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলে? পতিব্রতা বিষ্ণুপ্রিয়ার বয়স এত কম ছিল যে পুনরায় বিবাহ করে সোনার সংসার সাজিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তা করলেন না তিনি, কারণ তাঁর সংসার যে বিশ্বভুবন জুড়ে। তিনি কি করে একটা চার দেওয়ালের মাঝে সংসারে আবদ্ধ রাখেন নিজেকে।
সাধক বা মহাপুরুষের জীবন ও কর্মে নারীশক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য। জননীর শিক্ষাদীক্ষা মানবের চরিত্র নির্মাণ করেন তাই তিনি দীক্ষাগুরু। নারীর এক হৃদয়ে কত রস যেমন একই অঙ্গে কত রূপ। তাঁর প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ, অভিমান, সহানুভূতি ইত্যাদি সাধকজীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। মাসীপিসির পরিণত দরদ, ভগিনীর উচ্ছল প্রীতি, প্রতিবেশিনীর হাস্যকৌতুক এত রস শুধু নারীহৃদয় থেকে উৎসারিত হয় বিচিত্রধারায়। সেই রসে পুষ্ট হয়ে বালক যখন যৌবনলাভ করে জীবনে আসে জায়া। জননীর স্নেহে কিংবা জায়ার প্রেমে কিবা বুদ্ধ কিবা চৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণ সবাই অভিষিক্ত। আবার গৌতমবুদ্ধ গোপাকে ত্যাগ করে বুদ্ধত্ব লাভ করতে গেলেন, শ্রীচৈতন্য বিষ্ণুপ্রিয়াকে ছেড়ে প্রেমধর্ম প্রচার করতে বেরোলেন আর শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাকে জগন্মাতারূপে পূজা করে বারংবার বললেন কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করো। মহাপ্রভুর জীবনে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়া নন, আরও অনেক নারীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন শচীমাতা, যোগমায়া, সীতাঠাকুরানী, মালিনী, মাধবী আর প্রথম স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া। তিনপ্রকার নারী তথা জননী, জায়া ও অনুরাগিণীর প্রভাব ছাড়াও যথা বারমুখী, শ্রীমতী, লক্ষহীরা, সত্যবাঈ, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ চৈতন্য সান্নিধ্যে এসে জীবনের মূল স্রোত পেয়েছিল। কিন্তু সবার থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছেন দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনেক বড় বড় লেখক বহু গ্রন্থ রচনা করে বাংলার বৈষ্ণব ঘরানা সমৃদ্ধ করলেও বিষ্ণুপ্রিয়া চিরকাল কেমন যেন থেকে গেছেন উপেক্ষিতা হয়ে। কিন্তু সারা বিশ্বের ইতিহাসে যতজন মহীয়সী নারী ছিলেন, তাঁদের থেকে কোন অংশে আমাদের গৌরপ্রিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া পিছিয়ে ছিলেন না। শাক্ত আর বৈষ্ণব বা শক্তি আর ভক্তির লড়াইয়ে প্রেমের প্রতিষ্ঠা দিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবদানের পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়ার অবদান ভোলার নয়। প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যের প্রেমধর্মে বিপ্লবের জোয়ার এসেছিল দেবী বিষ্ণুপ্রিয়ার ত্যাগ আর নিষ্ঠার কারণে। আমরা দেখেছি, যারা বিশ্ব সংসারের কাজে আসেন, যার দর্শন সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে জগতজীবকে উদ্ধার করে তমসা থেকে নিয়ে আসেন আলোকের জগতে, তাঁরা সাধারণত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না। আবার যদিও বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁরা নিঃসন্তান থাকেন। কারণ সংসারের মায়াজালে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে এই ভুবনে তিনি যেন সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে আটকে না পড়েন। তাঁর বৃহত্তর কর্মকাণ্ড যেন এক ছোট্ট পরিসরে আটকে না যায়। তাই তো তাঁরা সংসার বিমুখ হয়ে যান। ত্যাগের পর ত্যাগ করতে করতে হয়ে ওঠেন মহান। আর আজকের আলোচনার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল ভারতীয় নারীর কাছে এক উজ্জ্বল মার্গ প্রদর্শন।
সব থেকেও যিনি সমাজ ও সংসারের জন্য ভিখারির ন্যায় জীবন কাটালেন তিনিই তো পূজ্য। প্রখ্যাত গীতিকার হীরেন বসুর গানে আমরা দেখেছি বিষ্ণুপ্রিয়া চিরবিরহী ভগবান ঘরণী। যুগে যুগে বিভিন্ন রূপে তাঁরই লীলা হয় প্রকাশিত। তিনি লক্ষ্মীর অংশ, রাধাভাবদ্যুতি সম্বলিত ও জনমদুঃখী সীতার উত্তরসুরী বিষ্ণুপ্রিয়া। কলিযুগে অবতার প্রেমের ঠাকুর পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক সময়ে নবদ্বীপের রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের নয়নের মণি কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া। যার মাতার নাম যোগমায়া দেবী। দ্বাপরযুগে সনাতন মিশ্র রাজা সত্রাজিৎ ও তাঁর কন্যা কৃষ্ণপ্রেয়সী সত্যভামা এযুগের বিষ্ণুপ্রিয়া। এই বিষ্ণুপ্রিয়া কেবল নারী নন, তিনি ভারতবর্ষের বহু সুশীলা আদর্শ নারীর প্রতীক যার রূপের ছ’টায় নবদ্বীপকে করেছে আলোকমণ্ডিত। তিনি সুশ্রী, নম্র ও ভক্তিমতী, থির বিজুরী গৌরবরনী। তাঁকে বিশেষিত করতে পদকর্তা বলেন চাঁদবদনী ধ্বনী, প্রিয়া, মৃগনয়নী, গৌরপ্রেমে গরবিনী, গৌরবক্ষবিলাসিনী। যার দেহে নবীন যৌবন, গলিত কাঞ্চন, মধুভাষিণী, শাস্ত্রজ্ঞের কন্যাহেতু প্রখর শাস্ত্রজ্ঞান। তিনি নবদ্বীপচন্দ্র গৌরহরির প্রেমপ্রদায়িনী, সাধারণী, সমঞ্জসা, সমর্থা, সরোবরের রাজহংসিনী, যিনি মরালিনী, রমণী রতনমণি, গৌরপ্রেমে পাগলিনী, কুলবধূ যোগিনী, বৈষ্ণবকুল শিরোমণি যিনি ভগবৎপ্রেমে ঐশ্বর্যত্যাগী, লাস্যময়ী, সদাহাস্যময়ী, লাজবতী বিষ্ণুর প্রিয়াই তো অভাগিনী, চিরদুঃখিনী বিষ্ণুপ্রিয়া।
ভারতই জ্ঞানবিজ্ঞানের আদি জননী ত্যাগ ও সাধনার পীঠভূমি। ভারতের বিদ্যা, ভারতের সাধনা, ভারতের ধর্ম, ভারতের শিক্ষা-দীক্ষা, ভারতের সতীধর্মের কীর্তিসক্তি সর্বত্র বিঘোষিত জয়শ্রীমণ্ডিত। ভারতের রমণী “অজ্ঞানতমঃ খণ্ডনী সুক্ত জননী, ব্রহ্মবাদিনী, ঋঙ্মণ্ডল মণ্ডনী”। রাজ্যশাসন, প্রজাপালন, ধর্মরক্ষা প্রভৃতি কর্তব্য সাধনের কাহিনী জগতের ইতিহাসে দ্বিতীয় নেই। সীতা, বেহুলা বা সাবিত্রীর ন্যায় বিষ্ণুপ্রিয়ার ত্যাগ ইতিহাসে জায়গা তেমনভাবে পেল কই। চৈতন্য সাহিত্য চর্চায় বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্র বা তাঁর অবদান নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে। তাঁর ত্যাগ, সংযম, প্রেম, নিষ্ঠা ও ভক্তিকে পাথেয় করে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বিশ্বের প্রেমধর্ম প্রচারে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বালিকাবধু বিষ্ণুপ্রিয়া যখন নারীজীবনের পুতুল খেলার বয়স, তখন তাঁর কাঁধে গুরুভার হয়ে চাপে শচীমাতার সংসার। রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের কন্যা রাজবৈভবে যখন ভাসার কথা, ঠিক তখন তাঁর বিবাহ হয় পাণ্ডিত্যসর্বস্ব শচীতনয় গৌরহরির সাথে, যার ঘরে কোন বিত্তবৈভবের লেশমাত্র নেই। কিন্তু তাঁর পতিনিষ্ঠা তাঁকে সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল।
একজন নারী সাবালিকা হবার পূর্বে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল একজন বিপত্নীক মানুষের সাথে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর গৃহত্যাগ। সন্ন্যাসগ্রহণের পর স্ত্রীর মুখদর্শন নিষেধ। সকল রাজসুখ ত্যাগ করে যার কাছে এসেছিলেন তিনি সকল মোহ ত্যাগ করে কৃষ্ণপ্রেমে বেড়িয়ে পড়লেন। মহাপ্রভুর ভগবান সত্ত্বা বাদ দিলে এই কীর্তি মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকা শুধু তাঁর স্বামীর মঙ্গল কামনায় সে তো বিষ্ণুপ্রিয়া করে দেখিয়েছেন। সন্ন্যাসের পর তিনি যখন এসেছিলেন, নদীয়ার সবাই দল বেঁধে তাঁকে দেখতে গেছিলেন, শুধু তিনি ছাড়া। অনেকেই রসিকতা করে বলেছিলেন যে বিষ্ণুপ্রিয়া আমাদের সবাইকে যেতে বলেছেন, কিন্তু তোকে না। সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমরা যে মানুষের উদ্দেশ্যে দৌড়ে চলেছ, সেই মানুষটা যে আমার নিজের। এ কি কম গৌরবের গো!” এখানেই বিষ্ণুপ্রিয়া নামের সার্থকতা। আজকালকার দিনে কোন ছেলে বা মেয়ে তাঁর প্রেমিকের কোন পোষ্ট বা কথায় যদি কেউ প্রীতিজনক প্রতিক্রিয়া জানায় সেখানেই বিচ্ছেদের পেরেক প্রথিত হয়ে যায়, সেখানে এতবড় আত্মত্যাগ না হলে নদীয়ার নিমাই কি আর ভগবান হতে পারতেন? যার এত রূপ, এত গুণ, এত ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও মানুষের সেবায় ভিখিরিনী হয়ে জীবন কাটালেন। ২৪ বছর বয়সে স্বামী চলে গেলেন, মহাপ্রভু আরও ২৪ বছর পরে অন্তর্ধান হয়েছিলেন। সেই সময়কার কথা জানলে আমাদের দেহে মনে শিহরণ জাগবে।
সন্ন্যাসের আগে বিষ্ণুপ্রিয়া তাঁর প্রাণবল্লভের চরণ দুখানি ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘প্রাণেশ্বর হৃদয়বল্লভ, আমাকে লয়ে তোমার সংসার, এই হতভাগিনীই তোমার জঞ্জাল, আমার জন্য তুমি সংসার ত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছ, আমার জন্য তুমি বৃদ্ধা জননীকে ছেড়ে গৃহত্যাগী হচ্ছো, আমিই তোমার ধর্মজীবনের পরমশত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছি, আমার জন্য তুমি নিশ্চিন্তে প্রেমধর্ম প্রচার করতে পারছ না, তাই আমি আত্মত্যাগ করব। তবু তোমার কোন কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াব না। নিমাই সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেলেও আর দেখা করেন নি বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে। বাকি জীবন খুব দুর্বিষহ অবস্থায় কাটে। ইচ্ছে করেই আর পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন নি জগত কে শিক্ষা দেবার জন্য। পরে তাঁর কথা ভেবে মহাপ্রভু খুব দুঃখ পেয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। স্বামী চলে যাবার কয়েকবছরের মধ্যেই শচীমাতা দেহত্যাগ করেন। তিনি সংসারে থেকেও যোগিনীর মত জীবনযাপন করতে থাকেন। প্রতিদিন ভোরবেলা ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে গঙ্গায় স্নান করে কৃষ্ণনাম জপ করেন। একবার জপ সমাপনান্তে, একটা করে আতপচাল গণনার সুবিধার্থে সরিয়ে রাখতেন। এইভাবে সারাদিন জপের শেষে যেকটা দানা জমা হত, সেই পরিমাণ শস্য ফুটিয়ে নিয়ে শাশুড়িকে নিয়ে ভাগ করে খেতেন। শাশুড়ি চলে যাবার পর তিনি একাই জীবন নির্বাহ করতেন সাত্ত্বিকভাবে কৃষ্ণপ্রেমে। এই জীবন দর্শন আজকের জগতজীবকে ত্যাগের শিক্ষা প্রদান করে প্রেম কে করে প্রতিষ্ঠা। সেখানেই এই জীবনের সার্থকতা। মহাপ্রভু আজ প্রেমের বাণী নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে জগতের মাঝে এক ধারা তৈরি করে মহাপুরুষ হয়ে আজও পূজিত হলেও আড়ালে থেকে গেলেন তাঁর অন্যতম শক্তি দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া। তাঁকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
রচনাকাল : ২০/৬/২০২১
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।