ছোট্ট ছেলেটির ছোট্ট করুণ কথাটি অতি সহজেই শম্ভু বাবুর শক্ত মনকে স্পর্শ করলো। মনে এতটাই দাগ কাটলো যে ঘুরে ফিরে বারে বারে মনে পড়তে লাগলো কথাটি -"কাকু! এই বয়সে কি আমার এই কাজ করার কথা ছিল? আজ আমার পিঠে থাকার কথা- বই ভরা স্কুল ব্যাগ কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বয়ে চলেছি চটের এই ভারী ব্যাগ--"
ছেলেটির নাম বাবলু। বয়স বছর পনের হবে। বাড়ি বনগাঁর গোপালনগরে। বাবা ভ্যান চালক। তিনমাস হলো মারাত্মক পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বাবলুর মা বিন্দু দয়াময়বাবুর বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজ করে। দয়াময়বাবু বনগাঁর মতিগঞ্জের অভিজাত বস্ত্র বিপনীর মালিক। বড্ড সজ্জন ব্যক্তি। প্রচন্ড পরোপকারী। বাবলুর বাবার অকাল মৃত্যুতে তিনি ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন। দারিদ্র্যের মাঝে কন্যাসম বিন্দুর সদ্য বৈধব্যবেশ দয়াময় বাবুকে বড্ড ভাবিয়ে তুললো। অপরিণত বয়সে প্রিয়জন হারাবার মর্মান্তিক ব্যথা সহজে ভুলবার নয় তবুও কি করে শোক ভুলিয়ে দুর্দিনের দুঃখ মোচন করা যায় ভাবতে লাগলেন। বাবলুকে উপার্জনশীল করে তুলবার জন্য কিছু পরামর্শ দিলেন। সদ্য পিতৃহারা নিতান্ত কিশোর ছেলে বাবলু ক্রমাগত মনকে শক্ত করে মানসিকভাবে তৈরি হলো। সিদ্ধান্ত নিল সে ব্যবসা করবে। বহুকষ্টে কিছু টাকা জোগাড় করে একদিন ছুটলো হাওড়া মঙ্গলা হাটে মাল কিনতে। হয়তো বিধাতার একান্তই অনুগ্রহে তার উপরে সহানুভূতির দৃষ্টি পড়লো পাইকারি বস্ত্র ব্যবসায়ী শম্ভুনাথ বাবুর। তুলনামূলক ভাবে শম্ভুনাথবাবু দয়াময় বাবুর মত পরোপকারী সজ্জন ব্যক্তি নয়। সারাজীবন একমাত্র নিজের স্বার্থটাই শুধু দেখেছেন। নিজের স্বার্থ দেখতে দেখতে পরস্বার্থে পরোপকার পছন্দ করতেন না। এহেন প্রবৃত্তির লোক হয়েও তিনি যে এতটা দয়াপরবেশ হবেন এটা সহজে আশা করা যায়না কিন্তু হল বিপরীত। শম্ভুনাথবাবুর পিতৃত্বের পবিত্র স্পর্শে বাবলু যেন ক্ষণিকের মধ্যে আপন হয়ে উঠলো। পিতৃহারা বাবলুর মর্মব্যথা তিনি সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেন। সারা জীবন আত্মস্বার্থ বুঝতে বুঝতে আজ এই মুহূর্তে বাবলুর ব্যথায় ব্যথিত হলেন তার একমাত্র কারণ তিনিও দুটি সন্তানের পিতা। এইতো গত বছর ডিসেম্বর মাসে তিনিও মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে ফিরে এলেন। সেই দিনের কথায় এখনো ভয়ে শিউরে ওঠেন! সেই স্মৃতির স্মরণে স্বার্থপরতার অন্তরালে জেগেছে সত্যিকারের সহানুভূতি। জীবন-মৃত্যুর ভাবনা-চিন্তায় ভাবেন - কখন কার জীবনে কেমন করে কিনা ঘটে যায়! তাই সম্প্রতি এসেছে একটু আধটু পরিবর্তন। আর এমনি সময়ে আবির্ভাব সদ্য পিতৃহারা বাবলুর। সদ্য শোকাহত অনাথ শিশুর ব্যথায় ব্যথিত হয়ে যথেষ্ট কম দামে বাবলুকে মাল বিক্রি করলেন। বাবলুর পছন্দ করা মালের মুল্যানুযায়ী তার কাছে ততোধিক টাকা না থাকা সত্বেও ক্রেডিটে মাল পেয়ে শম্ভুনাথ বাবুর প্রতি বাবলুর শ্রদ্ধা শতগুণে বেড়ে গেল। আর এমন পরিস্থিতিতে তাকে এইটুকু সহযোগিতা করতে পেরে শম্ভু বাবু পেলেন মানবিক কর্তব্যতায় যেন আত্মসন্তুষ্টি।
বুকভরা আশা নিয়ে বাবলু মতিগঞ্জ বাজারে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসলো। কদিন যেতেই বাণিজ্যে লক্ষ্মী যেন ভর করলো। ছোট্ট ছেলের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে দেয় সবার মনকে। উপস্থিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সে পেয়েছে সকলের সহানুভূতি।কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সে এগিয়ে চলেছে। এগোতে যে তাকে হবেই! জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সংসারের দায়িত্ব আস্তে আস্তে তাকেই নিতে হবে।ছেলে হয়ে জন্মেছে বলেই মায়ের দুঃখ মোচনে তাকেই এগিয়ে আসতে হবে। সকলের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে সৎপথে ব্যবসাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগল। মঙ্গলা হাট থেকে ক্রমাগত মাল কেনায় শম্ভুবাবুর আন্তরিক সহানুভূতি তাকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেকটা সাহায্য করল।
প্রায় বছর দশেক কেটে গেছে। পরিবর্তন এসেছে বাবলুর ভাগ্যের। এখন তাকে ফুটপাতে রোদ-বৃষ্টিতে পসরা সাজিয়ে বসতে হয় না। একটু একটু করে সঞ্চিত আর্থিক সামর্থে সে করেছে একটি দোকান। মতিগঞ্জ বাজারে মেইন রোডে খুবই ভালো পজিশনে পেয়েছে দোকানটি। নাম দিয়েছে "আদান-প্রদান"। বড়োসড়ো ঝলমলে গ্লোসাইন বোর্ড খানি দোকানের সৌন্দর্য অনেকটাই বাড়িয়েছে। পথ চলতি খরিদ্দারের আনাগোনায় দোকান সব সময় জমজমাট।
পরিপাটি দোকানের শোকেসে সাজানো একটি ঝকঝকে সুন্দর ফ্রক জামা দেখে আরোহী চলন্ত রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লেন। আরোহী অন্য কেউ নয়। সেই বছর দশেক আগে হাওড়া মঙ্গলা হাট এর বস্ত্র ব্যবসায়ী শম্ভুনাথবাবু। তিনি চলেছেন পেট্রাপোল সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে। চলন্ত পথে চলতে চলতে মনে পড়েছে জন্মভূমির কথা। দেশ ছেড়ে এপার বাংলায় চলে এলেও মন টানে সেখানকার আত্মীয়-স্বজনের জন্য। চলার পথে মনে পড়ছে গতকাল ফোনে কথা হওয়া ছোট্ট ভাইঝি শুক্লার কথা। তার কি আনন্দ- কতদিন পরে কাকু আসছেন কলকাতা থেকে। তার জন্যই জামা কিনতে ক্ষণিকের জন্য নেমে পড়লেন শম্ভুনাথ বাবু। আদান-প্রদানের দিকে এগিয়ে যেতেই বাবলুর নজরে পড়লো আগত খরিদ্দারের দিকে।বাবলু চিনতে পেরে এগিয়ে এলো সামনে। তার কাছে আজ পিতৃতুল্য শম্ভুনাথবাবুকে জড়িয়ে ধরে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সযত্নে দোকানের ভেতরে নিয়ে বসালো। শম্ভুনাথ বাবুর সেইদিনের একান্ত আন্তরিক সহানুভূতি আজ তাকে পৌঁছে দিয়েছে এই সাফল্যের জায়গায়।তার জন্য তাঁর কাছে সে চিরকৃতজ্ঞ -এই স্বীকারোক্তি বাবলুর কথায় বারবার ব্যক্ত হ'ল।
প্রায় বছর পাঁচেক হ'ল বাবলুর আর মঙ্গলা হাটে গিয়ে দোকানের মাল কিনতে হয় না। দোকানের সুনামে দোকানেই মাল পৌঁছে দেয় বিভিন্ন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। মাল আসে বড় বাজারসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। যার জন্য দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ হয়নি। মাঝে মধ্যে শম্ভুনাথ বাবুর যখন বাবলুর কথা মনে পড়তো তখন ভাবতেন ছেলেটার বুঝি আবার কি হ'ল! কিন্তু উভয়ের দেখা না হওয়ায় মাঝে মধ্যে যে তার জন্য একটু-আধটু মন খারাপ না হয়েছে তা নয়।মনের অজান্তে তাদের উভয়ের মধ্যে এক মায়ার বন্ধন গড়ে উঠেছিল ।কিন্তু মনের সেই চিন্তা মনেই থেকে গেছে।
শম্ভুনাথবাবু বাবলুর দোকান দেখে অবাক হয়ে গেলেন। মুহূর্তেই স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো সেই হাওড়া মঙ্গলা হাটে পিঠে ব্যাগ নিয়ে সেই পুরনো দিনের স্মৃতি----! তখনও হৃদয়ে বারবার বাজছে বাবলুর সেই দিনের সেই করুণ কথাগুলি----! আজ তার স্বপ্ন সার্থক হওয়ায় শম্ভু বাবু তাকে করলেন প্রাণখুলে আরো আশীর্বাদ! পিতৃহারা ব্যথা ভোলার নয় তবুও সেই দুর্দিনে সকল স্বার্থ ভুলে সামান্য সহযোগিতায় পরোপকার করতে পেরে নিজেকে কর্তব্য পরায়ন ভেবেছিলেন। আর আজ তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখে যে কতটা ভালো লাগছে তার পরিমাপ কোন মাপকাঠি দিয়েও সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারছেন না-------!
রচনাকাল : ১০/৪/২০২১
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।