চৈত্র সংক্রান্তি চড়কমেলা ধার্মিক লোক-গাথা (প্রথম অধ্যায়)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডা্রী
চড়ক পূজা বিশেষত বাংলার বিখ্যাত লোক-উত্সব। চৈত্রের শেষ দিনে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উত্সব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহত্ ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উত্স বের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না।পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ এবং রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্বে’ চড়কের উল্লেখ মেলে না। লোক-গবেষকদের কাছ থেকে জানা যায়, পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে চড়ক উত্স ব প্রচলিত ছিল। তবে চড়ক পূজা সঠিক কবে থেকে এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি।‘চড়ক’ বা ‘শিবের গাজন’ বা ‘নীল পূজা’ এক এক জায়গায় এক এক নামে পরিচিত। যেমন, চড়ক পূজার নাম মালদহে ‘গম্ভীরা’ বা দিনাজপুরে ‘গমীরা’।
ইতিহাস ঘেঁটে কেউকেউ জানিয়েছেন, শিবের গাজনের উৎপত্তি নাকি ধর্মঠাকুরের গাজন থেকে। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই চড়ক-পূজার প্রথম প্রচলন করেন। রাজ পরিবারের লোকজন এই পূজা আরম্ভ করলেও চড়কপূজা কোনোদিনই রাজ-রাজড়াদের পূজা ছিল না। চড়ক হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতির অঙ্গ মাত্র বলা। আসলে এই পূজার সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের লোক। তাই চড়ক পূজায় কোনও ব্রাহ্মনের প্রয়োজন পড়ে না।মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানান পূজার আয়োজন করা হয়।
‘ফলপূজা’, ‘কাদাপূজা’, ‘নীলপূজা’সহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পূজা শেষে আয়োজন করা হয় চড়ক পূজার। এই চড়ক পূজায় সাধারণত গ্রামে একজন ‘মূল সন্ন্যাসী’ থাকেন যিনি বাকিদের পরিচালনা করেন। গ্রামের যেকেউ এই ‘বিশেষ সন্ন্যাস’ নিতে পারেন। তবে সন্ন্যাস নেওয়ার জন্যে এক মাস উপবাস, ফলাহার, হবিষ্যির মতো কঠিন নিয়মের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। তবে কালের গতিতে আজ এই নিয়ম এখন অনেকটাই শিথিল। এখন শুধুমাত্র একমাস বা একসপ্তাহ নিরামিষ আহারের মাধ্যমে সন্ন্যাস পালন করেন সন্ন্যাসীরা।
মাসব্যাপী উপবাস এবং নানা প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয় এই উৎসবে, হিন্দু ধর্মে যাকে বলে ‘কৃচ্ছ সাধনা’। উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান। দলে থাকেন একজন শিব এবং গৌরী। মাঝে মাঝে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণপতি, অসুর এবং দুর্গার বাহন সিংহকেও দেখা যায়।শিব ভক্তিমূলক গানের সঙ্গে চলে নাচাগানা।সখীদের পায়ে বাঁধা থাকে ঘুঙুর।সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ একদল বাদক।সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে।এদেরকে স্থানীয় ভাষায় কেউকেউ ‘নীল পাগলের দল’ও বলে থাকেন।
চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে একটি চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তাঁর পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ-শলাকা বিদ্ধ করা হয়। লোকবিশ্বাস, তন্ত্রশক্তির সাহায্যে নানান অসাধ্য সাধন করা হয় এই চড়ক পূজার সময়। চড়ক পূজায় ঈশ্বরের ভর করা, কাঁচের ওপর দিয়ে হাঁটা, জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটা, হাতে অস্ত্র দিয়ে কোপানো, ধারাল অস্ত্রের ওপর দাঁড়ানো ইত্যাদি নানান কেরামতি চলতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এসব এখনও প্রচলিত। চড়ক পূজার অরেক নাম ‘নীল পূজা’ বা ‘নীল ষষ্ঠী’।
গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন পালিত হয়। আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। যাতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক ‘শিবলিঙ্গ’ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে 'বুড়োশিব' নামে পরিচিত। চড়ক পূজার শুরুতে ‘শিবপাঁচালী’ থেকে মন্ত্রপড়া শুরু করেন সন্ন্যাসীরা। শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান সন্ন্যাসীরা। স্নান শেষ করে মাটির কলসী ভরে জল আনেন সন্ন্যাসীরা। এরপর চড়ক গাছের কাছে গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন সন্ন্যাসীরা। তাঁরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান একটি ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন।সন্ন্যাসীদের আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন।
এক অদ্ভুত উন্মাদনা। এঅবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘোরাতে থাকেন সন্ন্যাসীরা, আর অন্যহাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছোঁড়েন ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। তাঁদের বিশ্বাস, শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় তাঁরা এই কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন। সন্ন্যাসীদের একটাই আশা শিবঠাকুর তাঁদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন। পতিত বা অন্ত্যজ শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা এই পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ কয়েকটি অঙ্গ রয়েছে যেগুলি হল, কুমীর পূজা, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা করা। এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর এক দৃঢ় বিশ্বাস। কেউকেউ বলেন চড়কের বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের এক অন্যরূপ। পূজার উত্সাবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণাকে ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের যে অঞ্চলগুলি মূলত কৃষিপ্রধান, সেখানেই চড়কপূজা উত্সকব হিসেবে পালিত হয়।কৃষিপ্রধান এলাকায় সাধারণত ‘চড়ক গাছ’ নামে একটি বিশেষ গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই চড়ক গাছটি সারা বছর গ্রামের মধ্যে একটি পুকুরে ডোবানো থাকে। গাজনের দিন ওই গাছটিকে সেখান থেকে তুলে এনে মাটিতে স্থাপন করা হয়। গাছটিকে ‘শিবের প্রতীক’ মনে করা হয় যেখনে ভূমি হলো ‘পার্বতীর প্রতীক’।
সেকারণে শিবের গাজন শিব আর পার্বতীর মিলনের উৎসব। কৃষকরা এই শিবের গাজন উৎসবকে নিজেদের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্যে পালন হয়।
রচনাকাল : ১৩/৪/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।