পথে পাওয়া পথ
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : শিব প্রসাদ হালদার
দেশ : India , শহর : কোলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২১ , মার্চ
প্রকাশিত ১০ টি লেখনী ১৮ টি দেশ ব্যাপী ১৬৮২ জন পড়েছেন।
রাত প্রায় এগারোটা ত্রিশ। পথে নেই পথচারী। যশোর রোড ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে লোকটি। হাঁটতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মদের নেশায় পা দুটো আঁকাবাঁকা হয়ে চলছে। আড়চোখে চশমার ফাঁক দিয়ে ঘন ঘন পিছন ফিরে তাকিয়ে চলেছে। ভাবছে যদি কিনা একটা রিক্সা পাওয়া যায়।সেন্ট্রাল জেলের মোড় পেরিয়ে আর,বি,সি রোডে ঢুকতেই একটা রিকশা এসে পাশে দাঁড়ালো। কাকু যাবেন নাকি! রিক্সাওয়ালার সম্মোধনে লোকটির প্রাণ জুড়িয়ে গেল। পেল  স্বস্তি ! শীতের রাতে তখনও লোকটির কপাল ঘেমে চলেছে। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞাসা করল- লাইনের ওপার সুভাষনগর যাব। তোকে ভাড়া কত দিতে হবে? দশ টাকা চাইতেই লোকটি বললো- তোকে ভাই আরও দশ  টাকা বেশি দেবো কিন্তু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় লাইট পোস্টের সব লাইট জ্বলেনি। বিশাল বটগাছের ছড়ানো-ছিটানো ডালের পাতায় পাতায় আটকে থাকা লাইট পোস্টের আবছা আলোয় লোকটি রিক্সায় উঠে বসল। রিক্সা চলতেই হালকা হাওয়ায় লোকটির লম্বা লম্বা উস্কোখুস্কো চুল উড়তে লাগলো। কপালে সিঁদুরের বড় টকটকে লাল টিপ যেন সেই চুলে লুকোচুরি খেলতে খেলতে রিক্সা এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে। রিকশায় উঠে লোকটি শুরু করলো হাজারো প্রশ্ন- কোথায় থাকিস, ডেইলি কত ইনকাম, সংসারে কতজন মেম্বার, সংসার কেমন করে চলে---?

             রিক্সাওয়ালা বিনয় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল- কাকু! বি এ পাশ করেছি। অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু চাকরি পাইনি। অভাবের সংসারে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। লেখাপড়া শিখে রিকশা চালাতে লজ্জা করে। কিন্তু কি করবো- পেটের দায়ে পথে নেমে পড়েছি। তাই দিনের পরিবর্তে রাত্রেই বেশিরভাগ রিকশা চালাই। সারাদিনে যা ইনকাম হয় তাতে সংসার চলেনা। অভাবে যন্ত্রণায়---------! বলতে বলতে থেমে গেল। আরও যেন কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারল না। লোকটি একমনে বিনয়ের কথাগুলি শুনলো। হঠাৎ কি ভেবে অত্যন্ত বিরক্তির সুরে বলে উঠল- আরে ব্যাটা, এইসব রিকশা ঠিকসা ছাড়।পারলে পথের পাশে কোথাও ভাল পজিশন দেখে ফাস্টফুডের দোকান কর্। দেখবি কয়েকদিনেই ভাগ্য ফিরে যাবে। বিনয়ের কাছে কথাটা খারাপ লাগলো না। দুঃখ বেদনায় ক্ষতবিক্ষত মনে জেগে উঠল এক নতুন দিশা। নিজের মনকে নিজে প্রশ্ন করছে- ঠিকই তো! এমনটা করলে কেমন হয়? কিন্তু অভাবের সংসারে টাকা পাবে কোথায়? আস্তে আস্তে রিকশা চালিয়ে এসে থামল সুভাষ নগর মোড়ে। লোকটি নেমে গেল। কুড়ি টাকার একটি নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল- জানিস তো আজ অমাবস্যার রাত। চোখ দুটো বড় বড় করে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে পড়লো। ক্ষনিকের জন্য কি ভেবে আবার বলল- তোকে যা বললাম তাই করিস। দেখবি তোর ভালো হবে। বলেই লোকটি হাত উঁচু করলো। মনে হলো যেন লোকটির হাতের তালু থেকে বিচ্ছুরিত দৈব রশ্মি বিনয়ের মস্তক এসে পড়ল---। এক অদৃশ্য আত্মবিশ্বাস জমা হলো তার মনে।

              লোকটা হেলেদুলে আঁকাবাঁকা পা ফেলে চলে গেল। যাবার বেলায় দিয়ে যাওয়া উপদেশ যেন তার কাছে আশীর্বাদ বাণী মনে হলো। ভাবিয়ে তুলল তাকে। বড্ড চঞ্চল হয়ে উঠল। লোকটিকে নামিয়ে দিয়ে সোজা লক্ষীনারায়ন রোড ধরে দুর্গানগর এর দিকে রওনা হলো। যাবার পথে পথের পাশে জাগ্রত কালী মন্দিরের সামনে রিকশা থামিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করলো। হয়তো প্রাণখুলে নির্জন রাতে দুটি হাত জোড় করে মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিতে চাইল আশীর্বাদ। মন্দিরের বন্ধ দ্বারে অবিরত কপাল ঠুকে বলল- মা! আমায় পথ দেখাও। উপার্জনের বন্ধ দ্বার তুমি খুলে দাও। পথিকের প্রদর্শিত পথে পাবো কি আমি সেই সাফল্যের পথ? বলে দাও আমায়- কি করবো আমি------!

              বাড়ি গিয়ে অভাবের সংসারে আধপেটা খেয়ে শুয়ে পড়ল। থেকে থেকে তার মনে পড়তে লাগলো কল্পনায় রঙিন স্বপ্ন। শুধু ভাবছে কিভাবে কি করা যায়। ঘুম আর আসে না। সে ভেবেই চলে----। ভাবতে-ভাবতে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ল। শেষ রাতে স্বপ্ন দেখলো রাস্তার পাশে সে সত্যিই ফাস্টফুডের দোকান করেছে। লম্বা বেঞ্চে সারি সারি খরিদ্দার বসে আছে। কেউ বা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সকলের অর্ডার মতো খাবার পরিবেশনে একা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে। বৃদ্ধার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিনয়কে গোটা কতক ধাক্কা মারতেই তার সম্বিত ফিরে এলো। মা বলল- কিরে বিনয়!তুই কি স্বপ্ন দেখছিস?বিনয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলতেই ভোরের কাক ডেকে উঠলো। বিনয় চোখ লগড়াতে লগড়াতে উঠে পড়ল।

                 সকালে একটা ভাঙ্গা কাপে চা খেতে খেতে গত রাতের সমস্ত ঘটনা মাকে খুলে বললো। সবকিছু শোনার পর মা বললেন - যদি এমন জায়গা কোথাও পাস তাহলে চেষ্টা করে দ্যাখ। কখন কার কথা কিভাবে ফলে কেউ বলতে পারেনা। প্রস্তাবটা যখন তোর এতই ভালো লেগেছে তখন চেষ্টা করতে দোষ কি? মায়ের সম্মতি পেয়ে বিনয় রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মনের মধ্যে শুধু উঠানামা করছে গত রাতের স্বপ্ন সফলের সম্ভাব্য চিন্তাভাবনা। কোথায় করবে দোকান, কি করে করবে টাকা জোগাড়, কেমন চলবে দোকান- এইসব  ভেবে সারাটাদিন ঘুরে ঘুরে শুধু পরিকল্পনা করতে লাগলো। কয়েকদিন ঘুরে ফিরে জায়গাও পছন্দ করলো। শেষমেশ মাসখানেকের মধ্যে নিজের রিক্সা খানা বিক্রি করে গড়ে তুলল স্বপ্নের দোকান "খানাপিনা"। নতুন দোকান উদ্বোধনের দিনই তার দোকানে বিক্রি হলো আশাতীত! বেড়ে গেল তার উৎসাহ। সৎভাবে সে এগিয়ে গেল। মনে হলো সাফল্যের সিঁড়িতে সে সত্যিই পা রাখতে পারলো। ভাগ্যের বিবর্তনে বিনয় আজ আর রিক্সাওয়ালা নয়। সৎ ভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে রোজগারের রাস্তা পরিবর্তিত হয়েছে। চলন্ত পথে পথিকের কাছে পেয়েছে রোজগারের নতুন পথ। আর তাতেই এসেছে সাফল্য। দিনের-পর-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটু একটু করে বড় হয়েছে তার ব্যবসা। সুনামের সাথে এগিয়ে গেছে সামনে।সস্তায় সুন্দর খাবার পরিবেশন করে অল্প সময়েই ছড়িয়ে পড়ল "খানাপিনা"র সুনাম।

               "খানাপিনা" প্রতিষ্ঠার পর পাঁচটি বছর কেটে গেছে। পরিবর্তন হয়েছে বিনয়ের ভাবাবেগে। আজ আর সে ভাড়া বাড়িতে নেই। দু কাঠা জমি কিনেছে। সেখানেই করেছে তার সাধ্যমত সুখের নীড়। এই পরিবর্তনের যে পথ প্রদর্শক- তাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য দু' চার বার এসেছে সুভাষ নগর মোড়ে। কিন্তু খুঁজে পায়নি তার সন্ধান। বিনয়ের অন্তরে বারবার জেগেছে তার কথা। মনে মনে তাকে শ্রদ্ধা করে চলেছে কিন্তু সাক্ষাৎ সে পায়নি। হঠাৎ একদিন বিনয় দেখলো- সেই লোকটি তার দোকানের সামনে দিয়েই পায়ে হেঁটে দুর্গানগর স্টেশনের দিকে চলেছেন। সঙ্গে তার স্ত্রী। বিনয় হঠাৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে দোকানের কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এল। পথের মাঝে কাকু! কাকু!! করে ডাকতে ডাকতে কাছে এসে প্রণাম করলো। হাত দুটি ধরে বললো- আপনাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু দেখা পাইনি। আমার সৌভাগ্য যে আজ আপনার দেখা পেলাম। আপনার সেই দিনের কথা শুনে আমি এই দোকান করেছি। বলেই হাত বাড়িয়ে ইশারায় দোকানটিকে দেখাতে চাইল। দোকানে তখন যথেষ্ট ভিড় রয়েছে। লোকটিও দোকানের দিকে দৃষ্টি ঘুরালেন। দেখলেন বিনয় আজ একা নয়। দুজন কর্মচারীও কাজ করছে। পাশ থেকে তার স্ত্রী জানতে চাইল- ছেলেটি কে? লোকটি নিরুত্তর। তিনি ছেলেটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষন ভেবে লোকটি বললেন- আমিতো তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না! শুনেই বিনয় যেন স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। বললো- সে কি কাকু! আমায় চিনতে পারছেন না!! সেই যে প্রায় বছর পাঁচেক আগে সেন্ট্রাল জেলের মোড় থেকে অনেক রাতে বড্ড বেসামাল অবস্থায় আমার রিক্সায় করে বাড়ি ফিরেছিলেন। বলেই সেই রাতের পুরনো ঘটনাগুলি বলতে লাগলো কিন্তু লোকটির সেইদিনের কোন কথাই মনে পড়লো না। তবুও তার প্রতি বিনয়ের শ্রদ্ধার সৌজন্যতায় হাত দুটি ধরে বললেন- সৎপথে থেকে নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে যাও।দেখবে তোমার আরও ভালো হবে।এতদিনে তুমি যা পেয়েছ সেগুলি শুধু তোমারই প্রাপ্য ছিল। হয়তো তুমি দিশাহারা হয়ে বিভ্রান্ত পথিকের মত ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। কোথায় গেলে পাবে সমস্যা সমাধানের সন্ধান- সেই পথ দেখাবার জন্য হয়তো সেদিন রাতে দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে। হয়তোবা বিধাতার বিধান এই অধমের মাঝ দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু ভাই দেখ, এসব কিছুই আমার মনে নেই। তবুও তোমার মঙ্গল হোক- তুমি প্রতিষ্ঠিত হও! জগজ্জননীর কাছে জানাই এই প্রার্থনা। বলেই হাত দুটি কপালে তুললেন। ততক্ষণে দুর্গানগর স্টেশন সংলগ্ন রেলগেট খানা ঢং ঢং শব্দে পড়তে লাগলো। লোকটির স্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিলেন -হ্যাঁগো! ট্রেন যে আসছে। লোকটি বিনয়ের হাত ছেড়ে ট্রেন ধরার জন্য দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। দোকানে তখনও ভীড়। তবুও বিনয় লোকটির চলন্ত পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো------!
রচনাকাল : ১০/৪/২০২১
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 3  Europe : 1  France : 1  Germany : 2  India : 64  Ireland : 5  Russian Federat : 3  Saudi Arabia : 1  Ukraine : 3  
United Kingdom : 2  United States : 92  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 3  Europe : 1  France : 1  
Germany : 2  India : 64  Ireland : 5  Russian Federat : 3  
Saudi Arabia : 1  Ukraine : 3  United Kingdom : 2  United States : 92  
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
পথে পাওয়া পথ by Shibaprasad Halder is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৬২৮৫২২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী