শুভ জামাইষষ্ঠী (প্রথম পর্ব)
তথ্য সংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
বাঙালী হিন্দুর ঘরে বারো মাসে তেরো পার্বণ। নিত্য পূজো, ব্রত পূজো, মাসিক পূজো এবং বছরের পূজো। পূজো, ব্রতকথা নিয়েই ব্যস্ত সময় কেটে যায় হিন্দু নারীদের। প্রতিমাসেই লেগে আছে এই ব্রত, সেই ব্রত। কিছু কিছু ব্রতপূজোর আবার শ্রেণীভেদ আছে। উপাসনাও বয়সভেদে নির্ণিত হয়ে থাকে। যেমন একটি মেয়ের বিয়ের আগে আরাধ্য দেবতা থাকেন শিবঠাকুর, বিয়ের পর বাকী জীবন আরাধ্যদেবতার আসনে থাকেন লক্ষ্মীদেবী। একজন মা সন্তান কামনার জন্য ষষ্ঠী ঠাইরেণের কৃপা কামনা করেন এবং যুবক পুত্রের আয়- উন্নতির জন্য ‘গনেশ ঠাকুরের’ কৃপা কামনা করেন। প্রতিটি নারী সংসারের মঙ্গলের জন্য বিপদতারিণী দেবীর পূজা করেন। নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে একটি করে ব্রতপূজা নির্ধারিত আছে।
জামাই ষষ্ঠী কী এবং কেন পালন করা হয়
জামাইবাবাজীকে খুশি রাখতে কত রকমের উপায় খুঁজেন বাঙালি মায়েরা। খুঁজে খুঁজে পেয়ে যান ‘জামাইষষ্ঠী’ ব্রতপূজা্র বিধান। বছরের একটি দিন, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি, যখন আম- কাঁঠালের পাকা গন্ধে চারদিক সুবাসিত, তখনই এই ব্রতটি উদযাপণ করতে হয়। শ্বশুরবাড়ীতে ‘জামাই আদরের’ ঘটা পড়ে যায়। ‘জামাইষষ্ঠী’ ব্রতপূজার যা কিছু, সবই কন্যার শিবঠাকুর স্বামীটিকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে থাকে। জামাই ষষ্ঠী এমনই এক ব্রত, যেখানে শাশুড়ীমাতা কন্যা-জামাতার দীর্ঘায়ু কামনা করেন, জামাতার যশ কামনা করেন, জামাতার জন্য অর্থ-বিত্ত কামনা করেন, কন্যা- জামাতার কোল ভরে সুস্থ সন্তান কামনা করেন, এমনই আরও কত ধরণের মঙ্গলাকাংক্ষা করে থাকেন! তবে শুকনো কথায় ‘মংগলাকাংক্ষা’ করলে কী জামাই বাবাজীর পেট ভরবে? মায়েরা অমন অবুঝও নন, উনারা জামাইবাবাজীকে যথাযথ সম্মান সহকারে, উপঢৌকন পাঠিয়ে শ্বশুরবাড়ী আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেন।
শাশুড়ীমায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে জামাই বাবাজী শ্বশুড়বাড়ীতে পা দেয়ার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় জামাই অভ্যর্থণার সকল আচার-অনুষ্ঠান। পথশ্রান্ত জামাতাকে বসবার জন্য নানা রঙ-বেরঙের নক্সাখচিত সবচেয়ে সুন্দর আসনখানি মাটিতে বিছিয়ে দেন, হাতপাখা্র শীতল বাতাসে বাবাজীর ঘামে ভেজা শরীরটিকে ঠান্ডা করেন, যত্নে তুলে রাখা শ্বেত পাথরের গেলাস ভরে ডাবের ঠান্ডা জল পান করতে দেন। এরপর ষষ্ঠীদেবীর আশীর্বাদপূর্ণ দূর্বা-বাঁশের কড়ুল, ধান, ফুল, করমচা দিয়ে বাঁধা ‘মুঠা’ জামাইবাবাজীর মাথায় ছুঁইয়ে ‘ষাট ষাট, বালাই ষাট’ করে স্নেহাশীর্বাদ করেন।
আশীর্বাদ শেষে বিশাল বড় কাঁসার রেকাবী নাড়ু, মোয়া, পিঠে, সন্দেশ, মিষ্টি, ফল-মূলে সাজিয়ে খেতে দেন। জামাইভোজের জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। পুকুরে জাল ফেলে সবচেয়ে বড় কাতলা মাছ তোলান, মাছের আস্ত মুড়ো জামাই বাবাজীর পাতে তুলে দেন। ষোড়শ ব্যাঞ্জনে জামাইথালা সাজান, বড় জামবাটিতে কালো গাইয়ের ঘন ক্ষীরদুধ, গাছপাকা আম, কাঁঠাল, কলা তো থাকেই। ভোজনশেষে পান-সুপুরীর বাটা, শান্তিপুরী ধুতি, ফিনফিনে পাতলা আদ্দির কাপড়ে তৈরী পাঞ্জাবী, সাথে মানানসই চিকন সূতোয় বোনা দামী উত্তরীয়, কোলাপুরী চপ্পল দিয়ে ডালি সাজিয়ে শাশুড়ীমাতা জামাইবাবাজীকে আশীর্বাদ করেন, নিজ কন্যাটিকে সুখে রেখেছেন বলে ‘শিবঠাকুর’ বাবাজীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং কন্যা-জামাতার ভবিষ্যত জীবন আরও সুখের, আরও শান্তির, আরও সমৃদ্ধির হোক, সেই কামনা করেন।
এটা একটা সামাজিক প্রথা মাত্র। জামাই-এর সাথে আপ্যায়ন করতে হবে মেয়েকেও। তা না হলে সমাজজীবন ও পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে না। আসতে পারে না। আজকের জামাইষষ্ঠীর পূণ্য শুভক্ষণে সব জামাইবাবুদের জানাই
আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
জয়গুরু!
রচনাকাল : ১৬/৬/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।