চাঁপাডালি মোর থেকে শপিং মলের দিকে এগোতেই এক যুবক লেখার পথ আটকায়, জিজ্ঞেস করে, "আপনি পত্রালি দিদি তো! মাফ করবেন। আমি এই মলের মালিক। প্রায়ই আপনাকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখি , কিন্তু সাহস করে সামনে আসতে পারিনি।"
হতভম্ব লেখা একদৃষ্টে যুবকের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে, "আপনি আমাকে চেনেন? আমি কিন্তু আপনাকে চিনিনা।"
- কি করে চিনবেন ! সেতো প্রায় ২০বছর আগের কথা।
বিরক্ত লেখা মনে মনে ভাবে এ কোন বাচালের পাল্লায় পড়লাম এই সন্ধ্যায়! ২০বছর আগের কি এমন কথা যে ওর মনে গাঁথা আছে, তা ছাড়া ওর বয়সই বা কত? আর কথাটাই বা কি! একটু যেনো উৎসাহ বোধ করে।
- আপনার কিছু মনে নেই ! না ,তাছাড়া কি মনে থাকবে?
লেখার গলায় ঝাঁঝ - আপনি আমার পথ ছাড়ুন, আমার তাড়া আছে।
- অরুণকে আপনার মনে নেই?
- কে অরুণ? প্রশ্ন করে লেখা
- ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় আমরা যখন একই নৌকায় করে দেশ ছেড়েছিলাম, কার্তিক মাসের মাঝমাঝি আমরা দেশ ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠলাম। প্রায় ৯ দিন নৌকায়, জলে ভাসতে হয়েছিলো। মাঝে মাঝে নৌকা ছেড়ে ডাঙায় উঠে হাঁটতেও হোয়েছে। নৌকা আর হাঁটা এভাবেই একসময় আমরা নৌকার সবাই ১৩ দিনের মাথায় ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম, নদীতে নৌকা চলাকালিন আমি খুব ভয় পেতাম, আপনি আমাকে সাহস যোগাতে নানা মজার মজার গল্প বলতেন ,সাদা কাগজে পেন্সিল দিয়ে নানা পশু পাখির ছবি এঁকে দিতেন আর তাদের নাম আমি জানি কিনা জিজ্ঞেস করতেন। বেশীর ভাগই বলতে পারতাম, তবে উচ্চারণে জঢ়তা থাকতো! যেমন ঘোড়াকে ঘোনা", ভেড়াকে ভেনা" বলতাম। ওদের ইংরেজি নামও বলতে পারতাম জড়িয়ে জড়িয়ে ,নৌকাতেই বসে তুমি শিখিয়েছিলে। আমার উচ্চারণ নিয়ে খুব মজা করতে তোমরা সবাই ,আমি না বুঝে হাসতাম। বার বার আমার নাম জিজ্ঞেস করতে আর আমি বারবার অরুণ কে 'উনুন' বলতাম, - কি মনে পড়ছে কিছু !
- হ্যাঁ হ্যাঁ সব মনে পড়েছে ! কিন্তু এতদিন পরে তুমি আমাকে চিনলে কি করে!
পুরনো স্মৃতি মনে পড়ায় আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। লেখার উৎসাহের যেনো শেষ নেই।
- কিন্তু বলত এত বছর পর তুমি আমায় চিনলে কি করে ! তখন আমার বড়োজোর ১২বৎসর আর তুমি তো এতটুকু ছেলে, মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স । এই টুকুন বয়সের স্মৃতি কারো মনে থাকে !
- থাকে দিদি, মা তো সব সময় তার দেশের কথা বলে আর প্রসঙ্গ উঠলেই নৌকার মজা নিয়ে আমাকে খেপায়, আমার মনে না থাকলেও মা মাঝে মাঝে ই বলে পত্রালী দিদির নাক জুড়ে জরুল আর কপালের ঠিক মঝখানে আঁচিল ছিল। বড় ভালো লাগতো, তাই কদিন ধরে লক্ষ্য করছিলাম আর তোমাকে পেয়েও গেলাম।
বাক রুদ্ধ হয় যায় 'পত্রলেখা'। ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে বিমূঢ় হয়ে বলে "আজ যেনো সেই বানারীপাড়ার খালে নৌকা চলার দৃশ্য দেখছি, এক লহমায় ভেসে ওঠে দেশ ছাড়ার টাটকা স্মৃতি, সেই বানারীপাড়ার খাল ,তারপর বড়ো নদী, অরুণ এর আধো আধো কথা । বুকের ভিতর হুহু করে উঠে। কখনো ভাবিনি তোর সাথে আবার দেখা হবে তোর তো কথা এখন স্পষ্ট পরিচয় না দিলে আমি তোকে চিনতে পারতাম না তখন আমি সবে বারো আর তুই তো একদম পুচকি !"
রচনাকাল : ২২/৩/২০২১
© কিশলয় এবং ইলা কর কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।