গল্প: আঁধার পেরিয়ে
"হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার মামনি! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!।আজ "স্বপ্ননীড়-"এ আলো ঝলমলে স্বর্নালী সন্ধ্যা।হাসি, খুশীর ফোয়ারায় উৎসবের আমেজ। অতিথি, অভ্যাগতদের ভিড়ে"স্বপ্ননীড়" আজ মুখরিত। তিন কন্যের মায়ের আজ শুভ জন্মদিন।তিন কন্যে অর্থাৎ, ঝুমকো টিকলি আর নোলক।বিশাল বড় কেকের চারদিকে পঞ্চাশটা মোমবাতি জাজ্বল্যমান।সুলতার পঞ্চাশতম জন্মদিনটা খুব ধুমধামের সাথে তার মেয়েরা পালন করছে।"স্বপ্ন নীড়"-এর বিরাট হলঘরে রং-বেরঙের বেলুনের ভিতর যেন তিন মেয়ের মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা,ভালবাসায় পরিপূর্ণ। আলোকময় বাড়ীর মাঝে প্রধান আকর্ষন সুলতা আজ সেজেছে অন্যান্য বারের তুলনায় একটু বেশিই। এবার জন্মদিনের সুবর্ন জয়ন্তী বর্ষ উদযাপনে দামী শাড়ি ও স্বর্নালংকারে সুলতা বিভূষিতা। তার মুখের হাসিতে সমস্ত সুখ শান্তি যেন উপচে পড়ছে।আজ তার বারে বারে মনে হচ্ছে সে রত্নগর্ভা। তার স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তার তিন কৃতি সন্তান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।আবেগে তার চোখে আনন্দাশ্রু টলমল করে ওঠে। উৎসবের শেষে যখন সমস্ত কোলাহল থামে, অধিক রাতে যখন সমস্ত আলো নিভে যায় তখন সুখ শয্যায় শুয়েও তার মনের কোনে অতীত স্মৃতিগুলো যেন উঁকি মারতে থাকে।সে স্মৃতি যে বড়ই বেদনা-বিধুর।তাই সে অনেক চেষ্টা করেও যেন ভুলতে পারে না। আজকের দিনের সাথে অতীতের দিনগুলোর ফারাকটা তার আবেগ, অনুভূতিগুলোকে যেন উসকে দেয়।
নিস্তব্ধ রাতে মেয়েরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে,সব আলো নিভে যায়, সুলতার মন ফিরে যায় ফেলে আসা সেই দিনগুলোতে যখন সে অনেকটাই ছোট। স্কুল জীবনের প্রায় শেষের দিকে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল জ্যেষ্ঠা। বাবা একটা কারখানায় সামান্য চাকরি করতেন।মা ছিলেন গৃহবধূ। বাবার স্বল্প বেতনে তাদের সংসারটা কোনোরকমে চলত। বিলাসিতা না দেখলেও খাওয়া -পরার অভাব ছিল না। সময়ের ছন্দে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ তাদের জীবনে ছন্দপতন ঘটলো। বাবার কারখানায় লকআউট হয়ে গেল।পুরো সংসারটা যেন পড়লো অথৈ সাগরে। সুলতা তখন সবে মাধ্যমিক পাশ করেছে। পড়াশোনায় সে বরাবরই ভাল ছিল।কুল-কিনারা না পেয়ে সংসারটা বাঁচানোর তাগিদে সুলতা নিজের পড়ার ইতি টেনে প্রাইভেট টিউশনি শুরু করলো।বাবাও স্বল্প পুঁজিতে সবজির দোকান শুরু করে। তাদের দুজনের মিলিত আয়ে দুবেলা ঠিকমত আহারও জুটত না। সংসারে শুরু হয় নিত্য অশান্তি। এই ভাবে দুখের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে তাদের আরও দুবছর কেটে যায়। অভাবে জর্জরিত অবস্থায় তার বাবা একদিন মনস্থির করেন সুলতাকে পাত্রস্থ করবেন।এত বড় সংসারের ঘানি তিনি কিছুতেই আর টানতে পারছিলেন না। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ হলো। লোকের কাছে সাহায্য চেয়ে পেশায় অটোচালক এক পাত্রের সাথে সুলতার অমতেই বাবা জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দেন।
নতুন জীবনে পদার্পণ করে সুলতার নতুন করে দারিদ্র্যের সঙ্গে আবার শুরু হয় লড়াই। প্রথম রাতেই তার স্বামী ঘরে ঢোকে মদ্যপ অবস্থায়।সুলতার চোখে সমস্ত পৃথিবীটাই আঁধারে পরিনত হয়। তার স্বামী অটো চালিয়ে যা রোজগার করত তার অর্ধেকটাই চলে যেত মদের নেশায়। তার স্বামী ছিল বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান।সুলতার বাবা ভেবেছিলেন খেয়ে, পরে দিন ভালভাবে চলে যাবে মেয়ের, কিন্তু সেই আশার মুখে ছাই পড়লো। সুলতা তার ভালো শাশুড়ি মায়ের মুখ চেয়ে সব সহ্য করে নিল। এছাড়া সে ভাবলো সে একজন যুবতী, তার পক্ষে একাকী কোথাও জীবন নির্বাহ করা সম্ভব নয়। তার উপর আছে সমাজে নর পিশাচের উপদ্রব, অপরদিকে ভরসা-সম্বলহীন বাপের বাড়ি।তাই অনুপায় হয়েই তার স্বামীকে ভালোবাসা দিয়ে পথে আনার চেষ্টা করে।এক বছরের মাথায় তার কোল আলো করে এক ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হয়। সুলতা খুব খুশি হলেও তার স্বামীর মুখটা ভার হয়ে যায়,কারণ তার স্বামী পুত্রসন্তান কামনা করেছিল।বিষাদ, দুঃখ, অভাবের সংসারে পুত্রসন্তানের আশায় পর পর আরো দুই মেয়ের জন্ম হয়। বেড়ে যায় সুলতার উপর তার স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা। মদের নেশা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অভাব, অশান্তি সংসারটাকে যেন গ্ৰাস করতে থাকে। মেয়েদের মুখের দিকে চেয়েও দেখেনা তার স্বামী।এত প্রতিকূলতার কাছেও সুলতার মাতৃত্ব হার মানেনি। তিন মেয়েকে বুকে আঁকড়ে সে বাঁচানোর চেষ্টা করে।বাড়ী বাড়ী পরিচারিকার কাজ করে মেয়েদের মুখে একটু অন্ন তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে।এত দুখের মাঝেও সুলতা তার মেয়েদের আদর করে ,সাধ করে অলংকারের নামে নাম রাখে---ঝুমকো, টিকলি ও নোলক।
দিন কেটে যায়। তার ক্ষতময় জীবনে তিন মেয়ের মুখের হাসি,সারল্য তার বুকের ক্ষতে যেন মলমের প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। অসহায়, নিষ্পাপ শিশুদের মুখের দিকে চেয়ে সুলতা আত্মহননের পথের দিকে এগিয়েও ফিরে আসে।সে তার জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়।
এভাবে চলতে চলতে একদিন ঘটে গেল জীবনের চরম প্রতিঘাত। সেদিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। ঘরে ঘরে লক্ষীদেবীর আরাধনা হচ্ছে। শঙ্খধ্বনি,উলুধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। পূর্ণচন্দ্র যেন তার জ্যোৎস্না উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। ঠিক সেই সময় আর এক গৃহলক্ষী সংসার হতে বিতাড়িত হলো তিন শিশু কন্যা সহ। সেই পূর্ণিমা- রাতে সুলতার স্বামী মদোন্মত্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকে সুলতাকে মারধোর করে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।তিন শিশু কন্যাকে বুকে আঁকড়ে সুলতা রাস্তায় বসে
কাঁদতে থাকে। তার স্বামী দরজায় তালা দিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।
কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি সুলতার করুন কাহিনী শুনে তারা স্থানীয় পৌরপিতাকে সংবাদটা জানান।পৌরপিতা সৌমেন বাবু ছিলেন খুব সহমর্মী ব্যক্তি ও পরোপকারী। শুধু গরীব মানুষই নন , সমস্ত রকম মানুষের বিভিন্ন কাজে তিনি এগিয়ে আসতেন ও পাশে দাঁড়াতেন। তিনি এই দুঃসংবাদটা শুনে তড়িঘড়ি এসে সুলতাকে তার তিন সন্তান সহ নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁর বিশাল বাড়ীর এক কোনায় একটি ঘরে সুলতার থাকার ব্যবস্থা করে দেন ও আহারের ব্যবস্থা করেন।
তাঁর এই উদারতায় সুলতা শরীর ও মনে বল পায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি পায়।সুলতাও কৃতজ্ঞতার খাতিরে সৌমেন বাবুর সংসারে টুকিটাকি কাজ করে দিয়ে কিছুটা তৃপ্তি পেত। সৌমেন বাবুর মা বয়সজনিত কারণে ছিলেন অসুস্থ, ঠিকমত চলাফেরা করতে পারতেন না। সুলতা বৃদ্ধার সমস্ত দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়। সৌমেন বাবুর মাও তার নিষ্ঠা ও আন্তরিক সেবাযত্ন পেয়ে খুব মুগ্ধ হন এবং সুলতাকে তাঁর নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন।
এই ভাবে মাসখানেক কেটে যাওয়ার পর সুলতা একদিন সৌমেন বাবুকে বলে তার রোজগারের একটা ব্যবস্থা করে দিতে যাতে সে তার তিন মেয়েকে ভালভাবে মানুষ করতে পারে। তিন মেয়েকে নিয়ে সে যে অনেক স্বপ্ন দেখে। দারিদ্রতার মধ্যেও সে বুকে আশা সঞ্চয় করে। জীবনে এত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও তার মনোবল ছিল অদম্য।
সুলতার এই কাতর অনুরোধ শুনে সৌমেন বাবু তাঁর নিজস্ব অর্থব্যয়ে রাস্তার মোড়ে সুলতাকে একটা চায়ের দোকান করে দিলেন। সেখানে বিস্কুট,কেক, ডিম সিদ্ধ থেকে শুরু করে হরেক রকম খাবার রাখা হতো।সুলতার হাতের সেই সুস্বাদু চা খেয়ে আস্তে আস্তে খরিদ্দার বাড়তে লাগলো। বেশ কয়েকজন নিত্য খরিদ্দার ছিল যারা সুলতার করুন কাহিনী শুনে তাদের পরিচিত লোকদের তার দোকানে পাঠাতো।এই ভাবে দিনরাত পরিশ্রম করে দোকানটাকে সে দাঁড় করায়। ততদিনে দুই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন সৌমেন বাবু। ছোট মেয়েকে সাথে নিয়েই সুলতা দোকান চালাত। একটাই লক্ষ্য ছিলো তার জীবনে-মেয়েরা যেন সুশিক্ষিত হয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, স্বাবলম্বি হতে পারে। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে অনেক দৃঢ়, সাহসী ও সহনশীলা করে তুলেছিলো।মা দূর্গার মত দশ হাতে আগলে মেয়েদের মানুষ করতে লাগলো। সৌমেন বাবুর তত্ত্বাবধানে তাঁর বাড়িতে সুলতা থাকতে লাগলো।।
দিন,মাস, বছর কেটে যায়।একটু একটু করে সুখের আঁচ পেয়ে সুলতার জীবন চলতে থাকে। তার স্বামী ঐ ঘটনার পরে তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেনি আর সুলতাও করেনি। মাঝে একদিন দোকানের এক খরিদ্দার এসে তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ দেয়।মত্ত অবস্থায় রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ীর চাপায় তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহের কোনো দাবীদার না থাকায়, বেওয়ারিশ লাশ পুলিশ নিয়ে চলে যায়। দুঃখ, যন্ত্রনার অনলে পুড়ে পুড়ে সুলতার হৃদয় তখন পাথরসম, চোখের জলও তত দিনে যেন শুকিয়ে গেছে।বেদনার স্মৃতি জমে জমে তার মন ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত।তাই এই দুঃসংবাদ তার পাথর জমা হৃদয়কে ভেদ করতে পারেনি। শুধু কয়েক মূহুর্ত উদাস চোখে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের কাজে মন দেয়।
জীবন চক্র ঘুরতে ঘুরতে তার বড় মেয়ে মাধ্যমিকে কয়েকটি লেটার সহ উত্তীর্ণ হয়। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তার মেধা, অধ্যাবসায় ও পারিবারিক অবস্থা দেখে বিনা পারিশ্রমিকে তাকে পড়ান ও বিভিন্ন ভাবে তাকে সাহায্য করেন।তিন মেয়েই খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। সেই সময় সুলতাও তার অপূর্ণ আশা পূরণ করতে বড় মেয়ের সাথে পড়াশোনা করতে থাকে এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফল করে।বড় মেয়ে জেলায় প্রথম স্থানাধিকারী হয়। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য সুলতার খরচ বিশেষ করতে হতো না, কারণ তাদের মেধা, অধ্যাবসায়, একনিষ্ঠতা, চেষ্টা ,শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য, তদুপরি প্রতি বছর পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য প্রাপ্ত জলপানির অর্থ তাদের অগ্ৰগতির পথ মসৃণ করে দিয়েছে।সুলতাও মেয়েদের দেখে নিজের পড়াশোনার প্রতি আগ্ৰহ ও উৎসাহ জাগিয়ে রাখে। সারাদিনের কাজের ফাঁকে অনেক কষ্ট করে সময় বের করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ হয়। ততদিনে দোকানে আয়, উন্নতি বেড়েছে।বড় ও মেজো মেয়ে অর্থাৎ ঝুমকো ও টিকলি তখন ডাক্তারি পড়ছে সরকারি মেডিকেল কলেজে। ঠিক সেই সময় সৌমেন বাবুর মা অনিলা দেবীর মৃত্যু হয়। তিনি বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। সুলতা তার সকল কাজের ফাঁকে অনিলা দেবীর সেবা শুশ্রূষা করত।অনিলা দেবীকে সুলতা মা বলেই ডাকতো।অনিলা দেবীও বহুবছর ধরে সুলতার সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি তার কোমল হৃদয় অনুভব করেন এবং তার ব্যবহার, ঐকান্তিক সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে মৃত্যুর আগে পাঁচ কাঠা জমি সুলতার নামে লিখে দেন।অনিলা দেবীর একটিই মাত্র সন্তান, সৌমেন বাবু। তিনি ছিলেন অকৃতদার।সূলতা এবং তার মেয়েদের অভিভাবক হয়েই তিনি জীবনটা কাটান,ঢাল হয়ে তিনি তাদেরকে রক্ষা করেন।সুলতার দোকান ঘরটা তিনি পাকা করে তৈরি করে দেন এবং দোকানের পসার বাড়ানোর জন্য আরও বেশি মালপত্র কিনতে কিছু সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন। দোকানের সামনে সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা,"সুলতা টি হাউস"। দোকানে খদ্দের আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে। কয়েকজন কর্মচারীও নিয়োগ হয়েছে।সব কিছু মিলিয়ে দোকান তখন রমরমা, তাদের দারিদ্র অনেকটাই তখন দূরীভূত।
কয়েক বছর পর ঝুমকো ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করে নিজের চেম্বার খোলে। বছর দুয়েক পরে টিকলি ও ডাক্তারি পাশ করে দিদির চেম্বারে প্র্যাকটিস শুরু করে।আয়, উন্নতি বাড়তে থাকে। ততদিনে কনিষ্ঠা মেয়ে নোলক একটা স্কুলের শিক্ষিকা। সৌমেন বাবু সেই সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বিছানায়। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতে প্রায় পঙ্গু।সুলতা এই দেবতার মত মানুষটির শেষ জীবনে অনেক সেবা করে। নাড়ীর বন্ধন না থাকলেও বহু বছর সৌমেন বাবু ও তাঁর মা ও সুলতার পরিবার একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। মায়ার বন্ধনে এতটাই উভয়ে জড়িয়ে পড়েছিল যে একে অপরকে কোনোদিন ছেড়ে যায়নি।সুলতার মেয়েদের মামা ডাকটা সৌমেন বাবুর হৃদয় স্পর্শ করে যায়।সুখে,দুঃখে, আনন্দে সবসময়ই একে অপরের পাশে থাকতো।
সুলতার তিন মেয়েই সৌমেন বাবুর চোখের মনি।
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সৌমেন বাবু তাঁর পারিবারিক উকিলবাবুকে ডেকে বাড়ীটা ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘকে দান করে দেন এবং ব্যাঙ্কের সমস্ত সঞ্চিত টাকা সুলতা ও তার মেয়েদের নামে নমিনি করে দেন। কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। সুলতা সেই টাকা এবং মেয়েদের রোজগারের জমানো টাকায় সৌমেন বাবুর মায়ের দান করা পাঁচ কাঠা জমির উপরে একটি বড় বাড়ি তৈরি করে সেখানে চলে আসে। বাড়ীর নাম রাখে "স্বপ্ননীড়"। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সুলতা বর্তমানে ফিরে আসে।বড় মেয়ে ঝুমকো শল্য চিকিৎসক। তার হাতের জাদুতে বহু কঠিন রোগ থেকে মানুষ মুক্ত হয়। মেজো মেয়ে টিকলি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ।অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই দুই মেয়ের পসার দ্রুত গতিতে বেড়ে যায়। নোলক ও শিক্ষকতায় খুব সুনাম অর্জন করে।
সুলতার জীবনে ঘন তমসাবৃত রাত কেটে গিয়ে নতুন প্রভাতের সূচনা হয়েছে,যে প্রভাতে আছে শুধুই নব রবির স্নিগ্ধ কিরণচ্ছটা আর প্রভাতী পাখিদের কলতান আর নির্মল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার রসদ। চারিদিকে সূর্যের ঝলমলে কিরণে তাদের জীবনও এখন আলোকিত, অস্তমিত সূর্য দিয়ে যায় চাঁদের জোছনা ও লক্ষ তারার হাসি আর পরম নিশ্চিন্ত ঘুম।মুদিত চোখের পাতায় ভেসে বেড়ায় অনেক সুখের স্বপ্ন।আজ তাই এই আলো ঝলমলে রাতে"স্বপ্ননীড়"আলোকে আলোকে মোহময়ী হয়ে উঠেছে।সুলতার তিন কৃতি সন্তান-ঝুমকো, টিকলি, নোলক তাদের দুখিনী মায়ের সমস্ত দুখের স্মৃতি মুছিয়ে তাকে এক নবজীবন উপহার দিয়েছে।
"স্বপ্ননীড়"এর বড় হলঘরে ঢুকতেই সৌমেন বাবু ও তাঁর মা অনিলা দেবীর ফ্রেমে বাঁধানো বিশাল ছবি দেওয়ালে টাঙানো, টাটকা রজনীগন্ধার মালায় শোভিত;সামনে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি এবং সুগন্ধি ধূপ। সুলতা বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে সেই ছবি দুটোর সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নেয়।এই দুজন মানুষের নিঃস্বার্থ সাহায্য ও নিরন্তর অনুপ্রেরণাই তাকে জুগিয়েছে জীবনে লড়াই করার সাহস। সৌমেন বাবু না থাকলে সে হয়তো কবেই তার সন্তানদের নিয়ে হারিয়ে যেত কোন অতল গহ্বরে।অতল তলে তলিয়ে যাওয়ার আগেই দেবদূতের মত সৌমেন বাবু উদয় হয়ে সুলতার হাত ধরে টেনে তুলে তাকে বাঁচান।শিশুকন্যাদের মুখে অন্ন তুলে দেন। তিনি অবলম্বন হয়ে সুলতার পাশে না দাঁড়ালে এই মধুর দিনগুলোর ছোঁয়া সে কোনোদিনই পেত না। সুলতা তাঁদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ, শ্রদ্ধাশীল।
জন্মদিনের দিন উৎসব শেষে সারারাত ফেলে আসা অতীত, বর্তমান ভাবতে ভাবতে কখন যেন সুলতা ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙে মেয়েদের ডাকে। তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠে সে নিত্যদিনের মত প্রথমেই আরাধ্য দেবতাকে প্রণাম করে সৌমেন বাবু ও তাঁর মায়ের ছবিতেও শ্রদ্ধানত হয়ে প্রণাম করে। পরপারে চলে গেলেও তাঁদের আত্মা যেন সবসময়ই সুলতা ও তার সন্তানদের ঘিরে থাকে, সমস্ত বাধা-বিপত্তি , বিপদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করে। তাঁদের আশীর্বাদের হাতের ছোঁয়া সুলতা আজও জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই মর্মে মর্মে অনুভব করে। তাঁদের মৃত্যু আজও তাকে কাঁদায়। মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে প্রতি বছরই সুলতা আর তার তিন মেয়ে সাধ্যমতো গরীব ও অনাথ শিশুদের খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করে আর তাঁদের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনায় শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে অন্তরের অন্তঃস্থল হতে উত্থিত অশ্রুধারা।
কলমে:- যুথিকা দেবনাথ
Juthika Debnath
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২১
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।