হতভাগ্য
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : দীনবন্ধু দাস
দেশ : India ,

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২১ , ফেব্রুয়ারী
প্রকাশিত ১৯ টি লেখনী ২০ টি দেশ ব্যাপী ৪৭৭২ জন পড়েছেন।
Dinabandhu DAS
#আফ্রিকা জঙ্গলের একটি মা গরুর কথা#

আমার এক বন্ধু আফ্রিকা জঙ্গলে ছবি তোলার জন্য গিয়েছিল।  তার মুখ থেকেই শোনা গেল মা গরুর কথা। এবং আমার বন্ধু ভালোবেসে মা গরুটির নাম দিয়েছে সুধা মা। আফ্রিকা জঙ্গলে অনেক গরুর বাস, তবে তাদের মধ্যে সুধা মা একেবারে আলাদা সে যেমন শান্ত তেমনি বুদ্ধিমান এবং অন্য গরুদের প্রতি দয়া মায়া তার হৃদয়ে যেন বাঁধা।তাই বেশিরভাগ গরুই তার কথা শুনে চলে।তারা সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে ঘাস, পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। দিনের শেষে সন্ধ্যা ও ভোরবেলায় নদীতে জল খেতে আসে কারণ তারা জানে সন্ধ্যা ও ভোরবেলায় বাঘ ও সিংহ ভালো ভাবে শিকার করতে পারে না। এবং তারা রৌদ্রের তাপ আবার বৃষ্টির জলে ভিজে নিজেকেই রক্ষা করতে পারে, কিন্তুু বাঘ সিংহের হাত থেকে সব গরু ও রক্ষা পায় না। তাই তারা দিবা রাত্রি ভয় নিয়ে বেঁচে থাকে। আর মনে মনে ভাবে এই বুঝি কার পালা এলো। এই ভাবেই তাদের জীবন কাটে। একদিন সুধা মা গর্ভবতী হলো।এই খবর শুনে সুধা মায়ের গরুর দল আনন্দে একেবারে মেতে উঠলো। সুধা মাকে দলের মধ্যেখানে রাখল।যেন সুধা মায়ের কোন ক্ষতি না হয়।গর্ভবতী হওয়ায় দশ মাসে পরে গেল।তাই সুধা মা খুব কষ্ট করে নদীতে জল খেতে আসত। হঠাৎ একদিন পড়ে গেল সিংহের মুখে, সঙ্গে সঙ্গে গরুর দল এসে সুধা মাকে অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে ফেলে। তারপর একদিন একটা পাহাড়ের গায়ে সুধা মা একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। এবং এই বাচ্চা কে পেয়ে গরুর দল খুশি হলো। তারা সবাই মিলে তাকে ছুটানো শিখালো আর সে সবার চোখের মনি হয়ে উঠলো। সুধা মা সব সময় তাকে চোখের সামনে রাখতো।কারন তার বাচ্চাকে কেউ যেন ক্ষতি না করতে পারে।একদিন গরুর দল যেমন ভাবে নদীতে জল খেতে আসে ঠিক তেমনি সেই দিনও বাচ্চাকে সঙ্গে করে নদীতে জল খেতে এলো। হঠাৎ কয়েকটি সিংহ তারা করলো, এই ভয়ে গরুর দল দুভাগে ভাগ হয়ে গেল, এবং প্রচণ্ড ঝড়, বৃষ্টিও শুরু হওয়ার ফলে  এবং অনেক গরুর ভিড়ে সুধা মা তার বাচ্চা কে হারিয়ে ফেলল। এবং সুধা মা হতভম্ব হয়ে তার দলের সাথে উত্তরের জঙ্গলে চলে গেল। কিন্তুু বাচ্চাটা যেতে পারল না, সে এখানেই পড়ে রইল। সুধা মা ওখানে অনেক খুঁজেও তার বাচ্চাকে পেল না। সে সারাদিন শুধু কাঁদতে লাগলো।তারপর দলের একটা গরু এসে সুধা মাকে বলল,কিছু ঘাস খাও  না হলে যে তোমার শরীর খারাপ হবে।

তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়লে,তোমাকে তো বাঘে খেয়ে ফেলবে।এই কথা শুনে সুধা মা চিৎকার করে বলল খেয়ে ফেলুক আমাকে বাঘে,আমি আর বাঁচতে চাই না। যে তার নিজের বাচ্চা কে আগলে রাখতে পারে না,তার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। এই বলে সে আবার কাঁদতে শুরু করলো।দলের গরুটি আবার সুধা মাকে বলল তুমি যদি মারা যাও তবে তোমার বাচ্চাকে কে আদর করবে,কে তাকে দুধ খাওয়াবে। সুধা মা বলল তাকে কি আর খুঁজে পাব, সে কি আর বেঁচে আছে এবং তাকে কি আর কোনদিন দেখতে পাব আমি। দলের গরুটি আবার বলল তুমি চুপ করো।সে আমাদের চোখের মনি সে নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবে।আমরা তার সাথে আবার খেলতে পারব।আমরা সবাই ইশ্বরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছি তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তুমি দেখবে ইশ্বর তার কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি। এই ঘাস খেতে খেতে ঠিক একদিন ওখানে চলে যাব। তুমি আর কেঁদো না। অন্য দিকে ছোট্ট বাচ্চাটি যখন অনেক খুঁজেও তার মাকে পেল না,তখন সে খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।তবুও সে তার মায়ের খোঁজ পেল না। সে একেবারে জন্য একা হয়ে গেল। সে তখনও মায়ের দুধ খেত। তাই সে ক্ষুধার্ত হয়ে অন্য মা গরুর দুধ খেতে গেল, কিন্তুু সেই মা গরুটি তাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল আর বলল তুমি আমার বাচ্চা নও।তাই তোমাকে আমি দুধ দেব না।এই বলে অন্য দিকে পালিয়ে গেল।সে আবারও ছুটে গেল অন্য গরুর দলের কাছে কিন্তুু তারা কেউ তাকে সঙ্গে নিল না। সে আবার হতাশ হয়ে ফিরে এলো তার নিজের জায়গায়। সে ক্ষুধার জালায় ঘাস খেতে গেল কিন্তুু খেতে পারল  না কারণ সে তখন ঘাস খেতে শেখেনি। সে আবারও এদিক ওদিক তাকালো কিন্তুু তাও তার মাকে দেখতে পেল না। সে জল ভরা চোখে চারিদিক ছুটে বেড়াতে লাগল। দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়লো এবং আস্তে আস্তে রোগা হয়ে গেল। এইভাবে তিন দিন কেটে গেল। সে একদিন নদীতে জল খেতে এসে দেখতে পেল তার মায়ের মতো একজন দাঁড়িয়ে আছে,সে ছুটে গিয়ে বলল মা মা আমাকে একটু দুধ খেতে দাও।আমি অনেক দিন কিছু খাইনি তুমি যদি আর কিছু দিন পর আসতে,তাহলে আমি মরেই যেতাম। এই বলে তার দুধ খেতে গেল, ঠিক তখনই সেই মা গরুটা লাথি মেরে চলে গেল। এভাবেই তার কষ্টে দিন কাটতে লাগলো। বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়ার ফলে তার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগে গেল। এবং আরো ক্লান্ত হয়ে পড়লো,তাও সে আশা ছাড়েনি। অন্য মা গরু দেখলেই ছুটে যায় আর হতাশ হয়ে পাহাড়ের গায়ে ফিরে আসে। কিন্তুু একদিন বাচ্চাটা আর চলতে পারল না,সে ক্লান্ত হয়ে ঘাসের মধ্যে শুয়ে পড়ল। আর ঈশ্বর কে ডাকতে লাগলো, আমি মারা যাওয়ার আগে যেন আমার মাকে আমার কাছে এক বারের জন্যও ফিরিয়ে দেয়। আমি মারা যাওয়ার আগে যেন আমার মায়ের মুখ টি দেখে যেতে পারি। হঠাৎ তার কাছে একটি বাঘিনী গর্জন করে এলো আর বলল একটা শিকার পেয়েছি খুব বড়ো নয় তবে আমার বচ্চাদের জন্য ঠিক আছে। বাঘিনী মনে মনে ভাবল কি ব্যপার আমাকে দেখেও গরুর বাচ্চাটা পালাচ্ছে না কেন। সে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। অনেকক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারল যে সে একটা মা হারা এবং না খেতে পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় এক মনে ডাকছে তার মা-কে। 

এই দেখে বাঘিনী তার নিজের বাচ্চাদের কথা অনুসরণ করল আর হৃদয় কাঁপার কষ্টে সে গর্জন করে অন্য পশুদের বলল এই বাচ্চাকে কেউ যদি ক্ষতি করার চেষ্টা করো তবে  সেই পশুকে আমার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।এই বলে সে একটু দূরে দাঁড়ালো অন্যদিকে সুধা মা কোনো বাচ্চা গরু দেখলেই ছুটে গিয়ে গায়ে ও মাথায় চাটতে লাগে কিন্তু অবশেষে যার বাচ্চা তার কাছেই ফিরে যায় এই নিয়ে সুধা মায়ের দুঃখে জীবন কাটে।
হঠাৎ একদিন তার বাচ্চার মতো দেখতে একটি বাচ্চা ছুটে এলো সুধা মায়ের কাছে। সুধা মা তাকে অনেকক্ষণ দেখলো আর বুঝতেও পারল এটাও আমার বাচ্চা নয়।তাই সুধা মা অন্য দিকে যেতে গেল তখন সেই বাচ্চাটি সুধা মাকে বলল আমাকে একটু দুধ খেতে দেবে, আমি অনেক দিন খাইনি এই কথা শুনে সুধা মায়ের বুকটা কেঁপে উঠল আর নিজের বাচ্চার মুখটা তার মধ্যে দেখতে পেল আর তখন সেই বাচ্চাটিকে দুধ খাইয়ে বেশ শক্তিশালী করে তুলল এবং তাকে কাছে কাছেই রাখল। কিন্তু সুধা মায়ের মন পড়ে  আছে তার নিজের বাচ্চার পানে সে আসতে চাইলে দলের গরুরা তাকে একলা ছাড়তে চায় না। একদিন সুধা মায়ের গরুর দল বেরিয়ে পরল এখানে আসার উদ্দেশ্যে। তখন প্রায় বাচ্চাটা মারা যাওয়ার অবস্থায়। মাথার উপর চিল শকুনে চিৎকার করে বলছে তুই মারা গেলেই তোর দেহটাকে মনের আনন্দে খুবলে খাব পেট ভরে। এমন সময় সুধা মা তার বাচ্চাটির সামনে এদিক - ওদিক পাগলের মত তার বাচ্চাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ বাচ্চাটি তার মাকে দেখতে পেল এবং সে মনে মনে ভাবল আমি কি ভুল দেখছি নাকি, ওটা কি আমার মা?সে বার বার জিভ দিয়ে চোখটা মুচছে আর দেখছে আর ভাবছে আবার অন্য মা গরুর মত লাথি দেবে না তো। তারপর সে আর অপেক্ষা করতে পারল না ভাবল লাথি খায় খাব তবুও আমি যাব।এই ভেবে সে বার বার উঠে দাঁড়াচ্ছে আর মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সুধা মায়ের চোখে পরলো সে ছুটে এসে তার বাচ্চার সারা শরীরে চাটতে লাগল আর বাচ্চাটাও তার মায়ের মুখে বারবার চাটতে লাগল এবং দুজনেরই আনন্দের চোখের জল গড়িয়ে পরলো।তারপর পেট ভরে মায়ের দুধ খেয়ে একটু শক্তিশালী হলো। কিছু দিনের মধ্যে সে ঘাসও খেতে শিখলো তারপর সে মায়ের আদর যত্নে অনেকটাই বড়ো হয়ে উঠলো।সে একদিন সুধা মাকে বলল মা আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে না তো?

মা একটু হেসে বলল না বাবা তোকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না।তবে তুমি তাড়াতাড়ি বড়ো হও আর শক্তিশালী হও। এই মা কি আর সারাজীবন বেঁচে থাকবে একদিন তো তোমাকে ছেড়ে যেতেই হবে এই কথা শুনে বাচ্চাটি বলল এই কথা যদি তুমি আর একবার বলো তবে তোমার সাথে আর কথা বলবো না।সুধা মা আবারও হেসে বলল না না আর বলবো না। এই ভাবে কেটে গেল কয়েক মাস। তারপর একদিন বাচ্চাটি মা কে বলল মা আমি নদীতে জল খেতে যাব ? সুধা মা বলল পারবি তো একা যেতে সে বলল হ্যাঁ মা আমি পারবো। নদী থেকে জল খেয়ে ফেরার পথে সিংহের সামনে পড়লো  আর সিংহও তার পিছু পিছু ছুটতে লাগল। হঠাৎ বাচ্চাটা মাটিতে পড়ে যেতেই সিংহ তার থাবা বসাবে ঠিক এমন সময় সুধা মা ছেলেকে বাঁচাতে সিংহের সামনে চলে আসে এবং সুধা মায়ের মৃত্যু হয়। বাচ্চাটি আবারও সারাজীবনের জন্য একা হয়ে গেল।।।।
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দীনবন্ধু দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 3  China : 2  Germany : 2  India : 65  Ireland : 10  Mongolia : 1  Russian Federat : 4  Saudi Arabia : 6  Ukraine : 3  United States : 117  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 3  China : 2  Germany : 2  India : 65  
Ireland : 10  Mongolia : 1  Russian Federat : 4  Saudi Arabia : 6  
Ukraine : 3  United States : 117  
লেখক পরিচিতি -
                          দীনবন্ধু দাস পূর্ব বর্ধমান জেলার রামপুর গ্রামে ১০ই মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন।

বর্তমানে উনি বাংলায় স্নাতক বিভাগে পাঠরত। উনি ওনার ঠাকুরদা 'শ্রী হারাধন দাস' এর কাছে সাহিত্যচর্চার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। 

এসবের পাশাপাশি বাগান তৈরি করা এবং গান-আঁকার প্রতি তার শখ আছে। 
                          
© কিশলয় এবং দীনবন্ধু দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
হতভাগ্য by Dinabandhu DAS is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪১২১১
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী