আজ রবিবার। বাইরের ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।পিকু নীলের ছোটবেলায় পাওয়া মেডেলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে , সোফায় বসে থাকা নীল খবরের কগজের পাতা উল্টোতে গিয়ে পিকুর দিকে চোখ যেতেই একটু অবাক হয়ে গ্যালো।
নীল : দ্যাখো বাবা , ওগুলো যেনো হাত থেকে পড়ে না যায়, ওগুলো আমার সেই ছোটবেলার প্রাইজ , ওদের সাথে আমার ছেলেবেলা জড়িয়ে আছে ।
পিকু এ বছরই ছয় এ পা দিলো। আর নীল আজ দেশের সব শিশুদের সুস্থ ও সুন্দর রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। সে আজ বিখ্যাত একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। নীলের বাবা ছিলেন একজন সাধারণ সরকারি চাকুরীজীবী। তিনি নীল আর তার মা কে ছেড়ে চলে গিয়েছেন এই পাঁচ বছর হোলো। আর এখন নীলের সংসার বলতে মা অনিতা দেবী , ছেলে পিকু আর অহনা কে নিয়ে তার সুখের সংসার।
নীল আধুনিক যুগের একজন নামকরা ডাক্তার হয়েও কিছু আগের ধ্যান-ধারণা আজও সে মানে। তেমনি সে ভুলতে পারিনি তার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি । আর আহনাও এই আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়েও নীলের এই চিন্তা-ভাবনাকে সম্মান জানায়।অহনা , তার গান , আবৃত্তি , শ্রুতিনাটক নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও পিকুকে সে এই বাড়ির মতাদর্শেই মানুষ কোরতে চায়। তবে সর্বপ্রথম পিকুর মতামতের তো দাম দিতেই হবে। কারণ নীল আর অহনা এটা বিশ্বাস করে যে , সন্তানের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো বীরত্ব নাই। সন্তানের ইচ্ছা কে সম্মান জানিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে নতুন দিশা দ্যখানোর মধ্যেই তো আনন্দ।
নীল এমনিতেই খুব ব্যাস্ত , ছুটি সে পায় না বললেই চলে । আজ সে তাই এই বৃষ্টিভেজা ছুটি টা তার কাছের মানুষগুলোর সাথেই কাটাবে বলে ঠিক করে। মাঝে মধ্যে ছোট্ট বেলাকার স্মৃতিগুলো হাতড়াতে বেশ ভালোই লাগে । তাই পিকু মেডেলগুলো যখন ছুঁয়ে আছে ওর ছোট্ট ছোট্ট হাতগুলো দিয়ে , নীলের মনে হচ্ছে , ছোট্ট হাতগুলোর ছোঁয়াতে মেডেলগুলোর মূল্যায়ন বাড়ছে বই কমছে না। নীল একদৃষ্টে পিকুর সেই ছেলেমানুষি দেখছে , আর অতীতের সেই হাসি-কান্নার দিনের কাছাকাছি গিয়ে সেই দিনগুলোকে ছুঁতে চাইছে।
মা : (স্নেহের স্পর্শে নীলের চুলে বেলি কাটতে কাটতে) চুপ কোরে বোসে কি এতো ভাবছিস? আজ হসপিটালে যাবি না ?
নীল : নাহ মা ,বোলে এসেছি , এমার্জেন্সি হোলে আমাকে জানাতে , তখন নয় ভেবে দেখবো। মা ! আজ পিকুকে দেখে আমার ছোটবেলার কিছু মুহুর্তের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে .....
মা : হু , তুই তো কোনোদিনই পড়াশোনায় খারাপ ছিলি না , কিন্তু মনে রাখতে পারতিস না। ছোট্টবেলাতে একবার তোর খুব জ্বর হয়েছিলো , তারপরেই সমস্যা শুরু ।
নীল : কিন্তু প্রথম দিকে তো তোমরা কেউ বুঝতেই চাওনি। সেদিন যদি পায়েল মাসী না থাকতো , তবে হয় তো আমি আজকের ডক্টর নিলাদ্রী রায় হতাম না , মা।
নীলের মা নীলকে বোলতো ভালোভাবে পড়াশোনা করার জন্য , নীলের বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী , ওনাকে তাই অফিসের কাজে প্রায়ই বাড়ির বাইরে যেতে হোতো । তাই ছেলেকে মানুষ করা , বড়ো করা সবই অনিতার দায়িত্ব ছিলো। অনিতা নীলকে সবকিছু শিখিয়ে ছিলো। সাঁতার , ক্যারাটে , ড্রয়েং সবকিছু। আর নীল সবকিছুই খুব মনোযোগ সহকারে শিখতো। কি পড়াশোনা , কি অন্যান্য এক্টিভিটি সবেতেই প্রথম তিনজনের মধ্যেই থাকতো নীল। প্রাইজ সে এখনও পায়।
একটা সময় নীলের ভুলে যাওয়াটা এতোটাই বেড়ে গ্যালো , যে বইয়ের পড়া তার মনে থাকতো না , একটা বিষয়ের সাথে আর একটা বিষয়কে এক কোরে দিতো। তার মা-বাবা এই সমস্যা নিয়ে অনিতারই এক মনোবিদ বান্ধবীর কাছে নিয়ে যাবে ঠিক কোরলো। নীল অনিতার মনোবিদ বন্ধুর কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সেদিন নীল কাঁদতে কাঁদতে ডক্টর পায়েল সেনকে সমস্ত সমস্যার কথা বলে ,আরো বলে , "আমি চাই ,মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিতে। আর বাবার কষ্টের মূল্য দিতে। কিভাবে পারবো , আমাকে সাহায্য করো ।"
সেদিন থেকেই পায়েল হয়ে ওঠে নীলের ফ্রেন্ড , ফিলোসফার আর গাইড। সেদিন থেকেই সে বদলাতে শুরু করে , তার সমস্যার সমাধান ও তাড়াতাড়ি হয়। পায়েল মাসী তাকে একা থাকতে বারণ কোরেছিলো , হতাশা , চিন্তা তাকে একা কোরে দিতো আর ওই একাকীত্ব নীলকে গ্রাস কোরতো ।
এর পরে , নীলের জীবনে এসেছিলো নতুন মোড়। গান , খেলাধূলা , পড়াশোনা সবকিছু নিয়ে নীল খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো । জীবনে একজন হয়ে ওঠার অদম্য বাসনা আর নিরন্তর প্রচেষ্টা নীল কে আজকের শিশু বিশেষজ্ঞ হতে সাহায্য কোরেছে। নীলের মায়ের সাথে আর একজনের ভূমিকা ছিলো অপরিহার্য , তিনি হলেন পায়েল সেন। নীলের জীবনে এলো নতুন মোড় , মাধ্যমিক , উচ্যমাধমিক , জয়েন্ট সবকিছুতেই হয়েছিলো সে টপার ।
আজ নীল সফল । ওই মেডেলগুলো নীলের অতীত জীবনের বড় হয়ে ওঠার সাক্ষী। আজ এতো সুখের মাঝেও তার দুঃখ হয় , নীলের এই প্রতিষ্ঠিত জীবনে নীল তার বাবাকে পাশে পেলো না।অনিতারও নীলের বাবার জন্য চাপা একটা কষ্ট আছে , তার স্বামী ছেলের সাফল্যের আনন্দের ভাগ নিতে পারলেন না। নীলও তা জানে , তাই মাকে সে কখনও একা অনুভব কোরতে দ্যায় না।আর আজও নীলকে ঠিকঠাক পরামর্শ দিয়ে থাকে নীলের একমাত্র পথ প্রদর্শক ডক্টর পায়েল সেন।
অহনা : মা , চলো , ব্রেকফাস্ট তো রেডি । সরি , নীল তোমাদের মা-ছেলের কথার মাঝে একটু বিরতি হোক ।
অহনার ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলো নীলের। মা-ছেলে মিলে আজ হারিয়ে গিয়েছিলো সুদূর অতীতে। পিকুও মাঝে মধ্যে ঠাম্মির কথা শুনছিলো আবার খেলা নিয়েও মেতেছিলো। মেডেলগুলো নীল যথাস্থানে তুলে রেখে পিকুকে কোলে নিয়ে দুজনেই একে অপরের আদরে মত্ত হয়ে পড়লো। নিরন্তর প্রচেষ্টা , মোনবাসনা আর অদম্য ইচ্ছা একজন কে যে কোন চূড়ায় পৌঁছে দিতে পারে নীল সত্যিই তার একটা বড়ো উদাহরণ। বৃষ্টিভেজা ছুটির দিনটা বেশ আনন্দেই কাটলো নীল আর নীলের পরিবারের সকলের। পিকু খুব ছোট , তাই তার বাবার সব পুরষ্কারের গুরুত্ব এই বয়সে সে বুঝলো না , তবে পিকুর চোখে মুখে বাবার জন্য একটা আনন্দ খুটে উঠেছে।
রচনাকাল : ২২/৩/২০২১
© কিশলয় এবং লিজা মন্ডল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।