চন্দননগর – চুঁচুড়া – ব্যান্ডেল ছাড়িয়ে জি. টি. রোডের যে শাখাটা এস. টি. কে. কে. রোড হয়ে কালনা পেরিয়ে সোজা কাটোয়ার দিকে ছুটে গেছে , সেই রাস্তার ডানদিকের একটা ছোট্ট জনপদ ঘোষপুকুর গ্রাম । কালনা থেকে বড়জোর দশ মিনিটের রাস্তা । গ্রামের হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শেষ পিরিয়ডের ক্লাস চলছে স্কুলের কম্পিউটার শেখার ঘরে । দিনের পড়ন্ত আলোয় সাহিত্যের রস আস্বাদন করার চাপ ছাত্রছাত্রীরা আর নিতে পারবে না ভেবে সুজিত স্যার কম্পিউটার রুমে সবাই কে ঢুকিয়ে প্রো্জেকটরে ‘কোনি’ সিনেমাটা দেখিয়ে তাদের অগ্রিম বাড়ি যাওয়ার সুপ্ত বাসনাটাকে একটু দমাতে চেষ্টা করছেন । গল্পটা তাদের বাংলা পাঠ্যবইতেই রয়েছে । তাই গল্পের চলমান রূপ দেখতে তাদের কোন আপত্তি ছিল না । যদিও সাঁতারের পোশাক পরা সাঁতারুদের দেখে চাপা হাসি, ফিসফিসানি এড়ানো যাচ্ছে না । ব্যাতিক্রম আছে অবশ্য কয়েকজন । যেমন উত্তরণ । উত্তরণ গুপ্ত । ক্লাসের সেকেন্ড বয় ।
পড়াশুনা ছাড়াও আর একটি বিষয়ে সে সেরা । ফুটবল । গ্রামের লোকদের মত অনুযায়ী খেলাটা মনে হয় সে মায়ের গর্ভে থেকেই শিখে এসেছে । তাই গ্রামের সংহতি ক্লাব থেকে ঘোষপুকুর হাইস্কুলের অনুর্ধ্ব সতেরো ফুটবল টিমের সেই আসল নিউক্লিয়াস । সেই উত্তরণ আজ সিনেমাটা দেখছে টানটান হয়ে । সিনেমার শেষ দৃশ্যে তার শরীরটা যেন আরও শক্ত হয়ে উঠল, যেখানে হতদরিদ্র সাতারু কোনি সুইমিং পুলে ভারত সেরাকে হারানোর আপ্রান চেষ্টা করছে । চারদিকে ‘কোওওওনি’ ‘কোওওওনি’ চিৎকার । উত্তরণ দেখতে পেল সাঁতরাতে সাঁতরাতে কোনির মুখটা কেমন যন্ত্রণায় কুঁচকে যাচ্ছে । তবু সে হার মানছে না । তার কোচ, অভিভাবক খিদ্ দা গ্যালারি থেকে চিৎকার করে চলেছে ‘ফাইট কোনি ফাইট’ ।শেষ পর্যন্ত জয়ী হল কোনি । বাংলা কে চ্যাম্পিয়ন করল কোনি । শরীরের সমস্ত কষ্ট, দারিদ্র্যের সব যন্ত্রণার আজ যেন অবসান হল।
স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল উত্তরণ । বেশি দূর নয় । সামান্য পথ হেঁটেই ফেরে সে । বাড়ি ফিরে সে যাবে ক্লাবের মাঠে । প্র্যাকটিসে । গতকাল কালনা থানা লিগে উত্তরণের ক্লাব ফাইনালে উঠেছে । তারই করা গোলে । সামনের রবিবার ফাইনাল ।
সুজিত স্যারের বাড়ি গুপ্তিপুরে । উত্তরণের বাড়ির পাশ দিয়েই যেতে হয় । প্রিয় ছাত্র কে দেখে সাইকেল থেকে নেমে তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন ।
“দেখলি সিনেমাটা ?”
উত্তরণ হাঁটতে হাঁটতে সিনেমাটার কথায় ভাবছিল ।বিশেষ করে সেই দৃশ্যটা । যেখানে কাঁদতে কাঁদতে কোনি খিদ্ দা কোথায় ছিল জানতে চাইছে । “পারে, মানুষ সব পারে । ‘ফাইট কোনি ফাইট’- কথাগুলো বলার সময় খিদ্ দার চোখগুলো জ্বলছিল । চোয়াল দুটো শক্ত । উত্তরণের সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ।
“স্যার, একটা কথা জিগ্যেস করব?”
“হ্যা, অবশ্যই করবি ।” স্যার সবসময় তার স্নেহের পাত্রের মনের অন্ধকারটাকে দূর করার জন্য সব সময় উদগ্রীব হয়ে থাকেন ।
“খেলা তো শেষ । কোনি চ্যাম্পিয়নও হল ।তা সত্তেও খিদ্ দা তাকে ফাইট করতে বলছেন কেন ?”
“দুর পাগল!” হেসে ফেললেন স্যার ।“ শুধু একটা টুর্নামেন্ট জিতলেই কি সব হয়ে গেল নাকি ? এই তো শুরু । এরপর অনেকদুর যেতে হবে । অনেকবার তাকে চ্যাম্পিয়ন হতে হবে । ভারতের সেরা সাঁতারু হতে হবে যে তাকে । আর শুধু মেডেল জেতার লড়াই তো নয় । তাকে যে লড়তে হচ্ছে অনেক কিছুর বিরুদ্ধে । দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অশিক্ষার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে । সমাজে টিকে থাকার জন্য এই লড়াই তো সবাই কে প্রতি মুহূর্তে করতে হচ্ছে । এই যেমন ধর তুই।” বলে একটু যেন হোঁচট খেলেন স্যার । তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে আবার বলতে লাগলেন , “ তুই আজ স্কুলে পড়ছিস । সামনেই তোর মাধ্যমিক পরীক্ষা । ভাল রেজাল্ট করার জন্য তোকে অনেক খাটতে হবে । বড় হবি ।তারপর কাজের খোঁজ । সেখানে আরও বড় পরীক্ষা । প্রতিযোগীর সংখ্যা অনেক বেশী । তুই তো ফরোয়ার্ডে খেলিস । অনেক ডিফেন্ডার কে বোকা বানিয়ে তুই যেমন গোল করে আসিস , এই খেলাতেও সবাই কে হারিয়ে তোকে চ্যাম্পিয়ন হতে হবে । লক্ষ্যে তোকে স্থির থাকতে হবে । যা তোর বাড়ি চলে এসেছে।” এই বলে সাইকেলে উঠে স্যার প্যাডেলে চাপ দিলেন ।
পড়া আর খেলা কে নিয়ে স্বপ্ন যে সে একেবারে দেখে না তা নয় । বই রাখা তাকের দেয়ালে পেলে , মারাদোনা , মেসি আর এদেশের তার সবচেয়ে ফেভারিট ভিজয়নের ছবি খবরের কাগজ থেকে কাটিং করে আঠা দিয়ে চেটানো রয়েছে । সংহতি ক্লাবের ফুটবল কোচ দেবুদা মানে দেবব্রত মুখোপাধ্যায় একসময়ে মোহনবাগানে নিয়মিত খেলতেন । বলতে গেলে উত্তরণ কে ফুটবল টা চিনতে শিখিয়েছেন । তিনিও বলেন তুই যখন খেলিস, তোর বাঁ পায়ে মারাদোনা আর ডান পায়ে পেলে ভড় করে ।
“ধ্যাৎ ! কি যে বল তুমি ।” খুব লজ্জা পায় উত্তরণ ।
“ঠিক আছে । ঠিক আছে । বাংলাতেই থাকি । তুই কৃশানু আর ভিজয়নের মিক্সচার । হা হা হা হা।”
তবে বাড়িতে এলেই সমস্ত স্বপ্নের দফারফা হয়ে যায় । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে উত্তরণ তার মা কে কোনদিন হাসতে দ্যাখেনি । টানা পনেরো-ষোল বছর ধরে রুগ্না , শীর্ণা , চোয়ালের হাড় উঁচু এক চলমান জড় পদার্থ কে দেখে এসেছে সে । বয়স অল্প হলেও মায়ের এই পরিনতির কারন তার অজানা নয় ।
ঘোষ পুকুর গ্রামের প্রায়-শিক্ষিত মাঝের পাড়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কোনদিন ছিল না । অন্য ছেলেদের মত উত্তরণও পড়াশুনা করে , খেলাধুলা করে । অন্যদের বাবার মত তার বাবাও চাকরি করেন । বেলা শেষে উত্তরণ রা , উত্তরণদের বাবারা – সবাই বাড়ি ফেরে । সব জায়গার মত এখানেও সন্ধ্যের সময় বাড়ি বাড়ি শাঁখ বেজে ওঠে । ছেলের দল পড়তে বসে । বড়রা কেউ টি ভি দ্যাখে । কেউ বা আবার কোথাও আড্ডা মারতে যায় । উত্তরণের বাবাও যায় । তবে অন্য আড্ডায় । প্রথম যেদিন উত্তরণ তার বাবাকে আড্ডা থেকে বাড়ি ফিরতে দেখেছিল,তখন তার বয়স আর কতই হবে? এই পাঁচ কি ছয় । বুক কেঁপে গিয়েছিল তার । বাবার চোখগুলো টকটকে লাল । গা দিয়ে বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে । প্রচণ্ড চিৎকারে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে ।
“কি রান্না করেছিস ? নিজেরা ভাঁড় ভরিয়ে আমার জন্য শুধু ভাত আর আলু পোড়া ! এ দিয়ে খাওয়া যায়?”
বাবা কে কেমন যেন হিংস্র প্রাণীর মতন লাগছিল উত্তরণের ।
“ যা এনে দিয়েছ তাই রান্না করেছি । কাল এটাও জুটবেনা।” ততোধিক ঠাণ্ডা গলায় মা উত্তর দিয়েছিল ।
“চোপ ! যত বড় মুখ নয় ততো বড় কথা । বেশী বাড়াবাড়ি করলে বাড়ি থেকে দূর করে দেব । নিকুচি করেছে খাবারের।” থালাটাকে লাথি মেরে গালাগাল করতে করতে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল ঐ জান্তব মুখের মানুষ টা ।
বুকের ভিতরটা প্রচণ্ড লাফাচ্ছিল । মনে হচ্ছিল লাফালাফি করা মাংসপিণ্ডটা যে কোন মুহূর্তে শরীর থেকে বেড়িয়ে আসবে । গা টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছিল । এখনই হয়ত বমি করে ফেলবে । রাতের বেলায় স্থানুর মত শুয়ে থাকা মাকেও ছুঁতে কেমন যেন ভয় লাগছিল উত্তরণের ।
সেই শুরু । উত্তরণ এখন অনেক স্বাভাবিক । তবে বুকের ধুকপুকুনিটা এখনো রয়ে গেছে। বাড়ি ঢোকার সময় কেমন যেন ভয় লাগে । একেক দিন বাড়ি ফিরে সে দেখেছে মা লুকিয়ে লুকিয়ে কোন শব্দ না করে কেঁদে চলেছে । আলনার জামাকাপড়গুলো মেঝেয় ছড়ানো । মায়ের ভাল শাড়ি দুটো ছিড়ে ফর্দাফাই ।বাড়ির রান্না করার মাটির উনুনটা দু টুকরো । মায়ের টাকা রাখার কৌটটা পর্যন্ত হাওয়া হয়ে গেছে ।
মানুষের ছ ছটা রিপুর কোন রিপুটার প্রতি বাবার আসক্তি সেটা বোঝার বয়স এখনো তার হয়নি , তবে এটা হয়ত সে বুঝেছে সিনেমায় দেখা কোনির থেকে তাকে আরও বেশী লড়াই করতে হবে । কিন্তু কোনির খিদ্ দা ছিল । তার সঙ্গে কে আছে ? এখনো কোন উত্তর পাইনি সে । সুজিত স্যার! দেবু দা ! মনে মনে হাসে উত্তরণ ।সবাই শোনে । ‘আহারে!’ বলে শ্বান্তনাও দেয় অনেকে । আবার কেউকেউ এক কান দিয়ে শোনে আর অন্য কান দিয়ে বেরও করে দেয় ।মা-ছেলের দিকে একবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সেই হাত যে আর গুটিয়ে নেওয়া যাবে না সেটা তারা বিলক্ষন বুঝেছিল ।
বাবার মনের ভাষা পড়ার ক্ষমতা হয়ত স্বয়ং বাবারও নেই । তাই একদিন অফিসে যান তো পরের পনেরো দিন পুরো বাড়িতে বসে থাকেন । “আমি তোমাদের জন্য কিস্যু করতে পারব না । এত বড় গুষ্টিকে পোষার ক্ষমতা আমার নেই । নিজেরা এবার রোজগার কর।” কথার ফুলঝুরি ছোটে সারাদিন । আর রাত বাড়লেই টলমল অবস্থায় শুরু হয় মায়ের ওপর শাসন । “ নিয়ে যা । নিয়ে যা । কোন চিন্তা নেই । হুঁ হুঁ বাওয়া! তোর বাবার যা উপরি । ও ঠিক একদিন সব মিটিয়ে দেবে।” পাড়ার দোকানদারের অগাধ আস্থা তার প্রিয় যাদবদার ওপর । ‘উপরি’ শব্দটা শুনলে উত্তরণের আর গা জ্বালা করেনা । রাতের বেলায় বাবার ওই মূর্তি আর গরম ভাত মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখে গা গুলোয় অনেক বেশী ।
“বাবা , তুমি এমন কেন ?” খুব জানতে ইচ্ছে করে উত্তরণের । সাহস হয়নি কোনদিন । মায়ের ওপর বাবা যখন মিথ্যে পৌরুষ ফলায় তখন দেহের সমস্ত জমে থাকা শক্তিটাকে ফাটল ধরিয়ে সবকিছুকে ভূমিকম্পের মত এলোমেলো করে দিতে চায় সে । পৃথিবীর সমস্ত দেবতার কুনজর যাতে বাবার ওপর পড়ে সে কামনাও করে । কিন্তু বয়স তো আর মনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না । তাই সমস্ত কাজের মধ্যে সে এক চরম সংকোচ খুঁজে পায় । মাস খানেক আগে গুপ্তিপুরে একটা লোকাল টুর্নামেন্টে খেপ খেলে কিছু টাকা পেয়ে তার মায়ের কেঁপে যাওয়া হাতে তুলে দিয়েছিল । সে দেখেছিল মায়ের মুখটা কেমন অস্পষ্ট যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে । দেবুদার কাছে শুনেছে পেলে নাকি অভাবের তাড়নায় চায়ের দোকানে কাজ করেছিলেন এক সময় । এমন কি তার হিরো ভিজয়ন বাড়ি বাড়ি সোডার বোতল বিক্রি করতেন । অথচ একটা চাকরি করা বাপের ছেলে হয়ে একটা প্ল্যাস্টিক স্টাডের বুট জুটছে না তার । “তোর বুট টা এবার মিউজিয়ামে পাঠানোর সময় এসে গেছে রে।” এর জবাব দেওয়ার সাহস উত্তরণ কোনদিন জোটাতে পারবে বলে মনে হয় না । “বাবা কে বল এবার একটা নতুন বুট কিনে দিতে । নাহলে পায়ের ক্ষতি হয়ে যাবে কোনদিন।” সহানুভূতি দেখায় অনেকে ।
“জীবনে পরাজয় বলে কোন শব্দ হয় না রে । হয় তুই জিতবি না হয় নতুন কিছু শিখবি।” প্র্যাকটিস শেষে ভকাল টনিক শুনে দেবুদা কে অনেকটা লেখকের মত লাগে । উত্তরণ হয়ত সবকিছু এখন শিখছে ।“কোনির মত যন্ত্রণাটাকে যখন জয় করতে শিখব তখন এই অসহ্য সময়টাকে হারিয়ে দেব।” মনে মনে হাসে সে ।
বাড়ির কাছে এসে উত্তরণের বুকটা ধক করে উঠল ।স্কুল থেকে বাড়ি মেরেকেটে দশ থেকে পনেরো মিনিটের পথ । পৌছতে লাগে যেন দুঘণ্টা । নিঝুম , বদ্ধ , অন্ধকার একটা গলি পেরিয়ে সেই বাড়িটা ।শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় । এখানেই রয়েছে অল্পেই বুড়িয়ে যাওয়া মা , নিজেকে সঁপে দিয়েছে সেই অন্ধকারের অজানা ঠিকানায় । এখানেই কয়েকটা অসহনীয় ঘণ্টা উত্তরণ কে কাটাতে হয় । কিন্তু গতকালের বিকালটা তার একটু অন্যরকম মনে হয়েছিল । তাই আজ বাড়ি ঢোকার ধুকপুকুনিটাও অন্য দিনের থেকে আলাদা ।
কাল ঠিক এইসময় উত্তরণ দাড়িয়ে ছিল কালনার অঘোরনাথ পার্ক স্টেডিয়ামের মাঠের ঠিক মাঝখানে কালনা থানা লিগের জুনিয়র নকআউটের সেমি ফাইনালে সংহতি ক্লাবের সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে । যে কিনা গোল করবে আবার করাবেও । আবার প্রয়োজনে রক্ষণ সামলাবে । জুনিয়র দলের খেলা হলেও মাঠে লোক হয়েছিল ভালোয় ।উত্তরণ জানে মাঠ ভর্তি মানুষের সামনে নিজেকে উজার করে দেওয়ার মজাই আলাদা । আর দেবুদা তো বলেই দিয়েছে লিগ চ্যাম্পিয়ন হলেই স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের তরফে সাবডিভিশন ট্রায়ালে ডাক পাবেই সে ।
প্রতিটা খেলা শুরুর আগে কথাগুলো সবাই কে শোনায় দেবুদা । “আজ যা খেলবি , সেটা কে মন থেকে মুছে ফেলবি । না হলে আর খেলতে পারবি না । খেলা শিখতেও পারবি না । পরের দিন সব কিছু নতুন । নতুন দল । নতুন খেলোয়াড় । প্রতিদিন এক স্টাইলে খেলা চলবে না।” কথাগুলোর মর্ম উত্তরণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল । একে তো এবড়োখেবড়ো মাঠ । তার উপর আধভাঙ্গা স্টাডের বুট । বল ঠিকঠাক রিসিভই করতে পারছিল না । শিমুলতলা ভাতৃসঙ্ঘের বড় চেহারার ডিফেন্ডাররা সব বল ক্লিয়ার করে দিচ্ছিল । কি করে এত বুড়ো বুড়ো ছেলেগুলো আন্ডার সেভেনটিনে খেলার সুযোগ পেল কে জানে !
হাফটাইমের পর উত্তরণ নিজের শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করল । কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করে ব্যাপারটাকে বেশ ভালভাবে রপ্ত করে ছিল । ‘নাটমেগ’ । বলটাকে বিপক্ষের দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বার করে তাদের বোকা বানিয়ে বারবার পেনাল্টি বক্সে হানা দিতে লাগল সে । বাকি ছিল শুধু গোলের দরজাটা খোলা । ঠিক সেই মুহূর্তে উত্তরণের মনের ছোট্ট দরজায় কেউ যেন কড়া নেড়ে দিয়ে গেল ।
থ্রো- ইন পেয়েছিল সংহতি । মাঠের পুব দিক থেকে ।উত্তরণ নিজেই যায় থ্রো টা নিতে । ভিড়ের মধ্যে তাকাতেই কেমন যেন থ মেরে যায় । খোঁচা খোঁচা দাড়ি । কালি হয়ে যাওয়া ফোলাফোলা চোখ । উটের মত গলা বার করে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয়নি । সেই রগচটা মাতাল পাশব শক্তির মানুষটা এসেছে উত্তরণের খেলা দেখতে ! লোকটা কি খেলা দেখতে ভালবাসে ? আগেও কি নিজের ছেলের খেলা দেখেছে লোকটা ? অনেক প্রশ্ন একসাথে ভিড় করে এল মনে । ষাট – সত্তর মিনিট ধরে গোল না পাওয়ার যন্ত্রণাটা উত্তরণ যেন তার থেকে ওই দোমড়ানো মুখে আরও বেশী করে দেখতে পেয়েছিল ।
পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত ।বিকাশের উঁচু লব টা ভাতৃসঙ্ঘের পেনাল্টি বক্সের যে জায়গায় পড়ছিল সেখান থেকে আড়াআড়ি দাঁড়ানো উত্তরণের ব্যবধান ছিল কয়েক গজের । এগিয়ে আসা ডিফেন্ডারের চার্জকে তোয়াক্কা না করে শরীরটাকে শূন্যে বেঁকিয়ে দুর্দান্ত একটা ভলি ।গোলকিপার কে বোকা বানিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে যায় । গোলটা করেই উত্তরণ ছুটে যায় মাঠের পূবদিকে। হৈচৈ এর মধ্যে বাচ্চাদের মত চীৎকার আর লাফালাফি করছে তার বাবা। মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখেছিল সে ।
কালকের ঘটনার পর থেকে আজ বিকেল পর্যন্ত কেটে গেছে চব্বিশ ঘণ্টা । বাবার সঙ্গে উত্তরণের আর দেখা হয়নি । কাল কখন বাড়ি এসেছিল , আজ কখন বেড়িয়ে গেছে – জানা নেই । মায়ের কাছে একটু আভাস পেয়েছে সে । যে ব্যাগটা কাঁধে করে অফিস যেত বাবা সেটা নিয়ে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে । বুকের ধকধক শব্দটাকে নিয়েই বাড়ি ঢুকল সে । বাবা ফিরেছে কিনা – এ প্রশ্নের উত্তর বাড়ির এলোমেলো অবস্থা দেখেই টের পাওয়া যায় । যদিও আজকে সে রকম কোন চিহ্ন চোখে পড়ল না । ঢোক গিলল উত্তরণ । কোন অজানা রহস্য উন্মোচনের এক অদ্ভুত আবেগ আজ যেন উত্তরণ কে বাড়ির বাইরে যেতে দিল না । কান দুটো যেন কারো পায়ের শব্দের অপেক্ষায় আছে । চোখ দুটো দরজার বাইরে অন্ধকারে কাকে যেন খুঁজছে ।
“বাবু ।”
চমকে উঠল উত্তরণ । ছোটবেলায় অল্প কয়েকবার একজনের মুখে এই ডাক শুনেছিল সে । স্বরটা চেনা । কিন্তু ভঙ্গীটা অচেনা ।
বাইরে বেরিয়ে এল সে ।
এই তো সেই লোকটা । ঘোলাটে আলোতেও লোকটার চোখ দুটো চকচক করছে । পা দুটোও নড়বড় করছে না ।
অদ্ভুত! নেশার ঘোরে টলতে টলতে ভাতের থালাটাকে লাথি মেরে পৌরুষ দেখানো লোকটা আজ এক যুগ পর উত্তরণ কে তার হারিয়ে যাওয়া নাম ধরে ডাকছে । অবয়বটা পুরনো হলেও মানুষটাকে আজ নতুনের মত লাগছে ।
হাতে ধরা প্যাকেট থেকে একটা পিচবোর্ডের বাক্স বের করে উত্তরণের হাতে তুলে দিলেন বাবা ।
“দ্যাখো এটা।”
বাক্সটা খুলে উত্তরণ বার করে আনল নতুন একজোড়া বুট ।প্ল্যাস্টিকের নীল রঙের স্টাড গুলো আলো আঁধারি তে ঝকঝক করে উঠল । সোনালি চামড়ায় মোড়া জুতোগুলো কে মনে হচ্ছে কেউ যেন সোনার প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে ।
“তোমার বুট দুটো তো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে । ওটা পড়ে খেললে যে কোনদিন মারাত্মক চোট পাবে ।তুমি তো সাত নম্বরটাই পড়ো । একবার পড়ে দ্যাখো তো ঠিকঠাক হয়েছে কিনা । এটা পড়েই কাল থেকে প্র্যাকটিস করবে । এখনো ফাইনালটা বাকি রয়েছে। আর হ্যাঁ আমি তোমার খেলা আগেও দেখিছি।কাল কিন্তু মনে হল একটু যেন গুটিয়ে খেলছিলে ।তোমাকে আরও বেশি সুযোগসন্ধানী হতে হবে ।আরও বেশি পজিটিভ হতে হবে।” কথাগুলো বলে নির্বাক উত্তরণ আর হতভম্ভ মা কে পাশ কাটিয়ে বাবা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন ।
রাত শেষ হয়ে যায় । আসে নতুন সকাল । শুরু হয় নতুন দিন । উত্তরণ প্র্যাকটিস করে চলে । পায়ে তার নতুন নীল রঙের স্টাডের সোনালী বুট । সামনেই যে তার ফাইনাল ।
রচনাকাল : ২২/৩/২০২১
© কিশলয় এবং অরূপ কুমার পাল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।