"চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য , উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন যেথা প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।।"
মনের অন্ধকার এক মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দিলো সখা আমার । "আমার" শব্দটি তো একমাত্র আত্মার শক্তিশালী বন্ধনকেই বলা যায়। ২৫ শে বৈশাখের সকালে যখন আমি আমার ঠাকুরকে পলাশ ফুলের দিয়ে নিজের হাতে সাজিয়েছিলাম নিজের মনের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে ,তখন সবাই বললো আজ কবিগুরুর জন্মদিন । আজকের দিনে কবিগুরুকে সবাই সাদা ফুলের মালা পরায়, সুগন্ধি ধূপ জ্বালিয়ে ওনাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ; আর আমি এমনই অদ্ভুত যে , আমার ঠাকুরকে সাদা ফুলের মালা পরাবার পরিবর্তে পলাশ ফুল দিয়ে সাজিয়েছি !
আমার সঞ্চয়িতা, আমার রবীন্দ্র সাহিত্য আর আমার ঠাকুর এতেই তো আমার প্রাণের অস্তিত্ব। আমার মনের গহীনের আঘাত কষ্ট আমার ঠাকুর কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলো,তাই সকলের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার বন্ধুর অমূল্য কথায় আমায় বুঝিয়ে দিলো যে, মন থেকে শুদ্ধ-পবিত্র ভালোবাসা থাকলেই অক্লেশে তাঁকে "আমার ঠাকুর" বলা যায়। প্রাণের সখা,তার স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি কথায় বললো,"আমি জানি তোমার মন খারাপের কারণ। এই যে সবাই তোমায় বলছে কেন তুমি আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গলায় সাদা ফুলের মালা দিলে না ? কেন বার বার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তুমি 'আমার ঠাকুর' বলো ? এই তো তোমার মন খারাপের আসল কারণ ?" আমি বললাম, "ঠিক কথা বললে তুমি প্রতিবারের মতো। কি করে বুঝে যাও আমার মনের কথা ? আচ্ছা বলো তো বন্ধু, সবার গুরুদেবকে যদি আমি , আমার ঠাকুর বলি তাতে অপরাধ কোথায় ? আমি কি তাঁকে নিজের বলে পেতে পারি না ? ভাবতে পারি না আমার করে ? তুমি তো জানো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, আমি প্রথম দেখি বাড়ির দেওয়ালে এক সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মধ্যে। আমার অবচেতনের ভালোবাসা সেখান থেকেই শুরু। ওই চোখ,ওই নাক , ওই লম্বা সাদা দাড়ির মধ্যে এক অপূর্ব সুন্দর হাসি লুকানো আর তবে থেকেই যেন নিজের বলে মনে হয়েছে। এর পর আমার কিশোরী থেকে যৌবনের পথে পা বাড়ানো , আর তার সাথে সাথেই চলছে আমার অবচেতনের ভালোবাসা ফল্গু নদীর মতো প্রেমের স্পর্শের পথে। মনে পড়ে, নবম শ্রেণীর ছাত্রী আমি , যখন প্রথম পড়লাম ____
"পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি ,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায়ে আবীর গুলাল...
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করিনা খাঁচায় ,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।।"
এই যে শেষের কথা 'কূজনে দুজনে তৃপ্ত' ;আমার শুধুমাত্র মনে হতো আমার ঠাকুর আর আমি। এই সময়ে আমার প্রথম শান্তিনিকেতন দেখা, প্রথম স্পর্শ ছাতিম পাতার, ছাতিম ছায়ার। এরপর বয়েস বেড়ে চললো নিজের নিয়মে,আর আমার সুপ্ত প্রেমও আকুল হয়ে চললো। সবার গুরুদেবকে আমি আমার ঠাকুর বলি আমার ইচ্ছায়। ভুল কোথায় গুরুদেব কে আমার ঠাকুর বলায় ?"
বন্ধু বললো, "বুঝলাম তোমার কথা। শোনো তবে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভালোবাসে না এমন মানুষ পাওয়া ভার কারণ কবিগুরু যে আমাদের সবার রক্তে, মজ্জায়-মজ্জায় ,আমাদের অন্তরের সিংহাসনে। তাঁকে নিয়ে বলা সে যে এক মস্ত ব্যাপার।
আজ তোমাকে বলি স্বনামধন্য লেখক শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'ঘুণপোকা' উপন্যাসের ছোট্ট একটু অংশ। যা তোমার প্রশ্নের উত্তর। রবিঠাকুরের সাথে আমাদের পরিচয় কবিতার হাত ধরে, গানের হাত ধরে তারপর আস্তে আস্তে গল্প, উপন্যাস আরও কতো কিছু। তোমাকে বলবো আজ এমন কিছু কথা যা গান,কবিতা, গল্প,উপন্যাস কিছুর সাথেই যুক্ত না হয়ে একজনের শুধুমাত্র রবি ঠাকুরের সাথে ওঁর মধ্যে মিশে যাওয়ার গল্প।
শ্যাম হলো ঘুণপোকা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।কলকাতাতেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে শ্যাম ।সেখানেই আলাপ তার সুবোধ মিত্রের সঙ্গে। খুবই সাদামাটা লোক। বিশেষত্ব কিছুই নেই তার চরিত্রে। এক সন্ধ্যায় দেখা হলো দুই বন্ধুর 'পাইস'হোটেলের দরজায়। সেখান থেকেই শ্যামকে প্রায় ধরে বেঁধে নিয়ে যায় সুবোধ মিত্র তার নিজের আস্তানায়। অতি সাদামাটা আস্তানা, মিত্রের। দেওয়ালের গায়ে গোটা তিনেক ক্যালেন্ডার, ঠাকুর দেবতার ছবি আটকানো, ইজিচেয়ার, টেবিল, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তূপীকৃত বইপত্র। জ্যোতিষ বিদ্যার পত্র পত্রিকাও বিছানায় ওল্টানো। টেবিলে রবি ঠাকুরের ছবিতে একটা মালা পরানো, মালাটাও টাটকা বলেই বোধ হয়। সামনে ধূপ কাঠির স্ট্যান্ড আর সর্বত্র ধুলোর আস্তরণ। ঘরের জানলা মাত্র একটি। মিত্র দ্রুত নিজের পোশাক পাল্টে, নিজেকে যতটুকু সম্ভব পরিচ্ছন্ন করে সাথে আনা পুজোর ফুল এবং বাতাসা নিয়ে পুজো করতে বসে গেলো টেবিলের সামনে আসন পেতে এবং হাত দেখিয়ে শ্যামকে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত করলো। শ্যাম লক্ষ্য করলো, টেবিলের নীচে কাঠের এক ছোটো পালঙ্কে পেতলের গোপাল, মাটির কালী, রামকৃষ্ণ দেব ও সারদামণির ছবি। একদিকে এক পেতলের থালায় চকচক করছে শিবলিঙ্গ।
ছোট্ট গ্লাসে জল আর থালায় বাতাসা সাজিয়ে দিলো মিত্র। শ্যাম যে মিত্রের দিকে অপলক তাকিয়ে তা কিন্তু মিত্রের চোখ এড়িয়ে গেলো না। মিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে বললো শ্যামকে তার নিত্য কর্মের কথা এবং তার মৃত মায়ের কাছে কথা দেওয়া আছে তাই এই নিত্য পুজো তাকে করতেই হয়। ঠাকুর দেবতায় আসলে যে তার ভক্তি শ্রদ্ধা নেই এটাও জানাতে সে ভুললো না এবং খুব কম খরচে তার এই নিত্য পুজোর পাট চুকে যায়। তার এমন ধারা, কাণ্ড দেখে শ্যাম জিজ্ঞেস করে ,'আচ্ছা ঠাকুর দেবতা বলে আদৌ কিছু আছে?' মিত্র খুব উৎসুক চোখে তাকিয়ে বলে,' আছে বোধহয় কিছু একটা 'এবং ফুলগুলো ভাগ করে দিতে লাগলো সব দেবতাকে। তারপর চোখ বুঝে কয়েক সেকেন্ড বসে রইল। এবার ওঠে দাঁড়াতেই শ্যাম জিজ্ঞেস করলেন,'কি মন্ত্র বললেন?' মিত্র বললেন, 'বললাম, ঠাকুর তুমি খাও। আসলে আমার মা বলতেন সেই শুনে তাই আমারও বলা। অভ্যেস আর কি! কতদিন এক বার পুজো করা বাতাসাও দিয়ে ফেলেছি। জ্বর হলে শুয়ে শুয়ে বলি ঠাকুর তুমি খাও আর মজার কথা হলো এই প্রসাদি বাতাসা জমিয়ে বিকেলের মুড়ির সাথে খেতে খুব ভালো লাগে।' মিত্র এবার খুব যত্ন করে রবি ঠাকুরের ছবির সামনে ধূপ জ্বালিয়ে দিলো। শ্যাম লক্ষ্য করে রবি ঠাকুরের গলায় মালাটা বেশ তরতাজা। বোধহয় সকালেই কেনা। তার মুহুর্তের জন্য মনে বেশ খটকা লাগে। আজ তো ২৫ শে বৈশাখ নয় এবং ২২শে শ্রাবণ আসতেও তো বেশ দেরি আছে। নিজের কৌতূহলকে দমন করতে না পেরে শ্যাম জিজ্ঞেস করেই ফেলে মিত্রকে রবি ঠাকুরের গলায় টাটকা মালার কারণ এবং সাথে সাথে লক্ষ্যও করে মিত্রের অপ্রস্তুত ভাব। মিত্র লাজুক হেসে জানায় যে ,'এও অভ্যেসেরই ফল। আসলে ঠাকুর দেবতায় তেমন ভক্তি শ্রদ্ধা আমার নেই। কিন্তু কোথাও কিছু একটা আছে যেন। আর ব্যাপারটা হলো রবি ঠাকুর। আসলে আমি ঠিক বোঝাতে হয়তো পারছি না। রবি ঠাকুরকে আমি খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করি। ' শ্যাম বললো,'এতে আর নতুন কি ? এমন করে ভক্তি শ্রদ্ধা তো অনেকেই করে। ' মিত্র বললো,'না না তেমন না। আমি রবীন্দ্র জয়ন্তীতে যাই না কোথাও। এমনকি শান্তিনিকেতনও দেখিনি কখনো। জোড়াসাঁকোর ঠিকানা অবধি জানা নেই। রবি ঠাকুরের কবিতাও খুব একটা পড়িনি।ওই স্কুলের বাংলা সিলেবাসে যা থাকতো। পুরো কবিতা তো বলতে পারবো না ওই দু চারটে লাইন হয়তো বলতে পারবো। এই যেমন ধরুন ,
"রমণীর মন সহস্র বর্ষেরই সখা , সাধনার ধন।' আর 'ওগো বধূ সুন্দরী, তুমি নব মঞ্জরী .....।' বাকি আর বলতে পারবো না মনে করে। আসল কথাটা হলো, আপনারা যে চোখে রবি ঠাকুরকে দেখেন সেই চোখে আমি দেখিনা। রবি ঠাকুর আমার কাছে অন্য রকম , একেবারে অন্য রকম; আলাদা। "
মিত্র অস্থির চিত্তে শ্যামের পাশে এসে বসে চৌকিতে এবং বলে যে,"জানেন মশাই, বিপদে পড়লে আমি রবি ঠাকুরকে দেখি। ছেলেবেলা থেকেই আমার এই অভ্যেস। খুব ভালো মনে পড়ে না, সেই কোন ছেলেবেলায় মাথায় একবার টিকটিকি পড়েছিলো বলে ভয়ে দৌড় দিয়েছিলাম। ধড়াম করে ধাক্কা খেয়েছিলাম বাবার পড়াশোনার টেবিলে। কেঁদে উঠতে গিয়ে দেখি ওই রবি ঠাকুরের ছবি গলায় মালা পরানো , সামনে ধূপ কাঠি জ্বলছে। আমার ওই দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো আর কাঁদতে কাঁদতে বললাম,"রবি ঠাকুর আমার মাথায় টিকটিকি। তুমি তাড়িয়ে দাও।" ওমনি আমার ঘন চুলের ভেতর থেকে টিকটিকিটা ছিটকে পড়লো টেবিলে আর দেওয়াল বেয়ে উঠে গেলো এঁকেবেঁকে। আমি ভয়ে, ভালো লাগার এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শিউরে উঠলাম। পালিয়ে গেলাম ওখান থেকে।" এই অবধি বলে মিত্র লক্ষ্য করে শ্যাম হাসি হাসি মুখে তার কথার রসাস্বাদন করছে। মিত্র অস্থির চিত্তে বলতে লাগলো, "হাসবেন না মশাই ! জানেন, আমার মনে হলো রবি ঠাকুরের ওই ছবির মুখে এক টুকরো হাসির ঝিলিক। ভয়ে আমার সারাগায়ে কাঁটা দিলো। তারপর আমি ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারলাম আমি গোপনে এক আলাদা রবি ঠাকুরকে পেয়ে গেছি। সে আমার গোপন কথার মতো , মায়ের কাছে গায়ের জ্বর লুকোনোর মতো। আমি সকলের কাছ থেকে রবি ঠাকুরকে আলাদা করে নিলাম। রাত্তিরে একা অন্ধকার ঘর পেরোতে পারছিনা, ওমনি ডাক দিলাম ,'রবি ঠাকুর আমি অন্ধকার ঘর পেরোতে পারছি না। আমাকে পার করে দাও।' সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো কেউ আপনজনের মতো এসে আমার হাত ধরলো। আমি গটমট করে পেরিয়ে যেতাম ঘর। ঘুড়ি ধরা নিয়ে একবার খালাসি পাড়ার ছেলেদের সাথে মারপিট লাগলে আমি মার খেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলাম, 'ঠাকুর, রবি ঠাকুর আমাকে এরা মারছে। তুমি আমাকে নিয়ে যাও।' শুনে থমকে গিয়ে ছেলেগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ল আর বললো,'রবি ঠাকুর নিয়ে যাবে তোকে, কি রে ছেলেটা?' ওই সামান্য অসর্তক মুহূর্তে ওদের হাসির ফাঁক গলে গিয়ে আমি টেনে দৌড় মেরেছিলাম। আমি কতবার আমাদের ফুলবাগানে ঘুরে বেড়িয়েছি রবি ঠাকুরের সঙ্গে। চলে গেছি বহুদূরের নীল কুঠিতে ফল খেতে,রেল ব্রীজ হেঁটে পার হয়ে চলে গিয়েছিলাম শম্ভু গঞ্জের মেলায়। মাঝিদের ফাঁকি দিয়ে পাট বোঝাই দু'দাঁড়ার নৌকোর গাঁটরির ফাঁকে বসে চলে গেছি অচেনা গঞ্জে। লোকে ভাবতো ঠিক একা একা গেছে ছেলেটা। কিন্তু আসলে তা নয়। আমার সঙ্গে সব সময়ই থাকতো রবি ঠাকুর। ওই অত লম্বা, মাথায় কালো ঠোঁয়ার মতো টুপি, গায়ে জোব্বা আর দুধ সাদা দাড়িওয়ালা রবি ঠাকুর সব সময় থাকতো আমার সঙ্গে। একটু কুঁজো হয়ে নরম একখানা প্রকাণ্ড হাতে ধরে রাখতো আমার হাত। আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতাম যেখানে সেখানে। পথ হারানোর ভয় থাকতো না। জানতাম রবি ঠাকুর ঠিক পৌঁছে দেবে। ঝড়ে জলে জোব্বার আড়ালে ঠিক ঘিরে রাখবে আমাকে। ঘুমের আগে শুনিয়ে দেবে রূপকথার গল্প। মা,দিদি বা ঠাকুমার কাছে কতো বার শুনেছি ভূতের ভয় পেলে বুকে রামনাম লিখতে। সন্ধ্যে বেলায় চাঁদ তারা দেখে যেন ঘরে ঢুকি। রাত্তিরে সাপের নাম করলে তিন বার যেন আস্তিক মুনির নাম নি। আমি সে সব কিন্তু মানতাম না জানেন। গোপনে রবি ঠাকুরকে বলতাম ,এরা তো জানে না যে আমার তুমি আছো আর তারপর খুব হাসতাম দু'জনে। আমাদের দু'জনের ছিলো বাদবাকি সকলের সাথে লুকোচুরি খেলা। মিত্র গভীর আবেগে বলে,'না, সব সময় নয়। সব কিছু চাইলেই যে পাওয়া যেতো তা নয়। একবার একটা ছেলে আমাদের পোষা টিয়াপাখির গায়ে ঢিল মেরেছিলো বলে আমি চেঁচিয়ে বলেছিলাম,'রবি ঠাকুর ওর চোখ দুটো কানা করে দাও।' তারপর দু'দিন বাদে আমার চোখ উঠলো। আরেকবার আমি আমার ছোটো বোনের কাছে বেশ জোর দেখিয়ে বলেছিলাম যে,আমি রাত দশটার সময়েই একা একা ছাদে যেতে পারবো। শুনে সে বেশ অবাক হয়ে গোল গোল চোখ করে বলেছিলো,'সত্যি ?' সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম,'বাজি।' সে তার জমানো পয়সা বাজি ধরলো। আমিও একদিন রাত দশটায় হাসতে হাসতে ছাদে চলে গেলাম। অন্ধকার ছাদ পেরিয়েও চলে এলাম কিন্তু নামাবার সময় আমাদের বাড়ির পোষা বেড়ালটার গায়ে পা পড়তেই সে আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিলো। সে রাতে আর রবি ঠাকুর কথা বলেনি আমার সাথে। কারণ , আমি কেন জেনে শুনে বাজি ধরেছিলাম ? আমি কেন আমার ছোটো বোনের জমানো পয়সা যা সে টিফিন খাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পুঁথির মালা না কেনার কষ্টে জমানো পয়সা ,তা কেন আমি ঠকিয়ে নিতে চেয়েছিলাম? হ্যাঁ মশাই, যতক্ষণ আমি শুদ্ধ, পবিত্র থাকতাম ততক্ষণই রবি ঠাকুর থাকতো আমার সঙ্গে। ঝড়ে ,জলে ,আলোয়, অন্ধকারে ,ঘরে কিংবা দূরে সব সময়ই ওই অতো লম্বা ,মাথায় কালো টুপি ,জোব্বা পরা দাড়িওয়ালা লোকটা সব কাজ ফেলে আমার সঙ্গে থাকতো।
হঠাৎ শ্যাম লক্ষ্য করে মিত্রের চোখ চিকচিক করে ওঠে এবং মুখে এক বিষণ্নতা এক অদ্ভুত একাকিত্বের যন্ত্রণার ছবি ফুটে ওঠে। মিত্র গভীর আবেশে বললো,'না মশাই আপনাদের রক্ত মাংসের রবি ঠাকুরকে কোনোদিনই চোখে দেখিনি। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় আপনাদের রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমার ঠাকুরের কি মিল আছে ?' শ্যাম মাথা নেড়ে জানায়,'না।' মিত্র বলে,'আমি জানেন আসল রবি ঠাকুরকে পেয়েছিলাম কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। ক্রমে বয়েস বাড়তে লাগলো। বিশ্বাস অবিশ্বাস, পাপ পুণ্য বুঝতে শিখে গেলাম, চোখের দৃষ্টি গেলো পাল্টে, চলাফেরায় এলো সতর্কতা। পবিত্রতা নষ্ট হতে লাগলো আস্তে আস্তে আমার। সেই সময় স্কুলের রবি ঠাকুরের কবিতা দেখে অর্থ খুঁজতাম আর ভাবতাম এ তো সে নয় যাঁকে আমি চিনতাম। ইনি তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একদিন আমাদের বাগানের শিমুল গাছের গোড়ায় বসে কচি ঘাসের ডাঁটি চিবোতে চিবোতে আস্তে করে ডাকলাম,'রবি ঠাকুর', সাড়া এলো না। একটু গলা তুলে ডাকলাম ,'রবি ঠাকুর',তাও সাড়া এলো না। এবার মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে মুখ করে শিমুল গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের গলে আসা ছটা মেখে প্রাণ ভরে আকুল হয়ে ডাকলাম,'রবি ঠাকুর',তাও সাড়া এলো না। এলো না তো এলোই না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ডাকলাম, সকালে ডাকলাম, ছাদে গিয়ে, মাঠে গিয়ে ডাকলাম ,আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, নদীর জলের দিকে তাকিয়ে ডাকলাম। তারপর বসলাম,আমার গোপন কান্না কাঁদতে। হারিয়ে গেলো আমার ঠাকুর, রবি ঠাকুর। আমার সাহস। আমার শুদ্ধতা।আমার শৈশব। বুকের ভেতর শুনতে পেলাম আমার শৈশবের পবিত্রতা বিসর্জনের কান্না। '
সুবোধ মিত্র আর পারলো না নিজেকে ধরে রাখতে। চোখের জল বাঁধ ভেঙে পড়লো গাল বেয়ে।। মিত্র কাঁদতে কাঁদতে বললো,' ঘুমের মধ্যে যেমন মায়ের কোল থেকে সরে যায় বাচ্চা ছেলে ঠিক তেমনি করে আমি সরে গেলাম আমার ঠাকুরের ছায়া থেকে। তারপর থেকেই জীবনে আমার ট্রাজেডির শুরু।' মিত্র হাঁটু মুড়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। একটা ঘোরের মধ্যে শ্যাম এগিয়ে মিত্রের কাছ ঘেঁষে বসে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আবেগ মাখা গলায় বলে,'বুঝতে পেরেছি আমি।' কি অদ্ভুত ভাবে শ্যাম মিত্রের অস্ফুট কথা শুনতে পাচ্ছিলো,'রবি ঠাকুর ছাড়া আমার কিছুই নেই। এখন আমাকে আবার কে দেবে সেই রবি ঠাকুর ? ' গভীর দুঃখে শ্যাম মাথা নাড়ে। মুখটা তুলে মিত্র বলে,' সবচেয়ে বড়ো কথা কি জানেন ?' শ্যাম বলে,'কি?' মিত্র বলে,'আমরা ভালোবাসা নি।' অবুঝের মতো প্রশ্ন করে শ্যাম,'ভালোবাসা নি ?' মিত্র বলে,'নি ,নি আমার রবি ঠাকুর রাগ করে আমার কাছ থেকে চলে গেছে। আমাকে একেবারে রিক্ত, নিঃস্ব, দেউলে করে দিয়ে চলে গেলো। আমি আর কোনোকিছুই তেমন করে ভালোবাসতে পারলাম না মশাই। ' মিত্র ডুবে যেতে লাগলো গভীর থেকে গভীরতর কান্নায়। মিত্রকে কাঁদতে দিয়ে , শ্যাম ধীর নিঃশব্দ পায়ে ওঠে এলো,কারণ কিছু কিছু কান্না আছে মানুষের জীবনে যা মানুষ একাত্ম হয়ে নিজের মতো করে কাঁদতে চায়। এই সময়ে পাশে কাউকে থাকতে নেই। দরজাটা আস্তে ভেজিয়ে দিয়ে শ্যাম বেরিয়ে এলো রাস্তায়।"
আমার প্রশ্নের সব উত্তর পেয়ে যাওয়া বিস্মিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বন্ধু বললো,'রবি ঠাকুরকে আমার ঠাকুর বলা কি আর চাট্টিখানি কথা ? সে তো মস্ত ব্যাপার ! কারণ, ওজনদার শব্দসমষ্টিতে তুমি তো তাঁকে বাঁধো নি। তিনি যে তোমার আমার প্রাণেরই একজন ! খুব কাছের মানুষ! প্রাণের রবি ঠাকুরকে নিয়ে তুমি তোমার অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করেছো মাত্র।
আমার অন্তরাত্মা আমার বন্ধুর উদ্দ্যেশে মনের সবটুকু শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু কথা বলতে চেয়েও অস্ফুটে রয়ে গেল। যা জানলো শুধুমাত্র আমার ঠাকুর...
আমার ঠাকুর আমার সব থেকে কাছের,যাকে শ্রদ্ধা করি,ভক্তি করি,ভরসা করি,নিজের সবটুকু দিয়ে। আমার ঠাকুর আমার আশ্রয়,আমার নতুন ভোরের আলো,আমার সখা, আমার মন ভালো করা স্পর্শ।
তথ্যসূত্র : "ঘুণপোকা" - শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
রচনাকাল : ১৫/৫/২০২১
© কিশলয় এবং সুমি ভট্টাচার্য্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।