কোনো মতে সারাদিন কাটিয়ে হোটেলে ফিরেই চারুর অনুসন্ধানী চোখ দুটো ওই ছেলেটাকেই খুঁজে চলছিলো। কিন্তু কোথাও তার হদিশ না পেয়ে হতাশই হলো সে। ভাবলো ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে ওদের দলের মধ্যে কারকেই জিজ্ঞেস করে নেবে। সকলেই ঘুরে এসে নিজের মতো ফ্রেশ হওয়ার পর একটা রুমে জোট বেঁধে সারাদিনের ঘোরাঘুরি নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। খানিকক্ষণ পরে ছেলেদের দলের মধ্যে থেকে দুজন এসে বলে তারা ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করেছে হোটেলের লনে ওরাও চাইলে আসতে পারে। সকলেরই বেশ পছন্দ হলো প্রস্তাবটা।
নিচে নামতে নামতে চারুর কানে গেলো গানটা। এত আবেগভরা গলা কার ! ওরই পছন্দের গানটা এত যত্ন নিয়ে কে গাইছে ! তবে কি..
লনে পৌঁছে ওর সন্দেহই সত্যি হলো। সেই ছেলেটাই এক মনে চোখ বুজে গিটার হাতে গাইছে সেই চেনা লাইন- ' সায়াদ ফির ইস জনম মে মুলাকাত হো না হো'...
চোখ বুজে গাওয়ার জন্যই হয়তো চারুদের উপস্থিতি টের পায়নি ছেলেটা। গান শেষে সকলের হাততালির শব্দে চমকে উঠে চোখ মেলে সামনে চারুলতাকে দেখে বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়েই মাথা নিচু করে চলে গেলো নদীর দিকে। পেছন থেকে বন্ধুরা সবাই ডাকলো তাকে - ' আরে কি হলো ! এই পারিজাত, কোথায় চললি ! কিরে !'
আর কিরে ! ততক্ষনে ছেলেটা অনেক দূরে চলে গেছে। যেন হওয়ার গতি। নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে নদীর দিকে গিয়ে দেখলো সেখানে একটা তাঁবু খাটানো হয়েছে।
চারু ভাবে ' এটা কখন হলো !'
নিজেকে দোষারোপ করতে করতে লনে ফিরে পরিজাতের বন্ধুদের কিছু টুকরো কথা কানে এলো ওর।
- 'আর কতদিন এভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখবে সবার থেকে কে জানে ! এখনো ওই ঘটনাটা থেকে এক চুল নড়াতে পারলামনা আমরা। এত চেষ্টা এত পরিকল্পনা সব ব্যর্থ। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রেখে কিকরে বেঁচে আছে কে জানে !'
জিমুত নামের ছেলেটির কথার উত্তরে বাকিরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই বলতে পারলোনা।
কৌতূহলবশে চারু গিয়ে জিজ্ঞেস করে -'উনি চলে গেলেন কেনো ওভাবে ? সকালে ঘুরতেও গেলেন না, ওই তাঁবু কোথা থেকে এলো ! সকালে তো ছিলোনা !'
ওর কথায় জিমুত নদীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে খানিক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে বলে -' এ তো সব শুরু। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে আবার হঠাৎই। ধ্বংস না করে কি থামবে !' একটু চুপ থেকে বললো -' নিজেই ব্যবস্থা করেছে তাঁবুর, ওখানেই থাকবে রাতে। আর এবারে তো এটাই হওয়ার ছিলো'- বলেই চট করে একবার তাকালো চারুর মুখের দিকে। যেনো বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে ও। খানিকটা যেন পালিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতেই বাকিদের কাছে গিয়ে বললো ক্যাম্প ফায়ারটা শুরু করতে।
সবাই ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে মেতে উঠলো হুল্লোড়ে। ছুটি কাটাতে এসে কেই বা মন খারাপ করে থাকতে চায় ! তবে মেতে উঠতে পারলোনা শুধু চারু। কি এক অদ্ভূত রহস্য যেন, 'কি করতে চায় ছেলেটা ! কেন ওকে দেখলেই পালাচ্ছে ও! আর এতো ঠান্ডায় ওই তাঁবুতে রাত কাটাবে ! নিউমোনিয়ায় মরতে চায় নাকি !'
হঠাৎ পেছনে গলা খাঁকারীর শব্দে সম্বিৎ ফেরে ওর। পায়ে পায়ে কখন নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি। পেছন ফিরে দেখে জিমুত দাঁড়িয়েছে কখন এসে। ও ঘুরতে ওকে বললো - ' ওকে ওর মতো ছেড়ে দিন ম্যাডাম। অনেক বড় ক্ষত বুকে চেপে ঘুরছে আর খুঁচিয়ে রক্ত বের করতে যাবেননা।' - বলেই হনহনিয়ে ফিরে গেল চারুকে একগুচ্ছ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে খানিক চেয়ে রইলো জিমুতের যাওয়ার পথের দিকে, তারপর পেছন ঘুরে একবার তাঁবুর দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে ফিরে চললো হোটেলের দিকে। বুকে যেন ঝড় উঠেছে চারুর। কিন্তু কেন ! অচেনা অজানা একটা ছেলে, যার নামটুকুও মাত্র কয়েক মুহুর্ত আগেই জেনেছে তাকে নিয়ে এত ভাবছে কেনো ও ! কি দরকার!
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবারতি নন্দী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।