..টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্মৃতির পথে হাঁটতে গিয়ে চারু খেয়ালই করেনি কখন আকাশ কালো করে এসেছে।
শুধু কি আকাশ ! আর ওর মন !
-নাহ্ , এবার ফেরার সময় হলো। ছাতা নেই সঙ্গে। ছাতা থাকলে বৃষ্টি এড়িয়ে শরীর ভেজানো আটকানো যায় কিন্তু এই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ওর মন ভিজিয়ে দিয়ে যায় বারবার। ফিরতে বাধ্য করে দিনগুলোয়। আর কেনো নয় ! ওর বিশাল একটা অংশ যে পাহাড়ের ওই দিনগুলোতেই রয়ে গেছে।
....সেদিন যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা গড়িয়েছে অনেকটাই। মাথাটা ভার হয়ে ছিলো বলে মাথা তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলো চারু। জোড় করে ওঠার চেষ্টা করতেই একটা চেনা গলার উদ্বিগ্ন স্বরে চমকে ঘুরে দেখে মাথার কাছের জানলায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে... পারিজাত !
- প্লিজ উঠবেননা। জ্বর এখনো নামেনি।
-আপনি এঘরে কি করছেন !
চমকে উঠে জিঙ্গেস করে চারু। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে যারপরনাই অবাক হয় ও। ঘরটা তো ওর নয়। সে পারিজাতের ঘরে। কিন্তু কেন ! আসতে আসতে উঠে বসার চেষ্টা করতে পারিজাত এসে ওকে ধরে বসিয়ে দেয়, যত্ন করে একটা বালিশ পিঠের কাছে দিয়ে ব্ল্যাংকেটটা বেশ করে গায়ে জড়িয়ে দেয় ও। তখনও চারুর গায়ে ওর জ্যাকেটটা জড়ানো। সেটা দেখে দুজনে দুজনের দিকে চকিতে তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নেয়, অপ্রস্তুত হয়ে সেটা ফেরৎ দিয়ে দেয় চারু পারিজাতকে। রাতের সেই আস্ফালনের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই পারিজাতের চোখ মুখে। কোনো এক মন্ত্রবলে যেন বদলে গেছে সে।
উঠে বসে মনে করার চেষ্টা করে চারু। তারপরে আসতে আসতে মনে পড়ে গত রাতের ঘটনা ওভাবে পারিজাতের তাকে অপমান করা, তারপর নিজেদের রুমে না ঢুকে লনের দোলনায় ঘুমিয়ে পড়া - সব মনে পড়ে। অবাক হয়ে তাকায় ও পারিজাতের দিকে, দেখে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পারিজাত জানলার কাছে। আঙ্গুল দিয়ে জানলার পর্দা নিয়ে কি একটা করছে অস্থির হয়ে। বিড়বিড় করে কিছু যেন বলছে। ওর মনের দোলাচলটা সহজেই অনুমেয়। সেদিকে তাকিয়ে কি যেনো একটা ব্যথায় মুচড়ে ওঠে চারুর মন। কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলো চারু। চারুর উশখুশ করে ওঠার শব্দে চোখ তুলে তাকায় পারিজাত ওর দিকে। চোখদুটোয় এত মায়া ! কোনো পুরুষমানুষের চোখে এত মায়া থাকে কি ! জানেনা চারু। এতো কাছ থেকে কোনো পুরুষকে দেখেনি ও। এ চোখের দিকে বেশিক্ষন তাকানো যায়না। চোখ সরিয়ে নেয় চারু। তাকিয়ে থাকে জানলা দিয়ে দূরে, অনেক দূরে। সেই ঝড়টা ফিরে আসছে আবার।
পারিজাতও কোনো কথা না বলে জানলার বাইরে তাকায়। মনে করে আজ ভোরের ঘটনাগুলো।
..ভোরের আলো ফুটতে গিটারটা তুলে নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়ায় পারিজাত। চারুর সাথে দেখা হলেই কাল রাতের সব জবাব দেবে, জানার খুব কৌতূহল না ওর ! এমন উত্তর দেবে আর ভবিষ্যতে কখনো চোখে চোখ রেখে জোর গলায় প্রশ্ন করার সাহস পাবেনা কারোকে। ত্বড়িত পায়ে ফিরতে ফিরতে সেই পাথরে চোখ আটকে যায় যেটার খাঁজে পা আটকে গতকাল মেয়েটা পড়ে যাচ্ছিলো। চোখাচোখি হতে পারিজাত দেখেছিলো চোখ গুলো কি গভীর ওর। আর সেই তিলটা... মুহুর্তে ঝেড়ে ফেলে চিন্তা গুলো। নাহ, নিজেকে দুর্বল হতে দেওয়া যাবেনা। ঘৃণা করে ও এই মুখটাকে,তীব্র ঘৃণা। পা চালায় আবার হোটেলের দিকে। কি মনে হতে হোটেলে না ঢুকে লনের দিকে যায়। আর গিয়েই থমকে যায় !
... " চারুলতা ! "
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবারতি নন্দী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।