ধর্ম বড় না কর্ম বড় এই নিয়ে আজ বিকেলে পটল ডাঙার চাটুজ্জেদের রোয়াকে হাবুল আর ক্যাবলার মধ্যে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। বিতর্ক যখন চরমে তখন হঠাৎ ক্যাবলার মাথায় একটা স্বজোরে গাঁট্টা পড়তে ক্যাবলা 'বাবা গো' বলে মাথায় হাত দিয়ে পিছনে ঘুরে দেখে কোমরে হাত দিয়ে টেনিদা দাঁড়িয়ে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ক্যাবলা বলল, এভাবে কেউ আচমকা মারে! টেনিদা হেসে বলল, ওরে ক্যাবলা এটা হলো টেনি মুখুজ্জের ব্যালটে ছাপ দিয়ে তোকে ভোট দান। হাবুল আর তোর বাক্ যুদ্ধে তোকেই নির্বাচিত করলাম।ক্যাবলা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই বলল; তর্ক নয় গো টেনিদা, হাবলাটাকে বোঝাছিলাম যে, স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, পৃথিবীর মানুষকে আমি আমাদের ধর্মের কথা জানাবো। কিন্তু তার আগে আমাদের শিখতে হবে জাগতিক এবং প্রযুক্তি বিজ্ঞান।তবেই আসবে সাফল্য।স্বামীজীর চিন্তা ধারার মডেল ছিল এক দিকে ধর্মের মাধ্যমে প্রাচীন কুসংস্কার দূর করে এক বিশেষ নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা, আর অন্য দিকে ভারতের আর্থিক সংস্কার। স্বামীজীর সঙ্গে জামশেদজির আলোচনাতেও ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যর কথা বলেছেন।শিকাগো বক্তৃতায় তাই স্বামী বিবেকানন্দ বার বার যা বলেছেন তা উপনিষদের কথা! সেখানে বলা হয়েছে এক সত্তার কথা! এক ঈশ্বর। এক আত্মা। অখণ্ড জীবন স্রোত। এরই নাম প্রাক্টিকাল বেদান্ত। এক জীবনচর্যা।আচ্ছা টেনিদা, তোমারও কি মনে হয় ধর্ম সত্যি মানুষের আদৌ কোন উপকারে লাগে ?
দুজনের কথা শোনার পর টেনিদা বলল, ওরে পাগলা কোন মানুষই আসলে ধর্মনিরপেক্ষ নয়, ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী৷ তোদের কথা শুনে হাবিব তনবীরের নাটক ‘মোটেরাম কি সত্যাগ্রহ’-র কথা মনে পড়ে গেল প্রেমচাঁদের কাহিনী নিয়ে হাবিব তনবীরের এই নাটকের সময় কাল স্বাধীনতার আগের বারাণসী। ব্রিটিশ ভাইসরয় আসবেন। গোটা শহর জুড়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা হচ্ছে। রাস্তার দু’ধারে বস্তি, হকার, তাদের কী করে সরানো যাবে? জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সে সব নিয়ে ব্যস্ত। আর এ সবের মদতে চলছে মোটেরামের সত্যাগ্রহ। সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াই। লড়াই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। দেশের জন্য লড়াই! কেলেঙ্কারি! ম্যাজিস্ট্রেট বলছেন, ওকে সত্যাগ্রহ থেকে সরাতেই হবে! তা না হলে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলে যাবে! শেষ পর্যন্ত সত্যাগ্রহ কিন্তু উঠছে না!কিন্তু
যেকোন ধর্ম মানেই কিন্তু হঠকারিতা নয়।তাবলে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা উচিত্ না৷ তবে ভোটের সময় সব দলই ধর্মকে কম বেশী ব্যবহার করে ভোটের বাক্সে সুবিধা করতে চায়৷ অথচ দেখ বলে একটু থেমে টেনিদা পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করল। কানের পাশে দুবার ঘুরিয়ে সামনে পিছনে একবার করে ফু দিয়ে তারপর সেটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল বলিউডের নামকরা খলনায়ক সোনু সুদের নাম তো শুনেছিস। অসহায় মানুষের সেবা করার কাহিনী আজ সবাই জানে।খাবার সংস্থান, বাসস্থান দেওয়া, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, কর্ম সংস্থান, চিকিৎসার খরচ সামলানো, পড়াশোনার খরচ সামলানো— এই তালিকা এখানেই শেষ নয়। লকডাউনের পর থেকেই তোদের এই টেনিদার মতোই খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন এই বলিউডের অভিনেতা। দুর্দিনে স্বার্থহীন ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। অবশ্য দিন দিন আমার সুকর্মের তালিকাও তার থেকে বেশি লম্বা হচ্ছে।
টুইটারে এক নেটাগরিক অভিনেতার কাছে আবদার করেছেন, তাঁকে বিয়ে করিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ মন্ত্র পড়ে দেবেন সোনু সুদ— এমনটাই ইচ্ছে বরের। আর এ অদ্ভূত আবদারের মেনে নিতে কসুর করেননি সোনু সুদ। শুধু তাই নয় সম্প্রতি এই অভিনেতাকে সম্মান জানাতে তেলেঙ্গানার মানুষ তারজন্য তৈরি করলেন এক মন্দির। আর মন্দিরে সোনু সুদের মূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কেরালার সিদ্দিপিট জেলার দুব্বা টান্ডা গ্রামের স্থানীয়রা মন্দিরের উদ্বোধনও করে ফেলেছেন।তোরা জানিস না আমারো কিন্তু এই রকম একটা মূর্তি গড়ার প্রস্তাব এসেছিল যদিও এটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যপার তবুও আমি রাজি হইনি কারন আমার মতে মানুষের সেবা করা মানে ভগবানের সেবা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাই মানুষের পাশে দাঁড়িছি আমি বার বার। টেনিদার কথা শুনে হাবুল আহা ধন্য আমাগো টেনিদা বলে আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখের জল মুছতে লাগলো।আর ঠিক এই সময়ে হঠাৎ ক্যাবলা বলল, 'টেনিদা ঐ দ্যাখো, প্যালা ঝালমুড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, মনে হয় ওর হাতের মোবাইলে ফেসবুক দেখছে !'টেনিদা হাঁক মেরে ডাকলো, 'প্যালা, এই প্যালা, এদিকে আয়'। প্যালা আসতেই তার হাত থেকে ঝাল মুড়ির ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে টেনিদা বলল, 'কিরে, কোথায় ছিলিস? তোর চোখ লাল কেন? রাতে ঘুম হয়নি?'হাবুল পাশ থেকে বলল,মনে হয় গতকাল রাত জাইগা দেওয়াল লিখতাসিল'! প্যালা বলল, আরে না না, আমাদের বাড়ির সামনে যে কোচিং সেন্টারটা খুলেছে, ওখানেই ছাত্র পড়াবো ঠিক করেছি! কাল রাতে তাই অন লাইনে একটু স্টাডি মেটিরিয়াল গুলো দেখছিলাম। আজ সকাল থেকেই বাড়ির সামনে একটার পর একটা রাজনৈতিক দলের প্রচার চলছে আর ওদের চ্যাঁচামেচিতেই দুপুরের ঘুমটাও মাটি হলো'। 'বলিস কিরে' বলে টেনিদা অবশিষ্ট ঝালমুড়ি টুকু গালে ঢেলে, টোঙাটাকে পাকিয়ে সামনের ফুটপাতে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আরে ম্যাট্রিকে এই প্যালা অঙ্কে দু’বার গাড্ডা খেয়েছে।তোরা জানিস তো, প্রত্যেকবার বাবা-ছেলের বয়সের অঙ্ক আসত, আর প্যালা অঙ্ক কষলে দেখা যেত ছেলের বয়স বাবার চেয়ে বেশি। সেবার প্যালা একটা চালাকি করল। অঙ্ক করার পর খাতায় যেখানে বাবা আছে সেটা কেটে ছেলে লিখে দিল আর যেখানে ছেলে আছে সেটা কেটে বাবা করে দিল। তাতেও রক্ষা পেল না, চব্বিশে গিয়ে আটকে গেল। পরের বার সেই একই ধরনের অঙ্ক।সেবার প্যালা লাফাতে লাফাতে পরীক্ষার হল থেকে বেরোল। বাবার বয়স এবার ছেলের চেয়ে বেশি হয়েছে। বাড়ি ফিরতে প্যালার ডাক্তার মেজদা জিজ্ঞাসা করলেন, কত উত্তর হয়েছে? তখন প্যালা বলল, এবার ঠিক আছে। বাবার বয়স বেরিয়েছে ৯৬ আর ছেলের বয়স ৪। ওর মেজদা গম্ভীর হয়ে বলেছিল,পরীক্ষা হয়ে গেলে আমার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করবি। একটা ছাগল আর তোর ব্রেনটা স্ক্যান করে দেখব কোথায় কোথায় মিল আছে।বলে টেনিদা খুবই হাসতে লাগল।প্যালারামের মুখে তখন আষাঢ়ে মেঘের ঘনঘটা।
হাবুল তাই কথাটা ঘোরাতে বলল, আচ্ছা টেনিদা তুমি তো সোনু সুদকে লইয়া এত বড় এক খান বক্তৃতা দিলা কিন্তু তুমি নিজে তো সবসময় আমাদেরই ঝাইড়া এটা সেটা খাও, আজ তোমার আমাগো হককলরে খাওয়ানের পালা। ক্যাবলাও সম্মতির সুরে মাথা নাড়লো। টেনিদা বলল, ঠিক আছে নো পবলেম, এ আর এমন কি ব্যাপার ,চ আজ সবাইকে আমি এগরোল খাওয়াবো। সত্যদার দোকানে গিয়ে চারটে এগরোলের অর্ডার দিল টেনিদা। প্রথম এগরোলটা হতেই সেটা টেনিদা নিয়ে নিলো। টেনিদা পয়সা দেবে তাই, কেউ প্রতিবাদ না করে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো পরের গুলোর জন্য। পরের রোল গুলো যতক্ষণে এলো তখন টেনিদা নিজের রোলটা সাবাড় করে দিয়েছে। প্যালা তার রোলে সবে একটা কামড় দিয়েছে। পরেরটা দিতে যাবে হঠাৎ ছোঁ মেরে টেনিদা বাকিটুকু কেড়ে নিলো। প্যালা করুণ ভাবে বলল, এটা কি হলো টেনিদা? টেনিদা প্যালার রোলে পরপর দুটো কামড় বসিয়ে, রোল ঠাসা মুখ চিবাতে চিবাতে বলল, ব্যাটা পিলে রুগী, কাঁচা জল খেলে অম্বল হয়! বলে কিনা গোটা রোল খাবে! হাবুল পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বাকি রোলটা একসাথে মুখে পুরে দিলো। ক্যাবলা এতক্ষণ হাঁ করে টেনিদার দিকে দেখছিল তাই প্যালার রোলটা শেষ করে তার রোলের বাকিটুকুও টেনিদা উদরস্থ করতে শুরু করলো।
সেটা শেষ করে রোলের কাগজে লেগে থাকা টম্যাটো সস চাটতে চাটতে টেনিদা বলল, 'হাবুল তুই বল, আমি কি খুব বেশি খাই?' হাবুল মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, 'মোটেই না! তুমি তো মিনিমাম খাও, লোকে মিছামিছি তোমার লগে কয় যে তুমি নাকি ম্যাক্সিমাম খাও!' 'যাক তুই অন্তত বুঝলি আমার দুঃখ!' এই বলেই পকেট থেকে একটা কড়কড়ে ২০০০ এর নোট নিয়ে হাবুলকে বলল, যা দামটা মিটিয়ে দে। হাবুল সত্যদাকে নোটটা দিতেই সত্যদা খিস্তি দিয়ে বলল, হারামজাদা ৮০টাকার রোল খেয়ে ২০০০টাকার নোট! টেনিদা বলল, আমার কাছে তো আর খুচরো নেই! আচ্ছা কার্ড চলবে! সত্যদা এবারে আরও রেগে গিয়ে বলল, কার্ড নিয়ে আমি কি তোর পেছনে ঘসবো! টেনিদা তখন হাবুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই দামটা তোরাই আজকে দিয়ে দে আমি নাহয় কালকে টাকা ভাঙিয়ে তোদের আবার খাওয়াব।
( বাংলা সাহিত্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি টেনিদা।আমাদের হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের টেনিদা,প্যালা,ক্যাবলা ও হাবুল এই চারমূর্তির অনুকরণের আমার অক্ষম চেষ্টার জন্য আমি সকলের কাছে একান্ত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। গল্পটাকে আকর্ষণীয় ভাবে তুলে ধরাই ছিল আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। পাঠকের মতামত একান্ত ভাবে কাম্য। )
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবজিৎ কুণ্ডু কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।