উড়িষ্যার রজঃ উত্সব
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখক : লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
দেশ : India , শহর : New Delhi

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , সেপ্টেম্বর
প্রকাশিত ৯৩৫ টি লেখনী ৭২ টি দেশ ব্যাপী ২৫৬৪৬২ জন পড়েছেন।
উড়িষ্যার রজঃ উত্সব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পুরাণ মতে, কাশ্যপ প্রজাপতির কন্যা ভূদেবী। উর্বরতার দেবী ভূদেবীকে রামায়নে ব্যক্ত করা হয়েছে সীতার মা হিসেবে। আবার তামিল সাধু-কবি অন্ডালের রচনা অনুযায়ী, এই ভূদেবীই দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হয়ে ছিলেন সত্যভামা রূপে। যখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী। ওড়িশায় জগন্নাথের স্ত্রী হিসেবেই পূজিত হন ভূদেবী। মেয়েরা এই সময়টায় শারীরিক, মানসিক ভাবে অনেক অসুবিধার মধ্যে দিয়ে গিয়েও সব কাজকর্ম সামলান। এই সময় তাদের প্রয়োজন যত্ন, খুশি থাকা। তাই নিয়েই ওড়িশার এই বিশেষ উত্সব। আষাঢ় মাসে সূর্য মিথুন রাশিতে প্রবেশের সময় ঋতুমতী হয়ে ওঠেন ভূদেবী।
চার দিনব্যাপী এই উত্সবের চতুর্থ দিনে স্নান করেন ভূদেবী। প্রথম দিনকে বলা হয় পহিলি রজ। দ্বিতীয় দিন মিথুন সংক্রান্তি। সূর্যের মিথুন রাশিতে প্রবেশ করার দিন। তৃতীয় দিন ভূ দহ বা বাসি রজ। এবং চতুর্থ দিন বসুমতী স্নান। প্রাচীন কাল থেকে এই চার দিন ব্যাপী উত্সব পালিত হয়ে আসছে ওড়িশায়। পৃথিবী এই সময় পুনরুজ্জীবনের মধ্যে দিয়ে যায়। এই সময় তাঁর প্রয়োজন বিশ্রাম ও বিশেষ যত্ন। মেয়েদের তাই বিরত রাখা হত কৃষি এবং গৃহস্থালির মতো কাজ থেকে। এই তিন দিন শুধুই তাদের আরাম করা, পছন্দের খাবার খাওয়া, যত্ন আর প্রশ্রয় পাওয়ার সময়। ওড়িশার বিভিন্ন প্রান্তে মেলায় ঘুরে, সাজগোজ করে, দোলনায় ঝুলে এই সময় উপভোগ করেন মহিলারা। প্রাচীন রীতি মেনেই বর্তমানে বিভিন্ন অফিস, কর্পোরেটেও মেয়েদের জন্য থাকে এই সময় বিশেষ ব্যবস্থা। উপহার, বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বিভিন্ন সংস্থায়। সারা দেশে যে সময়টায় মেয়েদের অচ্ছুত্ করে রাখার প্রক্রিয়া, স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়ার সেই সময় যে খুশি, আরামের প্রয়োজনের কথা চিকিত্সকরা বলে থাকেন তার প্রতিফলন দেখা যায় ওড়িশার এই উত্সবেই।

আঞ্চলিক ভেদাভেদে পৃথিবী কখনও শাক্ত দেবী (কামাক্ষ্যা), কখনও বা বিষ্ণু পুরাণে পূজিতা (ভূদেবী, সত্যাভামা)। যে প্রান্তে, যে রূপেই পূজিত হন না কেন সমাজের প্রতিফলনটা একই। পৌরাণিক পুরুষ ও প্রকৃতির রমণে যে ঘাম ঝরে তার থেকেই পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিই পৃথিবীকে উর্বর করে তোলে। এই সময় থেকেই শুরু হয় কর্ষণ, বীজ বপন। কৃষিভিত্তিক সমাজে তাই আষাঢ়ের আগমন ছিল জীবন যাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কখনও অম্বুবাচী, কখনও রজ পর্ব, বিভিন্ন উপজাতি জানা-অজানা আচারে বরণ করে নেয় বর্ষাকে। বৃষ্টি যেখানে ঋতুস্রাব, সেখানে রক্ষণশীল সমাজের চোখরাঙানির মধ্যে থেকেও ওড়িশার উত্সব স্বতন্ত্র। মেনস্ট্রুয়াল পেন, মেনস্ট্রুয়াল স্ট্রেসের কারণে এই সময় কর্মরতা মেয়েদের মেনস্ট্রুয়াল লিভ পাওয়া উচিত কি না তা নিয়ে সারা বিশ্বে যখন বিতর্ক চলছে, তখন ওড়িশার এই উত্সব কি বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে না?

আষাঢ় মাসে সূর্য মিথুন রাশিতে প্রবেশের সময়ের পরই শুরু হবে অম্বুবাচী। ঋতুমতী হবেন মা কামাক্ষ্যা। চার দিন বন্ধ থাকবে কামাক্ষ্যা মন্দির। এ সময় যে মা ‘জেগে’ উঠেছেন। তাঁর দর্শন বারণ, ছোঁয়া বারণ। যোনিপীঠ ঢাকা থাকবে লাল পাড় সাদা শাড়িতে। মা যখন ‘ধরা-ছোঁয়া’র বাইরে, তখনই মন্দির চত্বরে উত্সবে মেতে উঠবে ভক্তেরা। চার দিন ধরে চলবে অম্বুবাচীর মেলা। তান্ত্রিক, অঘোরদের আখড়া জমে উঠবে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ১৩ থেকে রবিবার রাত ১টা ৩৮। এই সময়ে যে ‘মা’ সবচেয়ে জাগ্রত। সঠিক তন্ত্রসাধনায় অভীষ্ট ফল মিলবেই মিলবে। শনিবারের অষধি অমাবস্যা (আষাঢ় মাসের অমাবস্যা) তন্ত্র সাধনার জন্য বছরের পুণ্যতম দিন।

কিন্তু, এই রীতি তো বহু শতাব্দী প্রাচীন। সকলেরই জানা। মা কামাক্ষ্যার যোনিপীঠের উপর বিছিয়ে দেওয়া সাদা কাপড় কী ভাবে চার দিন পর লাল হয়ে ওঠে তা নিয়ে বিতর্ক, যুক্তি-তর্ক থাকলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে সব সরিয়ে রেখে বছরের পর বছর আষাঢ় মাসে পালিত হয়ে চলেছে অম্বুবাচী। বৈজ্ঞানিক, বিশেষজ্ঞেরা কামাক্ষ্যা মন্দিরের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের বর্ষা কালে ফুলে ওঠা, আর সেই জলে সারা বছর সিঁদুর, কুমকুমে পূর্ণ মা কামাক্ষ্যার যোনি ধুয়ে যাওয়া জলে সাদা কাপড় লাল হয়ে ওঠার তত্ত্ব দিলেও, ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে তা ধোপে টেকেনি। নতুন করে অম্বুবাচীর প্রাক্কালে তা হলে কেনই বা আলাদা করে মনে করিয়ে দিচ্ছি সেই রীতির কথা?

কামাক্ষ্যার অম্বুবাচী পালন নিয়ে সারা দেশ উত্সবে মাতলেও প্রায় অজানাই থেকে গিয়েছে ওড়িশার রজ পরব। ধরিত্রী মা ঋতুমতী হওয়ার আনন্দে গোটা ওড়িশা জুড়ে যে উত্সব পালিত হয়, রাজ্যের বাইরে প্রায় পৌঁছয় না তার খবর। জগন্নাথের স্নানযাত্রা, অমাবস্যা কেটে যাওয়ার পর রথযাত্রায় দেশ বিদেশের ভক্ত সমাগমের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও আড়ালেই থেকে গিয়েছে তার মাঝে হওয়া রজ পরব। ঋতুস্রাব নিয়ে যে প্রচলিত ট্যাবু, কুসংস্কার বয়ে চলেছে দেশ, তার থেকে অনেকটাই উল্টো সুর এই উত্সবের।

রচনাকাল : ২৭/৫/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 2  Germany : 2  India : 35  Ukraine : 1  United States : 119  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 2  Germany : 2  India : 35  Ukraine : 1  
United States : 119  
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
উড়িষ্যার রজঃ উত্সব by Lakshman Bhandary is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৩১০৮
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী