ভাগ্যলিপি
আনুমানিক পঠন সময় : ১০ মিনিট

লেখিকা : যুথিকা দেবনাথ
দেশ : India , শহর : মালদা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , মে
প্রকাশিত ৩৮ টি লেখনী ৩৩ টি দেশ ব্যাপী ১৯৫২৬ জন পড়েছেন।
Juthika Debnath
             

ডাক্তারবাবু ,আমাকে বাঁচান,আমি বাঁচতে চাই। ক্রিকেট আমার জীবনের স্বপ্ন,আমি ইডেনের মাঠে নামতে চাই। ছক্কা,চারে রানের সর্বোচ্চ স্কোরে আমার স্বপ্নের ঝুলি পূরণ করতে চাই। ছেলেটির যন্ত্রণাময় শরীর ও কাতর চোখের একরাশ স্বপ্ন দেখার আকুতি ডাক্তারবাবু বোধ হয় এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তাঁর বুকের আগুনটা যেন দপ করে জ্বলে উঠে মূহুর্তে সারা শরীরটা অবসন্ন করে দিল, কিন্তু ডাক্তারি যাঁর পেশা তাঁর তো কাতর হলে চলে না।কত মুমুর্ষ রোগীকে তাঁদের সেবা করতে হয়।কখনও তাঁরা জিতে যান, আবার কখনও হারেন। তাই কষ্ট হলেও চোয়ালটা শক্ত করে ছেলেটিকে আশ্বাস দিলেন-তুমি ভালো হয়ে যাবে। সুস্থ্ হয়ে আবার ক্রিকেট খেলাটা শুরু করতে পারবে। তুমি তো লড়াকু ছেলে। জীবনের সাথে লড়াই করে তুমি তোমার স্বপ্নের ঝুলি পূরণ করতে পারবে।এই বলতে বলতে ছেলেটির উত্তেজনা কমাতে একটি ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ছেলেটির মা,বাবাও তাঁদের বুকফাটা কান্না ভিতরে দমিয়ে লুকিয়ে রেখে হাসপাতালের একটি কোনে অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
           ফিরে আসি ২৫বছর আগের সেই দিনটিতে, যেদিন অজয় এবং সুজাতার বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধাম করে। প্রথমে আলাপচারিতা, তারপর প্রেম এবং প্রেম থেকে সম্পর্ক,তারপর সেদিন নহবতের সানাইয়ের সুরে তাঁদের শুভ পরিনয়। তাঁরা সমস্ত আশা, আকাঙ্খা , চাহিদা, ভালোবাসা সব কিছুকে সঙ্গী করে দাম্পত্য জীবনে পদার্পণ করেন এবং সেখান থেকেই শুরু হয় রঙিন স্বপ্ন দেখা, তাঁদের অনাগত সন্তানদের নিয়ে ভবিষ্যতের অনেক সুখের ছবি রচনা করা।
         এই স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতেই তাঁদের বিয়ের প্রায় বছর দেড়েক বাদেই সুজাতাদেবী দুটো যমজ সন্তানের-একটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম দেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্য বোধহয় তখন থেকেই দরজায় কড়া নাড়া দিতে শুরু করে, কারণ নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু আগেই তিনি সন্তান প্রসব করেন।একে যমজ তায় অপুষ্টিগত কারণে কন্যা সন্তানটি অপরিনত অবস্থায় মৃত জন্মায়। জীবিত শিশুটিও অত্যন্ত দুর্বল। তাই অনেক যুদ্ধ করে ডাক্তার, ওষুধ,সেবা শুশ্রূষার মাধ্যমে ছেলেটিকে তাঁরা বাঁচিয়ে তোলেন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ভাবেই সে বাড়তে থাকে।মা,বাবা আদর করে তার নাম রাখেন জয়। একসময় দুর্ভাগ্যের ছায়াটাও অজয় এবং
সুজাতা দেবীর কাছে হার মেনে পিছু হটে যায়। তাঁরা শিশুপুত্র টির মুখের দিকে চেয়ে আনন্দে ও সুখে দিন কাটাতে থাকেন।ছেলের জন্মের দুই বছরের মাথায় সুজাতা দেবীর কোল আলো করে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।সে ছিল সুস্থ এবং স্বাভাবিক।তাঁর নাম রাখা হয় 'রাণী'।জয় ও রাণীকে নিয়ে অজয় ও সুজাতাদেবীর জীবনে সুখে,শান্তিতে আনন্দের ঝর্ণা বইতে থাকে। ছেলে ও মেয়ের স্কুল জীবন শুরু হয়। একটু বড় হতেই পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু হয় নাচ, গান আঁকার অনুশীলন।'জয়'আবার ছোট থেকেই ব্যাট,বলেতে আসক্ত।অজয় বাবু তাকে ক্রিকেট কোচের কাছে ভর্তি করে দেন। শুরু হয় অনুশীলন।মেয়েটিও নাচে,গানে অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠে।এই গতি ও ছন্দময় জীবনে ছেলে মেয়েকে নিয়ে তাঁদের কয়েকটা বছর যে কিভাবে পেরিয়ে যায় তাঁরা টের পান না।ছেলে 'জয়' মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কয়েকটি লেটার সহ ভালো ফল করে। মেয়ে তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। 
          এবার আসলো সেই স্বপ্ন দেখার দিনটি যে স্বপ্নটি এতদিন ধরে অজয় এবং সুজাতা দেবী পরম যত্নে তাঁদের চোখের কোণে লুকিয়ে রেখে ছিলেন। সেটা হলো উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে বিদেশে পাঠানো। স্বপ্নের আরম্ভটা সেই থেকে শুরু। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য জয় বিদেশে গিয়ে তার পড়াশোনা শুরু করে।নিত্য কলেজে যাওয়া, পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে প্রথম বর্ষে ভালো ফল করে পাশ করে। মা,বাবাও তার কৃতকার্যে খুব খুশি। ছেলেটি শুধু পড়াশোনাতেই নয় সে ছিল খুব মিশুকে, আন্তরিক ও প্রাণোচ্ছ্বল। তাই ইতিমধ্যেই তার অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে। তাদের সঙ্গে হাসি, খুশি আনন্দে, আড্ডায় তার দিনগুলো খুব ভালো ভাবে কাটে। তাছাড়া মা, বাবার সাথে টেলিফোনে নিত্য যোগাযোগের মাধ্যমে কুশল সংবাদ বিনিময়, বোনের সাথে খুনসুটিতে তার দিন কাটতে থাকে। আদরের বোন রানীকে সে চোখে হা্রাত।বোনও দাদার জন্য মাঝে মাঝে মনমরা হয়ে থাকত। ফোনে রানীর কান্না ভেজা গলার আওয়াজ পেয়ে জয়ের মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতো। বোনকে আশ্বাস দিয়ে বলতো,আমি খুব শিগগিরই তোদের কাছে ফিরব। তখন একটি রাজপুত্র খুঁজে এনে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেব। তখন তো বেশ খুশি মনে বরের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি। এরকম কত হাসি, আবেগে তাদের দিন কেটে যায়।বোন ও ততদিনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে।         জয়ের তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্য শুরু হয়ে গেছে। মাঝখানে বেশ কয়েকটা বছর তাদের সুখে, শান্তিতে দিন কেটে গেলেও অদৃষ্টের কালো ছায়া আবার যেন তাদের হাতছানি দিতে লাগল, ধীরে ধীরে একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে অজয়বাবুদেের টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
        দ্বিতীয় বর্ষে কিছুদিন ক্লাস করার পর হঠাৎ ঘটল এক দুর্ঘটনা। কলেজ থেকে বন্ধুদের সাথে ফেরার পথে জয় একটা কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পায়ে শুরু হয় তীব্র যন্ত্রণা। সে একা উঠে দাঁড়াতেও পারলোনা। বন্ধুরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকে নিকটবর্তী একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তারবাবু কিছু ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। বন্ধুরা তাকে তার মেসে পৌঁছে দিয়ে আসে। কিন্তু ওষুধেও যখন কাজ হয়না এবং ব্যথাও বাড়তে থাকে তখন বন্ধুরা জয়ের মা, বাবাকে টেলিফোনে সব ঘটনা জানায়।অজয় ও সুজাতাদেবী এই সংবাদ শুনে খুব অস্থির হয়ে পড়েন এবং বন্ধুদের অনুরোধ করেন জয়কে বিমানে করে পাঠিয়ে দিতে,অজয়বাবু কলকাতা বিমানবন্দর থেকে জয়কে নিয়ে আসবেন।জয় কলকাতার বাড়িতে পৌঁছানোর পর তার বাবা, মা পরের দিনই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে জয়কে নিয়ে যান। তিনি সব দেখেশুনে পরামর্শ দেন জয়কে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় জয়ের শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা।  রিপোর্ট হাতে পেয়ে ডাক্তারবাবু বলেন, জয়ের ডান পায়ের কুঁচকিতে টিউমার হয়েছে। সেই থেকে শুরু হয় তার চিকিৎসা। টিউমারটি ও ছিল খারাপ প্রকৃতির। অপারেশন করে বাদ দিলেও শুরু হয় কেমোথেরাপি। কয়েকটি কেমো নেওয়ার পর সে বেশ কয়েকমাস সুস্থ্ ছিল।এর মধ্যে তার পড়াশোনা ও প্রিয় ক্রিকেট খেলা বন্ধ ছিল। হঠাৎ একদিন পুনরায় শুরু হয় তার গোটা পায়ে যন্ত্রণা,তার সঙ্গে নানান উপসর্গ। আবার হাসপাতালে ভর্তি, আবার পরীক্ষা। এবার ডাক্তারবাবু অজয়বাবুদেের যে মর্মান্তিক খবরটা শোনালেন তাতে অজয়বাবুর গোটা পরিবারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এবার বুঝি অদৃষ্টের অশুভ ছায়াটা সরাসরি তাঁদের জীবনে ঢুকে আধিপত্য বিস্তার করলো এবং ছড়ি ঘোরাতে থাকল।অনুপায়, অসহায় অজয়বাবুরা তার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, জয়ের পুরো পায়ে ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে।অতি সত্ত্বর তার ডান পা-টা কেটে বাদ না দিলে সমস্ত শরীরে তা ছড়িয়ে পড়বে। এই নিষ্ঠুর, নির্মম সত্যের মুখোমুখি কিভাবে হবেন, কিভাবে লড়াই করবেন এই ভাবনায় অজয়বাবুদেের নাওয়া- খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। এই কঠিন বাস্তবটা তাঁদের কাছে যেন দু়ঃস্বপ্ন হয়ে উঠল।চিন্তায়, আতঙ্কে তাঁদের শরীর,মন ভেঙ্গে যেতে থাকল। কিন্তু তবুও সবকিছুকে জয় করে দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেকে বাঁচানোর তাগিদে তাঁরা যুদ্ধে নামলেন। ছেলেকে আরো ভালো চিকিৎসার জন্য তাঁরা মুম্বাই পাড়ি দিলেন, মেয়েকেও নিলেন সঙ্গে। কেননা তখন তাঁদের মাথায় একটাই চিন্তা ছেলের অপারেশন। আগামী দিনের ভালো-মন্দ, আলো -আঁধার,মেয়ের পরীক্ষা সব কিছুর ভাবনার উর্ধ্বে তাঁরা চলে গেছেন।
       মুম্বাইয়ের বড় হাসপাতালে দ্রুত শুরু হয় জয়ের অপারেশনের প্রস্তুতি। কয়েকটা দিন অজয়বাবুর পরিবারের হাসপাতালের একটা কোনেই কেটে যায়। ছেলেকে এই দুঃসংবাদটা তাঁরা ঘুনাক্ষরেও জানতে দেননি। গোপনে, নীরবে অশ্রুপাত করেছেন আর ছেলেকে সুস্থ্ হয়ে ওঠার আশ্বাস দিয়ে গেছেন।
অবশেষে সেই দিনটা আসে যেদিন জয়ের ডানপা-টা পুরোপুরি কেটে বাদ দেওয়া হয়।আর কয়েকটা দিন পরেই দূর্গা পূজা। চারিদিকে সাজো সাজো রব, মানুষের আনন্দোচ্ছ্বাসের বন্যা। দোকানে দোকানে কেনাকাটার ভীড়, চারিদিক উৎসব মুখর। তখন অজয়বাবু এবং সুজাতাদেবী হাসপাতালের এক কোনে বুক চাপড়িয়ে কেঁদে চলেছেন। তাঁদের সান্ত্বনা দেবার মতও যেন তখন কেউ নেই। কয়েকঘন্টা পর জয়ের ধীরে ধীরে যখন জ্ঞান আসতে শুরু করে তখনও ঘোরের মধ্যে সে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,আমি ক্রিকেট খেলতে চাই। আমি আমার স্বপ্ন পূ---------এই বলে ঘোরের মধ্যে সে ডুবে যায়।যখন পূর্ন জ্ঞান ফেরে তখন সে অনুভব করে তার পা-টাই নেই। কোনোক্রমে জোর করে চাদরটা সরিয়ে  যখন সে দেখতে পায় তখন একটা করুণ চিৎকার দিয়ে আবার জ্ঞান হারায়। এভাবে দু- তিন দিন কাটার পর একটু একটু করে সে মনকে শক্ত করার চেষ্টা করে  এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে উল্টে মা-বাবাকে আশ্বাস দেয়, বলে মানুষ চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। তোমরা দুঃখ কোরোনা। আমাকে বাঁচতেই হবে,স্বপ্ন পূরণ না করে আমি মরব না।তোমরা বোনের দিকে একটু খেয়াল রেখো, আমার জন্য ওর জীবনে যেন দুঃখ না আসে।
কিন্তু বিধাতা মনে হয় বিরূপ, আড়াল হতে তিনি যেন বিদ্রুপের হাসি হাসলেন। অজয় এবং সুজাতা যখন তাঁদের ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত ছিলেন তখন আদরের মেয়েটার দিকে তাঁরা সম্পূর্ণ খেয়াল রাখতে পারেননি। সেই সুযোগে মেয়ে তার সদ্য যৌবনের চরম ভুলটা করে ফেলে। একটি অতি সাধারণ, বেকার ছেলের প্রেমে পড়ে। মাঝখানে তার দাদাকে নিয়ে প্রায় বছরখানেক অজয়বাবুদেের ব্যস্ততা,ছোটাছুটিতে কেটে যায়। সেই সময়টুকুর মধ্যেই রানী ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।তার মা, বাবা এতটাই উদ্ভ্রান্ত ছিলেন যে টেরটুকু পাননি। রানীর অমতেই তার মা, বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে মুম্বাই যান।অমতের কারণটা তাঁরা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। ছেলেকে নিয়ে কয়েকটা দিন মুম্বাইয়ে তাঁদের কেটে যায়।
    এরপর পূজা চলে আসে। চারিদিকে উৎসবের আমেজ।ঢাকে  পড়েছে কাঠি। দেবীর আগমনের অপেক্ষায় বিশ্ববাসী উদগ্ৰীব । এরমধ্যে ঘটল আরেকটি দুর্ঘটনা।জয় তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।তার এই অঙ্গহীনতায় শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে সে মরনের পারে পাড়ি দিয়েছে। মুখে সে কঠিন কথা বললেও অন্তর থেকে সে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল।সে তার আদরের বোনকে দেখতে ও চেয়েছিল।সেটাই বোধহয় তার শেষ চাওয়া।মাথার চারপাশে তখন ডাক্তার,নার্স। চলছে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
       ঠিক সেই সময়ে রানী তার প্রেমিকের ফোন পেয়ে এতটাই উদ্বেলিত হয় যে,সে তার বাবা, মা, মৃত্যুমুখী দাদাকে ফেলে, তাদের স্নেহ,মায়া, মমতা সব তুচ্ছ করে সুযোগ বুঝে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। বলাবাহুল্য যে প্রেমিক ছেলেটি রানীর বিরহে থাকতে না পেরে মুম্বাই হাজির হয় এবং হাসপাতাল থেকে রানীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। রানীকে খুঁজে না পেয়ে তার বাবা, মা যখন উন্মাদপ্রায় তখন রানী ফোন করে সব বিস্তারিত জানায় ও বলে যে তারা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করবে।
অজয় এবং সুজাতা যখন কপাল চাপড়িয়ে অদৃষ্টকে দুষছেন তখন তাঁদের ছেলে জয় জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা।তার জীবনপ্রদীপ স্তিমিত হতে হতে দপ করে নিভে গেল।তার নিজের স্বপ্ন,মা, বাবার স্বপ্ন,আশা, আকাঙ্খা সব সঙ্গে নিয়ে মা, বাবাকে কাঙাল করে চিরদিনের মত তাঁদেরকে একাকি করে এই শূন্য মরুভূমিতে রেখে বিদায় নেয়।
একদিকে চলছে দেবীর বোধন,অন্য দিকে অজয়বাবুদেের ছেলের পরপারে যাত্রার আয়োজন,আর একদিকে স্বার্থপর,পাষান বোনের বিয়ে করে নতুন সংসারে পদার্পণ। হাসপাতালে তখন অজয় ও সুজাতাদেবীর বুকফাটা কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তাঁদের বিলাপে মন্ডপে মন্ডপে ঢাকের আওয়াজও যেন ক্ষীণ হয়ে ওঠে। তাঁদের চোখের জলে মা দুর্গার পূজার বেদীও মনে হয় ভিজে যায়।
      বিধাতার একি নিষ্ঠুর খেলা ! ছারখার হয়ে গেল একটা পুরো সুখী পরিবার। অকালে ঝরে গেল অনেক স্বপ্নদেখা একটা তরতাজা প্রান।সবার সুখের স্বপ্নগুলো ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে গেল। ওলটপালট হয়ে গেল অজয়বাবুদেের জীবনের সব হিসেব। অজয় ও সুজাতাদেবী তাঁদের ছেলেকে শেষ বিদায় দিয়ে ভগ্ন দেহ মন নিয়ে  নিজ সংসারে ফিরে আসেন। কিন্তু, ছিন্ন বীণাসম জীবনে সব সুর,ছন্দ যেন হারিয়ে যায়। যেদিকেই তাকান ছড়ানো ছিটানো শুধুই ছেলের স্মৃতি। সেই স্মৃতি বক্ষে আগলে ধরে নীরবে অশ্রুপাত করেন। মেয়েও এই অপরিনত বয়সে,অসময়ে নির্মমভাবে তাঁদের ছেড়ে চলে যাওয়াতে তাঁদের দুঃখ, শোক যেন দ্বিগুণ হতে থাকে।কত আশা করেছিলেন মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতা করে সঠিক সময়ে একজন উচ্চশিক্ষিত,সুউপায়ী সুপাত্র দেখে বিয়ে দেবেন, কিন্তু ভাগ্যের লিখন খন্ডাবে কে? তাঁদের সব আশা ধুলিস্যাৎ করে  একটা বেকার ছেলের হাত ধরে সে চলে যায় । দু'বছর সে সন্তানহারা , শোকবিধ্বস্ত  মা, বাবার কোনো খোঁজ নেয়নি। সুজাতা দেবীরাও অভিমানে,দুঃখে মেয়ের খোঁজ করেননি।

একাকিত্ব, শূন্যতা তাঁদের জীবনকে যেন ক্রমে ক্রমে গ্ৰাস করতে থাকে। অজয় বাবু অফিসে বেরিয়ে গেলে সুজাতাদেবী আরও যেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অজয়বাবুর অফিস জীবনেও নেমে আসে ক্লান্তির ছায়া। এভাবে কিছুদিন চলার পর অজয়বাবু মনস্থির করেন তিনি চাকরি থেকে সেচ্ছাবসর নেবেন এবং শেষপর্যন্ত করলেনও তাই। মেয়ের জন্যও তাঁদের মন দূর্বল হতে থাকে এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর শেষপর্যন্ত মেয়ের সন্ধান পান।
               কিছুদিন  পর একদিন মেয়েকে তাঁদের কাছে ডেকে আনেন ও কয়েকদিন তাঁদের কাছে থেকে যেতে বলেন।মেয়েও অনেক দিন পরে মা, বাবাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।সুখ, দুঃখ, আবেগ, অনুভূতির আদানপ্রদানের মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ার পর অজয়বাবু ও সুজাতা দেবী তাঁদের পরিকল্পনামতো বাড়িটি মেয়ের নামে লিখে দেন, অবসরের প্রাপ্ত জমা টাকাতেও মেয়েকে নমিনি করে দেন।রানীও নিজের ভুল স্বীকার করে মা, বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় । সেই থেকে শুরু হয় মা, বাবার সাথে মেয়ের নিত্য  যোগাযোগ ও খবরাখবর আদানপ্রদান। অজয়বাবু ও সুজাতাদেবী পেনসনের টাকা পাথেয় করে একাকিত্ব কাটাতে জীবনের শেষ ঠিকানা খুঁজে নেন, ছেলের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে তাঁরা একটি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান। জীবনের গোধূলিবেলায় এসে বাকি দিনগুলো শান্তিতে কাটাতে তাঁরা আশ্রমবাসীদের সঙ্গে তাঁদের শোক, তাপ, হতাশা, বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা,বেদনা ভাগ করে নেন। সেই থেকে এভাবেই তাঁরা ভাল ও সুস্থ থাকার চেষ্টা করে চলেছেন।
   


রচনাকাল : ১০/৪/২০২১
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  Germany : 2  India : 53  Russian Federat : 2  Saudi Arabia : 6  Ukraine : 3  United States : 79  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  Germany : 2  India : 53  Russian Federat : 2  
Saudi Arabia : 6  Ukraine : 3  United States : 79  
লেখিকা পরিচিতি -
                          শ্রীমতি যুথিকা দেবনাথ একজন গৃহবধূ। জন্ম ৯ ই জুলাই অধুনা বিহারের কাটিহার শহরে। পিতার কর্মসূত্রে পরবর্তীতে মালদহে বসবাস। শিক্ষা জীবন সম্পূর্ণ মালদহ মহাবিদ্যালয় থেকে কলাবিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দমদম ক্যান্টনমেন্টে স্থায়ীভাবে বসবাস।
       ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি উনি গীটারেও শিক্ষা লাভ করেছেন। স্কুল জীবনে কবিগুরুর কিছু লেখনীপাঠ থেকে সাহিত্যানুরাগের  জন্ম। কলেজ জীবনে প্রবেশের পর কিছু কবিতা ও গল্প রচনা দিয়ে লেখালেখি শুরু।মে,২০২০ থেকে কিশলয় ই-পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখিকা। 
                          
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভাগ্যলিপি by Juthika Debnath is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৪৫৭
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী