চড়ক গাজন ও চৈত্র মহাসংক্রান্তি (সমাপ্তি পর্ব)
তথ্য সংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
চড়ক পুজো ভারত-বাংলাদেশের গ্রামীণ বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। বৈশাখের প্রথম দিকের বেশ কয়েক দিন ধরে চলে পুজো উপলক্ষে নানা উৎসব।
চড়ককে পৌরাণিক উৎসব না বলে লোকোৎসব বলাই ভালো, কারণ লিঙ্গপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতো পুরাণগুলোতে চৈত্র মাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদির উল্লেখ থাকলেও চড়ক পুজোর কোনও উল্লেখ নেই। এমনকী পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ এবং রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্ব’-তেও চড়কের উল্লেখ মেলে না। এই পুজো মালদায় ‘গম্ভীরা পুজো’, দিনাজপুরে ‘গমীরা পুজো’ নামেও পরিচিত।
চড়ক পুজো কবে কী ভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। জনশ্রুতি, ১৪৮৫ সালে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। রাজপরিবারের লোকজন এই পুজো আরম্ভ করলেও চড়ক পুজো কখনও রাজ-রাজড়াদের পুজো ছিল না। শোনা যায়, পাশুপত নামক এক শৈব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
শিবের গাজন এই চড়ক পুজোরই রকমফের। কেউ কেউ বলেন, শিবের গাজনের উৎপত্তি নাকি ধর্মঠাকুরের গাজন থেকে। মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানা পুজোর আয়োজন করা হয়। ‘ফলপুজো’, ‘কাদাপুজো’, ‘নীলপুজো’-সহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পুজো শেষে আয়োজন করা হয়। ধর্মমঙ্গলে বলা হয়েছে, রানি রঞ্জাবতী ধর্মঠাকুরকে সন্তুষ্ট করতে গাজন উদ্যাপন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন গাজনে বৌদ্ধ প্রভাব রয়েছে। এটি মূলত হিন্দু উৎসব হলেও কোথাও কোথাও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরও অংশগ্রহণ দেখা যায়। যেমন, হাওড়ার পীর জঙ্গল বিলাসের দরগায় শিবের গাজন হয়ে থাকে।
পুজোর সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের কথিত নিচু সম্প্রদায়ের লোক। তাই এই পুজোয় এখনও কোনও ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়ে না। তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব কম। চড়ক পুজোয় সাধারণত গ্রামে একজন ‘মূল সন্ন্যাসী’ থাকেন যিনি বাকিদের পরিচালনা করেন। গ্রামের যে কেউ এই ‘বিশেষ সন্ন্যাসী’ হতে পারেন। তবে সন্ন্যাসী হওয়ার জন্যে এক মাস ব্যাপী উপবাস, ফলাহার, হবিষ্যি করার মতো কঠিন নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। তবে কালের গতিতে আজ এই নিয়ম এখন অনেকটাই শিথিল। এখন শুধুমাত্র এক মাস বা এক সপ্তাহ নিরামিষ আহারের মাধ্যমে সন্ন্যাস পালন করেন সন্ন্যাসীরা।
মাসব্যাপী উপবাস এবং নানা প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয় এই উৎসবে, হিন্দু ধর্মে যাকে বলে ‘কৃচ্ছ্র সাধনা’। উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। এই দলে দু’জনকে শিব এবং গৌরী সাজতেও দেখা যায়। মাঝে মাঝে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, অসুর এমনকী দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহ সাজতেও দেখা যায়। শিবের ভক্তিমূলক গানের সঙ্গে চলে নাচাগানা। মেয়েদের পায়ে বাঁধা থাকে ঘুঙুর। সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসর-সহ একদল বাদক। মেয়েরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে স্থানীয় ভাষায় কেউ কেউ ‘নীল পাগলের দল’ও বলে থাকেন।
পশ্চিমবঙ্গের যে অঞ্চলগুলি মূলত কৃষিপ্রধান, সেখানেই চড়ক পুজো উত্সব হিসেবে পালিত হয়। কৃষিপ্রধান এলাকায় সাধারণত ‘চড়ক গাছ’ নামে একটি বিশেষ গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই চড়ক গাছটি সারা বছর গ্রামের মধ্যে একটি পুকুরে ডোবানো থাকে। গাজনের দিন ওই গাছটিকে সেখান থেকে তুলে এনে পরিষ্কার করে মাটিতে স্থাপন করা হয়। গাছটিকে ‘শিবের প্রতীক’ মনে করা হয় যেখানে ভূমি হল ‘পার্বতীর প্রতীক’। সে কারণে শিবের গাজন শিব আর পার্বতীর মিলনের উৎসব। কৃষকরা এই শিবের গাজন উৎসবকে নিজেদের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্যে পালন হয়। একটি জলভর্তি পাত্রে শিবের প্রতীক ‘শিবলিঙ্গ’ অথবা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা বা ‘শিবের পাটা’ রাখা হয়, যা পুজোরিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত।
চড়ক পুজোর শুরুতে ‘শিবপাঁচালি’ থেকে মন্ত্র পড়া শুরু করেন সন্ন্যাসীরা। শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান সন্ন্যাসীরা। স্নান শেষ করে মাটির কলসী ভরে জল আনেন সন্ন্যাসীরা। এর পর চড়ক গাছের কাছে গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন সন্ন্যাসীরা। তাঁরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান একটি ফাঁকা জায়গায়। সেখানে তাদের পাঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের নানা অংশে বান-শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনও কখনও জ্বলন্ত লোহার শলাকা তাদের গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়।
তার পর তাদেরকে চড়ক গাছে একটি চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। সন্ন্যাসীদের আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশুসন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন। এক অদ্ভুত উন্মাদনা। এ অবস্থায় এক হাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘোরাতে থাকেন সন্ন্যাসীরা, আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশে বাতাসা ছোড়েন ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। তাঁদের বিশ্বাস, শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় তাঁরা এই কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন। সন্ন্যাসীদের একটাই আশা, শিব ঠাকুর তাঁদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
কারও মতে, পরম শিবভক্ত বাণরাজা যুদ্ধ করেছিলেন দ্বারকার অধিপতি তথা বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর অমরত্ব পাওয়ার আশায় তিনি চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুচরদের নিয়ে নাচে-গানে আত্মহারা হয়ে নিজের শরীরের রক্ত বের করে সমর্পণ করেন শিবের উদ্দেশে। সেই ঘটনার স্মৃতিতেই বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণাকে ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। জনশ্রুতি, সে সময় ঋণে জর্জরিত কৃষকদের ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে চৈত্রের শেষ দিনে বড়শিতে বেঁধে চড়কে ঘোরানো হত, যা ১৮৯০ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
রচনাকাল : ১৪/৪/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।