চড়ক গাজন ও চৈত্র মহাসংক্রান্তি (দ্বিতীয় পর্ব)
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখক : লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
দেশ : India , শহর : New Delhi

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , সেপ্টেম্বর
প্রকাশিত ৯৩৫ টি লেখনী ৭২ টি দেশ ব্যাপী ২৬৭৮১১ জন পড়েছেন।
Lakshman Bhandary
চড়ক গাজন ও চৈত্র মহাসংক্রান্তি (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্য সংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শহুরে জ্যাম জটের মধ্যে দিয়ে যখন হঠাৎ করে মন কিছুটা ছুটির সন্ধান করে, তখন গ্রামবাংলার বেশ কিছু উৎসব-পার্বণ কিন্তু আমাদের সেই সন্ধানী মনকে তৃপ্তি দেয়। পৌষ-পার্বণ বা নবান্ন নয়, গ্রামবাংলায় চড়ক, গাজন পুজোর মেলাও সমানভাবে জনপ্রিয়। তবে স্থানভেদে এগুলোর কিছু পার্থক্য দেখা যায়। তা কীভাবে এল এই চড়ক ও গাজনের উৎসব? কেনই বা মানুষজন এই উৎসব দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন একটু আনন্দ পাবার আশায়! সেই সমস্ত কথায় আজকে তুলে ধরব।

গ্রাম বাংলার একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উৎসব হল গাজন। প্রধানত শিব, মনসা এবং ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে এই উৎসব পালন করা হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এবং আষাঢ় মাসে ধর্মের গাজন উৎসব পালিত হয়। তবে চৈত্র মাসে যে গাজন উৎসব পালিত হয়, তার মূল অংশ হল শিবের উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ ধরে বেশ কিছু মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ করে এই গাজন উৎসব পালন করে। আর এটি শেষ হয় চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক পুজোর পরে। স্থানভেদে এই গাজনের বিভিন্ন নাম রয়েছে, যেমন- মালদহে গাজনের নাম ‘গম্ভীরা’; জলপাইগুড়িতে ‘গমীরা’ ইত্যাদি। চৈত্র মাস ছাড়া যদি অন্য সময়ে শিবের গাজন উৎসবটি পালন করা হয় তবে তার একটি অদ্ভুত নাম আছে, তাকে ‘হুজুগে গাজন’ বলে ডাকা হয়। গাজন উৎসব তিনদিন ধরে চলে এবং এই উৎসবের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম মেলাও বসে।

গাজন উৎসবের কিছু অজানা তথ্য:-
গাজন উৎসব মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত। ঘাট- সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক। প্রথা মেনে দীর্ঘদিন উপবাসের পর প্রথমে শিবের পুজোর ফুল সংগ্রহ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গকে মাথায় করে ঢাক-ঢোল, কাঁসর বাজিয়ে পরিক্রমায় বের হয় ভক্ত সন্ন্যাসীরা। গাজনের ভক্তরা তাদের শরীরের বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছসাধন করে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা শোভাযাত্রা সহকারে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

অঞ্চলভেদে গাজনের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন- মুখোশ নৃত্য, সংসাজা, শিব ও গৌরীর বেশ ধারণ, দৈত্য-দানব সেজে নৃত্য করে প্রভৃতি সবকিছুরই প্রচলন রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন লৌকিক ছড়া এবং আবৃত গানের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান চলতে থাকে। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা মড়া খেলা, যা কালিকা পাতারি নাচ নামে পরিচিত। জ্যৈষ্ঠ মাসে পালিত হওয়া মনসার গাজনে মহিলার সন্ন্যাসীরা অংশ নেন। কালী সেজে মুখোশ পরে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। পৌরাণিক নানা চরিত্রের বেশ ধরে শরীরের নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এই উৎসব পালন করা হয়।

গাজন উৎসব পালন করার স্থান:-
• মালদহ
• জলপাইগুড়ি
• নদীয়া
• বর্ধমান
• পুরুলিয়া
• বাঁকুড়া

• বীরভূম প্রভৃতি জেলায় এই উৎসব পালন করতে দেখতে পাওয়া যায়।
• এছাড়াও বাংলাদেশেও গাজন উৎসব পালন করা হয়।
চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম দু-তিন দিন চলে এই চড়ক মেলা। এটি চড়ক সংক্রান্তির মেলা হিসেবেও পরিচিত। পূর্বে পশুপত সম্প্রদায়রা এই উৎসব পালন করতেন। কথিত আছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। তবে রাজবাড়ির থেকে এই পুজোর প্রচলন হলেও রাজা-রাজাদের এই পুজোয় খুব একটা বেশি অংশীদারী ছিল না। তাই এই পুজোর কখনও কোনও ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়নি। চড়ক পুজোর অপর নাম নীলপুজো। এই পুজোর মূল উদ্দেশ্য হল ভূত-প্রেত এবং পুনর্জন্মবাদ-এর উপর বিশ্বাস। চৈত্র সংক্রান্তি ৭ দিন আগে দুধ, মধু, ঘি, তেল দিয়ে শিবকে স্নান করানো হয় এবং সেটি নিয়ে গ্রামে গ্রামে বেরিয়ে পড়া হয়। এই পুজোর জন্য পুজোর আগের দিন চড়কগাছটিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। এরপর একটি জলভরা পাত্রে শিবের প্রতীকী রেখে সিঁদুর মাখা লম্বা কাঠের তক্তা (শিবের পাটা ) রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। ফুল, ফল ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় এই চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা শিবকে প্রণাম জানান।

চড়ক পূজার বিশেষ অনুষ্ঠান:
চড়ক পুজোর অঙ্গ হল- কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা ও চুরির উপর লাফানো, বানফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নি নৃত্য, চড়কগাছে দোলা, দানো-বারানো পুজো। চড়ক গাছে ভক্ত- সন্ন্যাসীদের লোহার হুরকো দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তাদের মতে বিভিন্ন তন্ত্র- মন্ত্রের মাধ্যমে এই বর্শি বিধানো হয়, যার ফলে এই সমস্ত কাজ কর্মের সঙ্গে লিপ্ত থাকা কোন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এছাড়াও পিঠে, হাতে, পায়ে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে শলাকা বিদ্ধ করা হয়। চড়ক পুজোর কিছুদিন আগের থেকে সন্ন্যাসীরা ব্রত ও সংযম পালন করে। গিরি সন্ন্যাস, হাজরা পুজো, বাবর সন্ন্যাস, নীলচণ্ডীকার ইত্যাদি নানা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে চড়ক পুজো পালন করা হয়।

শিবের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের জন্য এই সমস্ত সন্ন্যাসীরা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ছাপ দেন। জ্বলন্ত শলাকা গায়ের ধারণ করে। ৪/৫ ইঞ্চি একটি লৌহ শলাকা সারাদিন জিভে গেঁথে রেখে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেয় ( বান সন্ন্যাস )।এই সমস্ত প্রথার মাধ্যমে এই চড়ক পুজো সম্পন্ন করা হয়। পিঠের দুইদিকে চামড়া ভেদ করে শরীরে বেত ঢুকিয়ে ‘বেত্র সন্ন্যাস’ পালন করা হয়। মাঠের মাঝখানে চড়কগাছটি স্থাপন করা এবং সেই কাজটিকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠখন্ড বেঁধে তাতে সন্ন্যাসীরা বনবন শুন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। ভক্তরা প্রবল বেগে ঘুরতে থাকায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যায় এবং একে দেবতার ভর ওঠা বলা হয়।

রচনাকাল : ১৪/৪/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  Europe : 1  Germany : 3  India : 71  Romania : 1  Russian Federat : 2  Serbia : 1  Ukraine : 4  United States : 106  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  Europe : 1  Germany : 3  India : 71  
Romania : 1  Russian Federat : 2  Serbia : 1  Ukraine : 4  
United States : 106  
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
চড়ক গাজন ও চৈত্র মহাসংক্রান্তি (দ্বিতীয় পর্ব) by Lakshman Bhandary is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৩৯৬৭৫
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী