দুজনেই যখন নিজের নিজের ভাবনায় মশগুল তখনই দরজায় মৃদু টোকা পড়ে, চমকে উঠে দুজনেই দরজার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। পারিজাত একবার চারুর দিকে তাকিয়ে নিজেই যায় দরজা খুলতে।
-কেমন আছিস চারু ?
বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে আসে রুহী, মেহুল,রৌনক সহ বাকিরা।
চারু হাল্কা মাথা নাড়িয়ে 'ভালো আছে' বলার চেষ্টা করে। মুখে কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই সে। মাঝে মাঝেই চোরা চোখে দেখছে পারিজাতের দিকে আর প্রতিবারই দেখেছে পারিজাতকে তারই দিকে তাকিয়ে থাকতে। তবে সে দৃষ্টিতে কাল রাতের আক্রোশের লেশমাত্র নেই, আছে শুধু অনুতাপ।
এর মধ্যেই পারিজাতের বন্ধুরাও আসে চারুর খোঁজ নিতে। চারুকে সুস্থ দেখার পরে দু'দলের মধ্যেই বিস্তর আলোচনা শুরু হয় আজকের ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান নিয়ে। কেউ বলে চারুকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হবেনা, কেউ বলে ওকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবেনা। এক একজন বলে থেকে যাচ্ছি আমি বাকিরা যাক এভাবেই বেশ কিছুক্ষন গবেষণা চলে।
ঘুম ভাঙার পর নিজেকে পারিজাতের ঘরে আবিষ্কার করার পর থেকেই চারু বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এত যে জল্পনা-কল্পনা ওকে নিয়ে সেসব কিছু যেন কানেই ঢুকছেনা ওর। কি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে।
ওদের গভীর আলোচনায় ছেদ পরে একটা মৃদু গলা খাঁকারীর আওয়াজে।
-আপনারা সবাই ঘুরে আসুন, আমি আছি চারুর কাছে।
চারুর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে পারিজাত।
ওর কথা শুনে চারু সহ বাকি সকলেই অবাক। কোনো প্রশ্ন আসার আগেই পারিজাত আবার বলে,
-আসলে তাঁবুতে থাকার জন্য কাল সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। আজকে এমনিও সারাদিন হোটেলেই থাকবো ভেবেছিলাম। আমায় থাকতেই হচ্ছে যখন আমি চারুর কাছেই থাকি বাকিরা কেন শুধু শুধু ঘোরা নষ্ট করবে। তাছাড়া চারু এখন অনেকটাই ভালো আছেন। ওনার শরীর যদি ভালো লাগে আমরা হোটেলের আশপাশটা ঘুরে আসবো নাহয়। ঘুরতে এসে সবার হোটেলে বসে থাকা কাজের কথা নয়, তাও অপ্রয়োজনে।
কথা শেষ করেই চারুর দিকে একবার দেখে নেয় পারিজাত।
দেখে অবাক বিস্ময়ে চারু একভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
পরপর এতগুলো চমকে চারু এতটাই বিস্মিত যে কিছু বলার অবস্থাতেই নেই আর।
ওর মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে বেশ কিছু সাবধানবানী শুনিয়ে একে একে সবাই বেরিয়ে পড়ে। রয়ে যায় শুধু চারুলতা আর পারিজাত।
সবাই চলে যেতে দরজা বন্ধ করে এসে খাটের পাশের টেলিফোন থেকে রিসেপশনে ফোন করে চারুর জন্য চিকেন স্যুপ আর টোস্ট অর্ডার দিয়ে চারুর পায়ের দিকে খাটের এক কোনে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে পড়ে পারিজাত। ওকে দেখে চারুর মনে হয় যেন পরাজিত কোনো সৈনিক, নিজের ব্যর্থতার গ্লানিতে জর্জরিত, শক্তিহীন, নিজের জীবনকে বয়ে নিয়ে যেতেও যে অক্ষম। একটা সম্বল পেলেই হয়তো আবার সে ঘুরে দাঁড়াবে, আবার একবার লড়বে। কিন্তু কে দাঁড়াবে ওর পাশে ! কে ওর হাতের ওপর হাত রেখে শক্তি দেবে লড়ার !
আবার একবার বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে চারুর, তবু কোনো কথা না বলে চুপচাপ মাথা নামিয়ে বসে থাকে সেও।
ওদিকে পারিজাত ভাবে ক্ষমা চাইতেই হবে ওকে চারুর কাছে যেভাবেই হোক। যা কিছু হয়েছে সব কিছুর প্রত্যক্ষ কারণ ও নিজে। কিন্তু কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। চারু কিছু বললেও নাহয় তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলার সুযোগ পেতো ও, কিন্তু ঘুম ভেঙে নিজেকে এই ঘরে দেখার পর থেকে একটা কথাও বলেনি চারু।
এভাবে কিছুটা সময় কাটার পরে চারুর খাবার ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে আসে হোটেলের এক কর্মচারী। বেশ মিষ্টি এই ছেলেটা। পারিজাত ট্রে-টা হাতে নিয়ে দেখে খাবারের পাশে এক গোছা নাম না জানা ফুল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হোটেলের ছেলেটির দিকে তাকালে সে জানায় মেমসাহেবের শরীর খারাপ তাই তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে ওঠার শুভকামনা করে ও হোটেলের বাগান থেকে নিয়ে এসেছে এই ফুলগুলো। হ্যাঁ এমনই হয় পাহাড়ের মানুষগুলো, আন্তরিক, সহজ-সরল। শহুরে জটিলতা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে এদের বাস। নির্মল ভালোবাসার অফুরন্ত চাবিকাঠি নিয়েই এরা আসে পৃথিবীতে, উদার ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় সবার মাঝে এভাবেই। হালকা হেসে ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে খাটের পাশের টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে রাখে পারিজাত। কি মনে হতে ফুলগুলো হাতে তুলে নেয় ও। চারুর পাশে বসে ফুল গুলো ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে ,
-একবার ক্ষমা করবেন চারুলতা ! দুদিনের সব ব্যবহারের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ দেবেন প্লিজ !
মুখ তোলেনা চারু হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো ধরে নেয় শুধু।
আচমকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। এতোক্ষণের সব জমে থাকা অভিমান জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে ওর দু'চোখ বেয়ে। ফুলের পাপড়ির ওপর মুক্তদানার মতো ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়তে থাকে ওর চোখের জল। হতভম্ব হয়ে পারিজাত তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর নির্দ্বিধায় দু'হাতের তালুতে চারুর মুখটা তুলে ধরে সে আলতো করে। দেখে ভ্রমরের মতো চোখের কোলে বর্ষা নেমেছে।
বাইরে তখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে টিপ টিপ করে। আজ ধুয়ে দেবে সব গ্লানি, মুছে দেবে সব অভিমান, বৃষ্টি শেষে হবে নতুন সূচনা।
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবারতি নন্দী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।