শ্রাবণ মাস। কে বলবে বেলা তখন দুপুর প্রায় বারোটা। নীল আকাশের কুচকুচে কালো মেঘের কাছে হার মেনেছে দিনের আলো। প্ল্যাটফর্মের সাদা চকচক টিউবলাইট গুলো জ্বলে উঠলো। দমদম ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের দুই নম্বর প্লাটফর্ম। সিমেন্টের বেঞ্চের এক কোণে ঠাই বসে আছেন এক বৃদ্ধা। অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছেন। দৃষ্টি তার টিকিট কাউন্টারের দিকে। খোকা টিকিট কাটতে গেছে প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেল। এখনো ফিরে আসেনি। আবার বুঝি কি হলো খোকার- এই দুশ্চিন্তায় যেন আরও ভাবিয়ে তুলছে। তখনও সরল মায়ের মনে একবারও জাগেনি খোকার অন্তরে জমেছে কতটা পাপ। সন্তানের মঙ্গল কামনায় অন্তরের অব্যর্থ যন্ত্রণা চেপে রেখেছেন। কিন্তু আর কতক্ষণ সইবেন?
এক এক করে পাশে জড়ো হওয়া উৎসুক জনতা ঘটনার রহস্য জানতে ব্যস্ত। ভিড় জমে উঠেছে খানিকটা। হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে নেমে এলো ভারী বর্ষণের প্রবল ধারা। সঙ্গে এলোপাথাড়ি হাওয়া। তখন এফএম রেডিওতে প্ল্যাটফর্মের দোকানে দোকানে বাজছে -"আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাতো মন-------।" অবশেষে বৃদ্ধার অবস্থা দেখে মন যে আর কারো মানছে না!
অনেক কষ্ট করেও যখন ঘটনার যথাপোযুক্ত সূত্র পাওয়া যাচ্ছিল না তখন দীনবন্ধু বাবু ভীড় ঠেলে পাশে এসে বসলেন। বৃদ্ধার হাত দুটি ধরে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন - মাসিমা! আমি আপনার ছেলের মতো। কি হয়েছে আমাকে বলুন। আপনাকে দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতন। তাঁকে তো হারিয়েছি বছর পনের হলো। আপনি চলুন আমার বাড়ি। আমাদের বাড়ীতেই আপনি থাকবেন। আপনিই আমার মা! বৃদ্ধার দুচোখ বেয়ে নেমে এল শ্রাবণের ধারা। কালো সরু পাড় সাদা কাপড়ের আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মুছছেন। কন্ঠ যেন বাকরুদ্ধ। তবুও দীনবন্ধু বাবুর দু-দন্ডের পরশে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। শুরু করলেন একটু একটু করে বলতে।
বাড়ি বনগাঁ স্টেশন থেকে অনেকটা ভেতরে। দুই ছেলে দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। এক মেয়ে এখন পাঞ্জাব। জামাই এয়ারফোর্সের মেসেজ অপারেটর। ছোট মেয়ে জার্মানি থাকে। বছর দেড়েক হল বিয়ে হয়েছে। জামাই ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশি নামি কোম্পানিতে কর্মরত। ছেলেরাও সবাই প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে তপন আসামের শিলচরে থাকে। সেখানে সে একটি সরকারি সংস্থায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। অ্যাক্সিডেন্টে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। হঠাৎ স্বামীর মৃত্যুতে আস্তে আস্তে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। বড় সাইক্রাটিস্ট দেখিয়েও তেমন কোনো ফল হয়নি। এমন ক্ষণস্থায়ী মানসিক অসুস্থতার স্বপক্ষে সঠিক জোরালো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ডাক্তারের নির্দেশে মাঝে মাঝে সাইট চেঞ্জের ব্যবস্থা করতে বলেন। খবর পেয়ে বড় ছেলে তখন শিলচর থেকে এসেছে মাকে সেখানে পারমানেন্টলি নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু বৃদ্ধা কিছুতেই তার স্বামীর পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে যাবেন না। ছোট ছেলের বউও নাছোড় বান্দা। সেও শ্বাশুড়ীকে তার কাছে কিছুতেই রাখতে চাইছে না। আর সেই থেকেই শুরু অশান্তি।
ছোট ছেলে স্বপন কলকাতার একটি নামী বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। মাত্র তিন বছর হলো চাকরি পেয়েছে। চাকরি পাবার ছয় মাসের মধ্যেই ধুমধাম করে বিয়ে হল। পাত্রী এক রিটায়ার্ড উচ্চপদস্থ সরকারি দাম্ভিক অফিসারের "আলালের ঘরের দুলালী"। দেখতে খুব সুন্দরী কিন্তু বদমেজাজী। বাপের বাড়িতে একটু বেশি আদর পেয়ে মনে হয় বাপের মেজাজটাই পুরোটা রপ্ত করে নিয়েছিল। নামটাও মন্দ নয় -অঞ্জলি। স্বামীর ঘরে এসে কৌশলে তাকে বশ করতে সময় লাগেনি মোটেও। সেই সুযোগে শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি জলাঞ্জলি দিয়ে অঞ্জলি হয়ে উঠলো উশৃঙ্খলা।
স্বপন অফিসে চলে যাবার পর বিনোদ প্রায়ই আসতো তার ঘরে। সে ছিল তার সহপাঠী। অঞ্জলীর বিয়ের আগে ওরা একই কলেজে পড়াশুনা করতো। মনের লেনদেন অনেকটা গড়িয়েছিল কিন্তু বিনোদ সুদর্শন সুপুরুষ হলেও সে ছিল বড্ড গরীব। চরিত্র খুব একটা ভালো ছিল না। অঞ্জলী পছন্দ করলেও তার বাবা তাকে বিনোদের হাতে তুলে দিতে পারেননি। মেয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতায় সুখী হবে এই ভেবে অঞ্জলীকে তুলে দিলেন অবস্থাবান চাকুরীরত স্বপনের হাতে। তাতেই তার মেজাজটা বিগড়ে যায়। আহ্লাদে বেড়ে ওঠা অঞ্জলীর যৌবনের প্রারম্ভে ইচ্ছাধীন লুকোচুরিতে পড়ে গেল ছেদ। মুক্ত বিচরণের অতৃপ্ত আশা নিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বপনের গলায় মালা পরাতে হলো।
বিনোদও ছাড়ার পাত্র নয়। সেও রইল সুযোগের অপেক্ষায়। নানান অছিলায় বিনোদ আসতে শুরু করল অঞ্জলীর ঘরে ।আস্তে আস্তে তাদের কথাবার্তা হাসি ঠাট্টা তামাশা-------মোটেও শাশুড়ির চোখে ভালো লাগছিল না। আদর্শ ঘরের গৃহবধূ হয়েও এ কি অসভ্য অশালীন আচরণ! শাশুড়ি হয়ে পুত্রবধূর এমন অশিষ্টতা কি করে মেনে নেবেন? প্রথম প্রথম বউমাকে ডেকে আপত্তির কথা জানিয়েছেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। হয়েছে হিতে বিপরীত। অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ দাম্ভিক কর্মীর কন্যার রকমারি আকুতিতে বাপের বাড়ির মদতে হল অভিনব ব্যবস্থা। আস্তে আস্তে শাশুড়ি হলেন দুচোখের কাটা! বিনোদের চিত্ত বিনোদনে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য সে এবার চাললো অন্য চাল। লেলিয়ে দিল প্রতিবেশিনী শিউলির মাকে। ঘর ভাঙতে শিউলির মা সিদ্ধহস্তা। শুরু হলো ছোট ছোট অপারেশন-------।
স্বপনের মা অনেকটা সাদাসিধা। তিনি ছেলেকে সবকিছু জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। অঞ্জলীর চতুর অভিনয়ে সকলকে বোকা বানিয়ে এগিয়ে গেছে অনেকটা। এক রকম ভয় দেখিয়েই পরিবর্তন ঘটিয়েছে স্বপনের। সে যেন স্ত্রীর বশীভূত। দিনে দিনে যেন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে লাগলো। স্বপন কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাকে একদিন এমন অমানুষ হতে হবে। মান-সম্মানের মাথা খেয়ে নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে সে আজ যা করল- সারা জীবন তাকে পিছনে পিছনে তাড়া করে মারবে। সরল মায়ের প্রাণের খোকা অনেক আগেই সভ্য সমাজের অসভ্য স্রোতে ভেসে গেছে। টিকিট কাটার নাম করে গেছে তো গেছেই----! সময় গড়িয়ে চলেছে তবুও মাকে নিতে ফিরলো না। যারা এগিয়ে এলো তারা তাঁর রক্তের কেউ নয়। ছেলের রক্তের লাল রং অনেক আগেই যে কালো হয়ে গেছে----।
প্লাটফর্মে জটলার মাঝে এসে হাজির হলেন সাংবাদিক প্রকাশ মন্ডল। তার মোবাইল ফোন থেকে ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়ল মিডিয়ার কাছে। ফোন গেল নিকটবর্তী দমদম থানায়। সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন চত্বরে এসে পৌঁছালো পুলিশ বাহিনী। ততক্ষণে এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে পশুতুল্য সন্তানের এমন নির্লজ্জ মর্মান্তিক কু-কীর্তির কথা। ছুটে এলেন একটা নামী স্বেচ্ছাসেবী সংঘের সম্পাদক। এসে পড়লেন একটা প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমের কর্মকর্তা। ততক্ষণে বৃদ্ধাকে পুলিশ টেকআপ করেছে। তারাই করবে আইনের পথ ধরে করণীয় কর্তব্য টুকু। দীনবন্ধু বাবুকে বৃদ্ধা যেন কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না। শূন্য মাতৃত্বের হৃদয়ে তিনি যেন মুহূর্তে জায়গা করে নিয়েছেন। বৃদ্ধা তার হাত ধরে পুলিশ জীপে গিয়ে উঠলেন। তখনও বৃদ্ধা পথ পানে চেয়ে---- যদি খোকা ফিরে আসে।
এই খোকা জন্ম নেবার প্রাক্কালে যে অসহ্য প্রসব বেদনা মাতৃগর্ভে অনুভূত হয়েছিল আজ মনে হয় তার থেকেও বেশি ব্যথা বৃদ্ধার বুকে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু পারছেন না সবটা প্রকাশ করতে। করবেনই বা কি করে! তিনি যে গর্ভধারিনী মা। মা হয়ে সন্তানের এই অপকীর্তির কথা অন্যকে কি করে বলবেন? কিন্তু ধৈর্য আর সহ্যের তো একটা সীমা আছে? বুকে জমা অসহ্য ব্যথা ফুটে উঠছে তাঁর চোখে-মুখে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে অব্যর্থ ব্যথা নিয়ে পুলিশ জিপে করেই তিনি চোখের অগোচরে মিলিয়ে গেলেন। জটলাপাকা জনতার মাঝে তখনো চলছে স্ত্রৈন সন্তানের তীব্র সমালোচনা। যে শুনছে সেই ছ্যাঃ ছ্যাঃ করছে।
বৃদ্ধা মায়ের এই পরিণত সন্তান হয়তো অতি সহজেই এমন দুষ্কর্ম সম্পাদন করল কিন্তু সকলের দৃষ্টির আড়ালে মনের অজান্তে কি একটু ব্যথাও অনুভূত হচ্ছে না? কে জানে সে এখন কোথায়? গর্ভধারিনী মাকে এমনি নির্দয়ভাবে পথে ফেলে কি অশান্তির প্রায়শ্চিত্ত করল? অদৃশ্য অন্তর্ধানে কতটুকু পেল শান্তি? এতসব করেও সংসারে সৃষ্ট অশান্তি নিরসনে মিলবে কি তার অশান্ত মনে বিন্দুমাত্র স্বস্তি---------------!
রচনাকাল : ১০/৪/২০২১
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।