মাতৃ দর্শন
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখক : শিব প্রসাদ হালদার
দেশ : India , শহর : কোলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২১ , মার্চ
প্রকাশিত ১০ টি লেখনী ১৪ টি দেশ ব্যাপী ১৩৬১ জন পড়েছেন।
বিশে অক্টোবর দু'হাজার পাঁচ। গভীর নিম্নচাপের বৃষ্টিতে কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায়। কত কত রাজপথ ভাসছে। রাস্তায় যানবাহন অনেক কম। কোন কোন রুটে বাস মিলছে এক-দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর। বাসস্ট্যান্ডে বাস যাত্রীদের ভিড় জমেছে। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে অন্য রুটের বাস ধরে যে যেমন ভাবে পারে চলে যাচ্ছে। তবুও ওই ভদ্রমহিলা কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। এক দৃষ্টিতে যেন কি দেখছেন। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে জনসমাগমরত জাগ্রত এক মাতৃ মন্দিরের সামনে। 

সারাদিন সূর্যদেবের দর্শন পাওয়া যায়নি। অস্তমিত কিনা বোঝা দায়। এমনিতে সারাটা দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন। আবছা আলোয় কেটে চলেছে। দিন দুই হ'ল বর্ষণের দুর্যোগ চলছে। কদিন চলবে  কে জানে!অবিরাম বর্ষণের ধারায় সবাই নাজেহাল। মন্দিরের সামনে একটি প্লাস্টিকের নিচে প্লাস্টিক জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে প্রায় সত্তরোর্ধ্ব এক শীর্ণা দেহি বৃদ্ধা। পরনের সমস্ত বস্ত্র ভিজা। গা বেয়ে জল পড়ছে। মাঝে মাঝে ভিজা বস্ত্র চেপে জল ফেলে চলেছে। কাঁপুনি উঠেছে সর্বাঙ্গে। দুর্যোগের দুর্বিপাকে দিশাহারা। ভিক্ষা চাওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে। চোখে মুখে অসহায়তার ছাপ।ছোট ছোট প্লাস্টিকের পুটুলিতে সংসারের সামগ্রী যা ছিল তার সবটাই ভিজে গেছে। ভিক্ষার থালায় পড়েনি পয়সা- বৃষ্টি পড়ে পড়ে জমেছে বর্ষণের জল। বৃষ্টির সাথে অবিরাম লড়তে গিয়ে হয়তো পেটে কিছু পড়েছে কিনা- কে জানে! সারাদিন অনেক পুণ্যার্থী পুণ্য লাভের আশায় এসেছে মাতৃমন্দিরে। কত লোক পয়সা ছুড়ে দিয়েছে মায়ের উদ্দেশ্যে। প্রার্থনায় মাকে জানিয়েছে-"মা আমার মঙ্গল করো, সবাইকে ভাল রাখো------!" আত্মতৃপ্তিতে ফিরে গেছে যে যার গন্তব্যে। প্রণাম সেরে ঘাড় ফেরাতেই কারো দৃষ্টিতে এই দৃশ্য পড়লেও হয়তো ঠিক তখনই প্রচণ্ড ব্যস্ততায় ভালো করে বৃদ্ধাকে তাকিয়ে দেখবার মতো সময় হয়নি। সবাইকে ভালো রাখার প্রার্থনা জানালেও এই ভিখারিনী যে সবাই আওতায় পড়ে সেটুকু ভাববার মতো মানসিকতা হয়তো প্রার্থনারত সকল পুণ্যার্থীর নেই।

            দিনের শেষে মঙ্গলময়ী মায়ের মন্দির প্রাঙ্গণে ফিরে লোকটা আঁতকে উঠল। লোকটা বৃদ্ধার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। জীবনের পড়ন্তবেলায় ঘাত-প্রতিঘাতে চলতে চলতে চলন্ত পথেই দেখা। ভাসতে-ভাসতে তরী যখন থামলো তীরে তখন তারা একই পথের যাত্রী। অচেনা অজানা দুটি প্রাণীর হ'ল জানাশোনা। একে হলো অন্যের দুঃখ মোচনের সাথী। গড়ে উঠলো আন্তরিক ভালোবাসার বন্ধন। বার্ধক্যের ব্যথায় দুজনেই বেছে নিল ভিক্ষাবৃত্তি। একজন মন্দির-অন্যজন মসজিদে। বৃদ্ধ সারাদিন কলকাতার এক বড় মসজিদের সামনে বসে ভিক্ষা করে। সারাদিনে যা পায় দিনের শেষে তাই এনে তুলে দেয় বৃদ্ধার হাতে। এমন করেই গড়ে উঠেছে তাদের প্রকৃত মায়ার বন্ধন। ধর্মীয় উন্মাদনার দায়ে সারা দেশে কত নিন্দনীয় অঘটন ঘটে চললেও জীবনের শেষ বেলাতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের এমন আন্তরিকতার বন্ধন সত্যিই অবাক করিয়ে দেয়। প্রকাশ্য রাজপথের পাশে এমন দৃশ্য দেখেও কটা মানুষের অন্তরে জেগেছে সত্যিকারের সমবেদনা? দুর্যোগের দুর্দিনে এমন দুর্গতি সইবার মত সামর্থ্য যেন নেই তার দেহে। হয়তো দুদিন বাদেই ঐ বৃদ্ধার জীবনপ্রদীপ যাবে নিভে।রেখে যাবে স্মৃতি! কিন্তু কে করবে সেই স্মৃতিচারণ? লোকটার বয়স কম নয়। আনুমানিক পঁচাত্তর-আশি হবে। মুখ ভরা প্রায় ইঞ্চি ছয়েক সাদা দাড়িতে ভর্তি। বৃদ্ধার সামনে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। নিজের হাতে কাপড়ের আঁচল নিঙড়ে দিল। ঝর ঝর করে ঝরে পড়ল জল। একবারও কেউ বুঝলো না -দেখেও দেখলা না , ওই জলের সাথে বিসর্জিত হল বড় দুঃখে ঝরা ফোটা ফোটা বৃদ্ধার অশ্রুবারি! কে জানে হয়তোবা ওই বৃদ্ধার আছে পুত্র -আছে পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি আছে ঘরবাড়ি সাজানো সংসার।আছে সব-------- নেই শুধু সেখানে থাকবার মত তার জন্য একটুখানি স্থান। হায়রে মানব সভ্যতা!

        ক্ষণকাল অপেক্ষা না করেই বৃদ্ধ তরতর করে ছুটে গেল। ফিরে এল মিনিট পনের বাদে। কিনে নিয়ে এলো দিন ভিখারির সামর্থ্যমতো কম দামের একটা খয়েরি পাড়ের কোরা থান কাপর। বৃদ্ধ সেটি তুলে দিলো বৃদ্ধার হাতে। হাতে পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে বড্ড কষ্টে বৃদ্ধা উঠে দাঁড়াল। পথের মাঝে সবার সামনে ঐ ভিজা বস্ত্র বদলিয়ে ফেললো। শুকনো নতুন বস্ত্রের পরশে সে পেল আপাততঃ স্বস্তি। প্রকাশ্যে খোলা জায়গায় যখন বস্ত্র বদল হচ্ছে তখন সেখানে সভ্য সমাজের অনেক সভ্য ব্যক্তির সজাগ দৃষ্টি পড়েছে। আশেপাশের বহু দোকানদার যারা এতক্ষণ না দেখার ভান করেছিল তারা উৎসুক নয়নে উপভোগ করল এই দৃশ্য। পার্শ্ববর্তী অভিজাত বস্ত্র বিপনীর অভিনব কৌশলে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সংগৃহীত বস্তা বস্তা পুরানো পরিত্যক্ত শাড়ি কাপড়ের একটি ছেঁড়া কাপড়ও বৃদ্ধার হাতে তুলে দেবার মতো মমতা তাদের অন্তরে জাগেনি। 

         বাসের অপেক্ষায় যে ভদ্রমহিলা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন ইতিমধ্যে তিনি নিকটবর্তী একটি মিষ্টির দোকান থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এসেছেন । সঙ্গে পঞ্চাশটি টাকা দিয়ে বৃদ্ধার হাতে তুলে দিলেন। দুটি হাত জড়ো করে করলেন প্রণাম। এ প্রণাম যেন সাক্ষাৎ দেবী প্রণাম। খিদের জ্বালায় বৃদ্ধা হাত বাড়িয়ে হাতে তুলে নিল। সেটি খুলে বৃদ্ধ একটু একটু করে বৃদ্ধার মুখে তুলে দিতে লাগল। ভিন্ন জাতের এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার এমন অদ্ভুত আন্তরিকতার স্মরণীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পেরে ভদ্রমহিলার বারেবারে মনে পড়তে লাগলো -"জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। কিন্তু একি! দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তিনি যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। সভ্য যুগে আমরা এত উন্নত হয়েছি -কত টাকা কত দিকে কত লোকে প্রতিনিয়ত ব্যয় করে চলেছে কিন্তু সম্বলহীনা অসহায়া এই মহিলাকে মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ জীব ভেবে প্রেম দেখাতে কজন এগিয়ে এলো? যদিও দুই একজন এসেছে তারা দূর হতে একটি আধুলি কিংবা একটি টাকার কয়েন অচ্ছুতের মত ছুড়ে পালিয়ে গিয়ে কর্তব্য পালন করেছে।

        মায়ের মন্দিরে বুক ভরা ব্যথা নিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম জানিয়ে বললেন- "মা তোমার পদতলে আজ এ কি দৃশ্য দেখালে আমায়। সকলকে দাও তুমি সুমতি। দুঃখ মোচনে সকলের অন্তরে জাগিয়ে দাও সমবেদনা ----!"প্রণাম সেরে চোখের জল মুছতে মুছতে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। পাদুকায় পা গলাতে গলাতে পিছন ফিরে আর একবার বৃদ্ধাকে দেখে নিতে চাইলেন। অন্যমনস্কতায় রাস্তার মাঝে এক ব্যস্ত পথচারীর সাথে সামান্য ধাক্কা লাগতেই টিপ্পনি কেটে বলে  উঠলো- " কি দিদি! মন্দির ছেড়ে কি রাস্তায় মাতৃদর্শন করছেন--------?"
রচনাকাল : ১০/৪/২০২১
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 3  France : 1  Germany : 2  India : 52  Russian Federat : 2  Ukraine : 3  United States : 68  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 3  France : 1  Germany : 2  
India : 52  Russian Federat : 2  Ukraine : 3  United States : 68  
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
মাতৃ দর্শন by Shibaprasad Halder is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৭৫৯৪
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী