প্রখর রূদ্রের অপহরন - দ্বিতীয় পর্ব
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখক : দেবজিৎ কুণ্ডু
দেশ : India ,

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২১ , এপ্রিল
প্রকাশিত ৯ টি লেখনী ১৮ টি দেশ ব্যাপী ২৫১১ জন পড়েছেন।
"পুজোর সংখ্যার বই আজকাল অনেক আগে থেকেই বেরোতে শুরু করে।" লালমোহনবাবু বললেন, "বুঝলে ভাই তপেস, এখন তো ইংরিজি বছর শুরু হতে না হতেই পুজোর উপন্যাসে হাত দিতে হয়। তবে কম্পিউটার আর প্রিন্টারের ব্যাপার স্যাপার অনেকটা এগিয়ে যাওয়ায় ছাপার সময় এখন লাগে কম, সেটুকুই যা ভরসা। তাও মে-জুনের মধ্যে লেখা শেষ করে ফেলতে হয়।"
"তা আপনি তো বললেন আপনার  লেখা হয়ে গেছে "
"সে তো বটেই, অনেক বড় গল্প। প্রখর রুদ্র যাচ্ছেন রাজনৈতিক খুনের তদন্তের কিনারা করতে। গোটা রাস্তা ঢেকে ফেলেছে মেঘ, একপাশে জঙ্গল, অন্যদিকে নদী। সেই রাস্তায় মুখোমুখি মুখোশ ঢাকা জঙ্গিদের সঙ্গে। শেষের দিকটায় সাসপেন্স নিয়ে গিয়ে ফেলছি একেবারে একটা সুড়ঙ্গ ভেতরে। সেই সুড়ঙ্গ ঢুকে গিয়ে মিশেছে একটাই ঘরে। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে খুনি।"
"বাহ, দিব্যি ফেঁদেছেন তো!"
"কীসের আর দিব্যি? গোয়েন্দা নিজেই যে আজ অধবরন হয়ে গেছে।"
"মানে?"
"অধবরন নয় অপহরন। আসলে লালমোহন বাবু বলতে চাইছেন গোয়েন্দা নিজেই অপহৃত হয়েছেন।" বলল ফেলুদা। এতক্ষণ ধরে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফেসবুক দেখছিল। চোখ এখনও মোবাইলেই, তবে কানটা যে এ দিকেই ছিল, তা বুঝলাম।
"প্রবলেমটাতে কিন্তু জম্পেশ ফেঁসেছি, ইউ মাস্ট অ্যাডমিট স্যর! শেষে ওই ইয়েটার কাছে কিনা একটু..."
"সেটাই শুনি না, কী ইয়ে..."
ফেলুদার এই কৌতুহল দেখানোয় জটায়ুর আহ্লাদের সীমা থাকল না। আনন্দের চোটে ‘ডিমটোস্ট’ গুলিয়ে ‘টিমডোস্ট’ চেয়ে বসলেন, তারপর চায়ের পেয়ালায় লম্বা একটা চুমুক দিয়ে যা বললেন, তার সারমর্মটুকু এ রকম: লাল মোহন বাবু ভেবেছিলেন বছরে একটার বেশি গল্প কোন মতেই লিখবেন না, তাতে বাজারে  ওনার গল্পের প্রচুর চাহিদা ও থাকবে।আবার ওনার খাটনিও অনেক কম হবে।এতদিন হচ্ছিলও তাই, গল্পের চাহিদাও ছিল সাথে প্রকাশকদের তাগাদাও ছিল বা বলা ভালো প্রকাশকদের তাগিদ ছিল। আর লাল মোহন বাবুও দিব্যি ওনার দাম বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন।কাল হল মাঝে হঠাৎ লক ডাউন হয়ে। ঘর বন্দী অবস্থায় উনি না পারছিলেন কোনও প্রকাশকদের কাছে যেতে, না পারছিল প্রকাশকরা তার কাছে আসতে।এমতাবস্থায় এক তরুন প্রকাশক অতনু বর্মণ এর সহজ সমাধানের উপায় দেন। উনি লাল মোহন বাবুকে হোয়াটস্যাপে কয়েকটি গল্পের ওয়ান লাইনার পাঠাতে বলেন। বলেন যদি পছন্দ হয় তবে উনি এ্যডভান্স কিছু পেমেন্ট অন লাইনে করে দেবেন।লাল মোহন বাবুও সরল বিশ্বাসে তাকে একটি গল্পের ওয়ান লাইনার পাঠান। ভদ্রলোক লালমোহন বাবুকে যথারীতি দু হাজার টাকা ওন লাইনে প্রেরনও করেন। লাল মোহন বাবুও গল্পটি লিখতে শুরু করেন। এখান পর্যন্ত সবই ঠিকই ছিল। এখন অনেক দিনপর বিধি নিষেধ শিথিল হয়েছে,সামনেই বাংলা নববর্ষ তাই গত মঙ্গলবার লাল মোহন বাবু কলেজস্ট্রিটের বই পাড়াতে পুরোন প্রকাশকদের সাথে দেখা করতে যান। আর ফেরার সময় চির চরিত প্রথা মত নতুন লেখকেদের কি বই বেড়িয়েছে দেখতে যান। ওখানে গিয়ে হঠাৎ একটি বই দেখেন। যার নাম 'প্রখরতার রূদ্ররূপ'।লেখক সমর বসু।নামটিতে ওনার সৃষ্ট চরিত্র গোয়েন্দা প্রখর রূদ্রের সাথে মিল থাকায় স্বাভাবিকভাবেই লালমোহন বাবুকে আকর্ষণ করে। উনি বইটি কিনে যার পরনাই অবাক।হুবহু ওনার গল্পের নায়কেরই প্রতিরূপ। তারপর ওই লেখকের আরো কয়েকটি বই সংগ্রহ করেন।সেখানেও ওনার সৃষ্ট গোয়েন্দা প্রবর প্রখর রূদ্র নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন করছে। অথচ এই  বইটির লেখক লালমোহন বাবু নন এমনকি প্রকাশকও লালমোহন বাবুর অপরিচিত।যাইহোক প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে লালমোহন বাবু লেখক সমর বসুকে ফোন করেন। এক নিশ্বাসে এই পর্যন্ত বলে লাল মোহন বাবু থামেন। বোধহয় তিনি তখন আমার ও ফেলুদার মানষিক অবস্থান অনুধাবনের চেষ্টা করেন। "এখনও বুড়ো হাড়ে তিনি ভেলকি দেখিয়ে যাচ্ছেন এই কলকাতায়। আর সেই কাহিনী বলছেন নতুন প্রজন্মের লেখক, তাই তো?” ফেলুদা জানতে চাইল;
লালমোহন বাবু উপরে নিচে মাথা নাড়েন, তারপর নাক মুখ কুঁচকে জোরদার একখানা হাঁচি দিয়ে বলেন, “বুঝতেই পারছেন, প্রখর রুদ্রের ব্যাটন অন্য কারো হাতে গেছে, এটা আমার প্রথমে ঠিক হজম হয়নি। তাই ওই পাবলিশার্স এর থেকে নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করি লেখকের সঙ্গে। ইচ্ছা ছিল বেশ দু’কথা শুনিয়ে দেব তাঁকে।”
“সর্বনাশ! তারপর?”,  আমি জিজ্ঞাসা করি। লালমোহন বাবু আমার দিকে ফিরে ঠোঁট উল্টে জবাব দেন , “তবে কী জানো তপেশ, যে উদ্দেশ্যে ফোন করলুম, সেটা আদৌ পূরণ হলো না।”
আমি রহস্যের গন্ধ পেয়ে বলে উঠি, “কেন? আদৌ ওই নামের কারো অস্তিত্বই নেই নাকি?”
“আরে দূর, তা থাকবে না কেন? ভদ্রলোক আছেন, বহাল তবিয়তেই আছেন। তবে কড়া করে যেসব কথা বলব ভেবেছিলুম, সেটা আর বলে উঠতে পারলুম না। ভদ্রলোক বড় অমায়িক। এত ভদ্র ভালো..”
লালমোহন বাবুর এই এক সমস্যা। একই অর্থের বিশেষণ বেশ কয়েকটা একসাথে প্রয়োগ না করে তাঁর শান্তি নেই। ফেলুদা মুচকি হেসে বলে, “বুঝতে পারছি, নব্য লেখক পুরানো দিনের লেখককে শ্রদ্ধা ট্রদ্ধা বেশ ভালোই দেখিয়েছেন। তা বেশ ভালো কথা, কিন্তু বইটা নিয়ে এই সাতসকালে আমার কাছে চলে এলেন কেন?”
“আজ্ঞে , পড়াতে।”
ফেলুদা আজকাল ননফিকশন ছাড়া অন্য কিছু পড়ে না। রহস্য রোমাঞ্চ গল্প পড়ার প্রস্তাব শুনেই বিরক্ত হয়ে সোফা থেকে উঠে পড়ার উপক্রম করে। লালমোহন বাবু সেটা দেখেই আরেকবার শেষ চেষ্টা চালান।
“আসলে ফেলুবাবু আমার প্রকাশকরা এই ঘটনার সাথে জড়িত কিনা তাও জানতে আমি বড়ই উদ্গ্রীব আর ওই সমরবাবুও আপনার কীর্তিকাহিনী বিলক্ষণ জানেন। আপনার কল্যাণেই যে আমার বইগুলোয় ভুল ভ্রান্তি শেষের দিকে কমে এসেছিল সেটার খোঁজও রাখেন। তাই তিনি তাঁর বই সম্পর্কে আপনার মতামতটাও জানতে চান। প্রয়োজনে আপনার থেকে তিনি নির্মম সমালোচনা আশা করেন। আমি আসলে সেজন্যেই…”
শ্রীনাথ এমন সময় আর এক প্রস্থ চা  নিয়ে ঢোকে। ফেলুদা বইটা একবার উল্টেপাল্টে দেখে স্পেশাল দার্জিলিং চায়ের কাপটি হাতে তুলে মন্তব্য করে, “হুম, তার মানে এই তরুণ তুর্কীর হয়ে প্রস্তাবটা নিয়ে এসেছেন আপনি। তবে এসব চটকা থ্রিলার আজকাল আর আমার পোষায় না, সেটা তো আপনি ভালো মতোই জানেন, তবু বইটা আমি রাখছি। অন্তত রহস্য রোমাঞ্চের বেস্ট সেলার লেখক জটায়ুকে রাত জেগে একটা বই শেষ করতে হলো কেন, চেষ্টা করেও সে বইয়ের টান উপেক্ষা করা গেল না কেন, সেটা জানতেই বইটা আপনার ভাষায় কালটিভেট করতে হচ্ছেই।”
লালমোহন বাবুর মুখের হাঁ-টা আর বন্ধ হচ্ছে না দেখে ফেলুদা তার মার্কা মারা একপেশে হাসিটা দিয়ে বলে, “চোখ লাল, ঢুলু ঢুলু ভাব। রোজ আট ঘণ্টা ঘুমাতে অভ্যস্ত, যে কোনো রকম নেশা থেকে শত হস্ত দূরে থাকা জটায়ুর সাতসকালে এই অবস্থা দেখে রাতে জেগে থাকার ব্যাপারটা আপনার প্রখর রুদ্রও বুঝে ফেলবে। আর যতদিন বুক মার্ক ইউজ না করে পৃষ্ঠা ভাঁজ করার বদভ্যাসটা ছাড়তে না পারেন, ততদিন কোনও বই পড়েছেন কিনা সেটা জানতে ফরেন্সিক সায়েন্সের প্রয়োজন হবে না।”ফেলুদা বলল "আর একটা কথা,এই নবীন লেখক আপনার প্রখর রূদ্রকে নিয়ে বা টানাটানি করতে গেলেন কেন? ব্যপারটা একটু সরজমিনে ক্ষতিয়ে দেখতে হচ্ছে। আর হ্যাঁ,এই সমর বাবুর ফোন নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান; আশাকরি সন্ধ্যাবেলার মধ্যে পুরো ব্যপারটা আপনাকে পরিষ্কার জানাতে পারবো।"একমুখ হেসে লালমোহন বাবু বললেন "সেই ভালো আজ তো সপ্তপদীতে ডিনারে দেখা হচ্ছেই তখনি না হয়..."
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবজিৎ কুণ্ডু কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 2  China : 2  France : 1  Germany : 5  India : 131  Ireland : 11  Russian Federat : 11  Saudi Arabia : 10  Taiwan : 1  
Ukraine : 8  United States : 150  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 2  China : 2  France : 1  
Germany : 5  India : 131  Ireland : 11  Russian Federat : 11  
Saudi Arabia : 10  Taiwan : 1  Ukraine : 8  United States : 150  
© কিশলয় এবং দেবজিৎ কুণ্ডু কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
প্রখর রূদ্রের অপহরন - দ্বিতীয় পর্ব by Debjit Kundu is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৪১৬৭
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী