পুরাণের কথা ও কাহিনী (দশম পরিচ্ছেদ)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
দেব-দানবে নিত্য যুদ্ধ লেগেই আছে তখন। দেবতা মানেই ভালো, দনুজ মানেই খারাপ, আখেরে দেবতাদেরই জয় হতে হবে, এই একঘেয়ে ছাঁচে ঢালা আইনটা তখনো ঠিকমত কায়েম হয়ে পারে নি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে কোনবার দেবতারা জিততেন, কোনবার অসুররা। এর মধ্যেই অসুরকুলের গুরু ভার্গব শুক্রাচার্য এক কঠিন ব্রত সমাপন করে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছ থেকে জম্পেশ একখানা পুরস্কার থুড়ি বর পেয়ে গেলেন, মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র, মৃতকে পুনর্জীবিত করে তোলার অমোঘ বিদ্যা, অ্যাডভান্টেজ পয়েন্ট ট্যু দানবদল। যুদ্ধে নিহত অসুরদের ফু মন্তরে আবার বাঁচিয়ে দিতে থাকলেন শুক্রাচার্য। দেবরাজ ইন্দ্রের কপালে চিন্তার গভীর কুঞ্চন। কিছু একটা তো করতে হয়।
অনেক ভেবেচিন্তে ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে গেলেন। বৃহস্পতিসুত কচকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানো হল দৈত্যগুরুর আশ্রমে, ঐ মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা আয়ত্ত করতে। অসুররাজ বৃষপর্বার রাজধানীর উপান্তে, নদীর পারে, অরণ্যের কিনারায় গুরু শুক্রাচার্যের ছবির মত আশ্রমটি। পরিকল্পনামাফিক কচ এসে দাঁড়ালো শুক্রাচার্যের সুমুখে বিনয়ী শিক্ষার্থীর বেশে। নিজের পরিচয় ব্যক্ত করে গুরুকুলে ভর্তি হবার আর্জি জানালো। দেবগুরুর পুত্র তাঁর দুয়ারে শিক্ষাপ্রার্থী !! শুক্রাচার্য বুঝলেন, এর পিছনে গূঢ় কোন উদ্দেশ্য আছে এবং সেটা তিনি কিছুটা আন্দাজও করতে পারেন বৈ কি। তাছাড়া কচের পরিচয় জানতে পারলে ব্যাপারটা যে অসুরেরা কেউই পছন্দ করবে না তাও তিনি জানতেন। কিন্তু কেউ বিদ্যালাভের আবেদন নিয়ে এলে তাকে ফেরানোর নিয়ম ছিল না তখন। তাই কচকে সাদরেই গ্রহণ করলেন শুক্রাচার্য তাঁর ইশকুল কাম সংসারে। হ্যাঁ, সেটাই ছিল দস্তুর তখন, ছাত্রদের গুরুগৃহে থেকেই বিদ্যালাভ করতে হত, এমনকি রাজার ছেলেকেও। তাঁর মাটির ঘরের নিখুঁত নিকানো ঘরকন্নার সব দায়দায়িত্ব মেয়ে দেবযানীর।
মেয়েকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি কচের সাথে, তার নিপুন হাতে সঁপে দিলেন কচের নিত্যযাপনের যাবতীয় দায়ভার, বাকি ছাত্রদের সাথে। কচকে সাবধান করে দিলেন তাঁর নিজের অথবা দেবযানীর নজরের আড়ালে আশ্রমের পরিধির বাইরে বেশি দূরে কোথাও না যেতে। তিনি জানতেন, একদিন না একদিন কচের পরিচয় দানবেরা জানতে পারবেই আর তখন তাঁর বা দেবযানীর অনুপস্থিতিতে অসুরবালকরা হয়তো তার ক্ষতি করতে পিছপা হবে না। পট্টবস্ত আর উত্তরীয়ে সজ্জিত, সুপুরুষ, সুকান্ত কচ এসে যেদিন পৌঁছলো শুক্রের কুটিরপ্রাঙ্গনে আর পিতার আহ্বানে দেবযানী এসে দাঁড়ালো দুয়ারে কচের পথশ্রান্ত মুখের পানে চেয়ে, “সেদিন ছিল কি গোধুলিলগন, শুভদৃষ্টির ক্ষণ?” কিছু কিছু ক্ষণ ফ্রীজ ফ্রেম হয়ে রয়ে যায় জীবনে। দেবযানীর জীবনে সেদিনের সেই প্রথম দেখার মুহূর্তটা অমনি অনন্ত হয়ে গেল। শুরু হল কচের গুরুগৃহে পড়াশোনা। পিতা-পুত্রীর হৃদয় জয় করে নিতে বেশিদিন লাগলো না বুদ্ধিমান, বিনম্রস্বভাব, মিতভাষী এই তরুণের। ছাত্র হিসাবে কচের কোন তুলনা হয় না, যেমন বুদ্ধি, তেমন স্মৃতি, ততোধিক তার জ্ঞানতৃষ্ণা।
উপযুক্ত গুরুর উপযুক্ত শিষ্য। দেবযানীর সাথেও একটা মধুর সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল তার কিছুদিনের মধ্যেই। দেবযানীর হাতে হাতে জলতোলা, ফুলতোলা, আরো হাজার খুঁটিনাটিতে দিন চলে যায়। অবসর সময়ে কচ দেবযানীকে স্বর্গের গল্প বলে, গান শোনায়। দেবযানী মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হতে থাকে দিনে দিনে। সন্তানের মুখে খুশির হাসি দেখে শুক্রাচার্যের মনও আনন্দে ভরে ওঠে। পাঁচশ' বছর এইভাবে মোটামুটি নিরুপদ্রবে, নির্বিবাদেই কেটে গেল। কিন্তু চিরদিন তো সমান যায় না কারোই। দানবরা একদিন জেনে গেল কচের পরিচয়। তারা বুঝতে পারলো কচের যাবতীয় ভালোমানুষীর পিছনে নিহিত আছে গভীর কোন ষড়যন্ত্র, রাগে-হিংসায় দানব সতীর্থরা জ্বলে পুড়ে যায়, তবু কিছু করতে পারে না কেউই। কচ যে গুরুর নয়নের মণি। কিন্তু গেরস্তের পাঁচদিন তো চোরের একদিন। সেই একদিনে দৈত্যবালকেরা কচকে পেয়ে গেল সীমানার বাইরে। একটা বাঁধনছেড়া দুষ্টু বাছুরের পিছু পিছু দৌড়তে দৌড়তে ভুল করে আশ্রম ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়া কচকে ধরে অসুরেরা টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেললো। নিহত কচের ধড় আর মুণ্ডু পড়ে রইলো জঙ্গলের মধ্যে ধুলিশয্যায়। সন্ধ্যে উতরে যায়, সবাই ঘরে ফিরে পড়তে বসল সুবোধ বালকের মত, শুধু কচের দেখা নেই। শুক্রাচার্য খড়ম খটখটিয়ে ফিরলেন বাইরে থেকে।
আচমন সেরে সান্ধ্য আহ্নিকের জন্য তৈরী হয়ে দেখেন অগ্নিহোত্রের আগুন জ্বলে নি। এমন তো কক্ষনো হয় না। যেদিন থেকে কচ তাঁর আশ্রমে এসেছে, সেইদিন থেকেই এই পবিত্র দায়িত্ব তার কাঁধে, একটি সন্ধ্যেতেও কোনরকম অন্যথা হয় নি কখনো। তবে কি??....."দেবযানী-ই-ই-ই...." জলদমন্দ্র স্বরে হাঁক পাড়েন দৈত্যগুরু। চাঁদের মত জোছনা ছড়িয়ে, জুঁইয়ের মত অঙ্গসৌরভে বাতাস ভরিয়ে, ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় দেবযানী, "আমাকে ডাকছো, বাবা?" "এ কি অনাচার ধনি? উপাসনাগৃহ অন্ধকার, আমার যে সান্ধ্য যাজনের লগ্ন বয়ে যাচ্ছে মা। কচ কোথায়?".... জানতে চান শুক্রাচার্য। দেবযানীর বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে, আয়ত চোখে শঙ্কা ফুটে ওঠে, "জানি না তো। গাইঘরে সাঁজাল দিয়ে নদীতে নাইতে যায় তো রোজ সাঁঝে সন্ধ্যা উপাসনার আগে।" কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকেন দুজনেই নিশ্চুপে। অন্ধকার ঘনতর, জোনাকিরা চুপচাপ জ্বলে নেভে গাছের ফাঁকে ফাঁকে, একটা একটা করে তারা ফুটতে থাকে দূরের আকাশে। প্রদীপ জ্বালিয়ে বাবার উপাসনার আয়োজন করে দেয় দেবযানী। তারপর পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় দাওয়ার কিনারায়। "..... ধীয়ো ইয়ো নঃ প্রচোদয়াত ....." বাবার মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ ভেসে আসছে ধূপের গন্ধের সাথে।
"কচ, তুমি কোথায়? ক-অ-অ-অ-অ-অ-চ...." নিঃশব্দে চিৎকার করে ডাকতে থাকে দেবযানী জঙ্গলের দিকে মুখ ফিরিয়ে। আহ্নিক সারা করে শুক্রাচার্য শান্ত পায়ে এসে দাঁড়ান মেয়ের পাশে, আল্তো করে একটা হাত রাখেন তার মাথায়, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে দেবযানী। মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়ে কচকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন সেই রাতে শুক্রাচার্য, শুধু মেয়ের মুখ চেয়ে। বলাই বাহুল্য, অসুর ছাত্ররা মোটেই খুশি হতে পারলো না কচের এই প্রত্যাবর্তনে। কচের প্রতি গুরুর এত দাক্ষিণ্যে ঈর্ষার আগুন আরো চতুর্গুণ হয়ে জ্বলতে লাগলো। তক্কে তক্কে রইলো তারা সবাই আবার একটা উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায়।
বেশীদিন লাগলো না, দানবদের পোলাপানরা আবার মওকা পেয়ে গেল। এবারে তারা কচকে জঙ্গলের আরো গভীরে নিয়ে গিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে কুকুরদের খাইয়ে দিল। কিন্তু শুক্রাচার্য আবার বাঁচিয়ে দিলেন তাকে। দু' দু'বার এইভাবে কচের ওপর হামলা হবার পর দেবযানী আরো বেশি করে কচকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করলো। কচ এখন দেবযানীর প্রিয়সখা, চলতে ফিরতে চোখে হারায় তাকে দেবযানী। কচের মন্দ লাগে না তার প্রতি দেবযানীর এই অতিরিক্ত মনোযোগ, এই প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়া। কিন্তু তার তো দেবযানীর প্রেমে হাবুডুবু খেলে চলবে না, স্বর্গ যে তার প্রতীক্ষায় রয়েছে, সব চেয়ে বড় কথা তার একটা উদ্দেশ্য আছে এই পর্ণকুটিরে দিন অতিবাহিত করার, সেই লক্ষ্যে স্থির থেকে তাকে পৌঁছে যেতেই হবে তার উদ্দিষ্টে। দেবযানী কুপিতা হলে যে তার আর এখানে থাকাই সম্ভব হবে না। তাই দেবযানীকে সে যথেচ্ছ প্রশ্রয় দেয়। তাকে খুশি রাখতে চেষ্টা করে প্রাণপণে। নির্ব্যাজ দেবযানীর মনে কোন দ্বন্দ্ব বা সংশয় নেই, নির্দ্বিধায় তাই সে হাত বাড়িয়ে দেয়। কচও আরো কাছাকাছি এগিয়ে আসে। দুজনার সম্পর্ক বন্ধুত্ব পেরিয়ে অজানা এক দিগন্তে উঁকি দিতে থাকে। প্রায়ই ফুল তুলে খোঁপায় গুঁজে দেয় কচ তার সখীর, একসাথে দুপুরের নির্জনতায় দুটিতে মিলে বকমবকম, বুনো কুল ভাগ করে নিতে গিয়ে ক্ষণিকের স্পর্শে অজানিত শিহরন, চাঁদের তিলকে সাজানো সন্ধ্যার আকাশের নীচে পাশাপাশি বসে বীণার সুরের মায়ায় হারিয়ে যাওয়া, কারণে অকারণেই হেসে ওঠা দুজনায় একসাথে।
দেবযানী ফুল ভালোবাসে, ফুলের গয়নায় সাজলে তাকে ঠিক বনদেবীর মত দেখায়। তার মনোরঞ্জনের জন্য নিত্যই সকালে, বিকালে সাজি ভরে ফুল তোলে কচ। সেদিনও তুলছে, হঠাৎই মনে হল অরণ্যে যে নয়নমনোহর নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে, তার একগোছা তুলে এনে দেবযানীকে একটু চমকে দিলে কেমন হয়? যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। যদিও একা একা জঙ্গলে যাওয়া তার বিলকুল মানা, তবু ….. সে তো আর জঙ্গলের ভিতরে প্রমোদভ্রমণে যাচ্ছে না, ছুট্টে যাবে আর দৌড়ে আসবে। আর যদি বিপদ কিছু ঘটেই, দেবযানী তো আছেই, সে কিছুতেই কচকে মরতে দেবে না, সেটা সে বুঝে গেছে এতদিনে। দু’ দু’বার তাকে মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরিয়ে এনেছে যে, তার জন্য ক’টা ছোট্ট ফুল তোলার সামান্য ঝুঁকি কি খুব বেশি? বেশি দূর যেতে হল না। অসুরছানারা কাছেপিঠেই ছিল গাছের আড়ালে। একটুও সময় নষ্ট না করে তারা কচকে পাকড়াও করে টেনে নিয়ে গেল ঘোর জঙ্গলের মধ্যে। এবার শুধু টুকরো টুকরো করে কেটেই ক্ষান্ত দিল না অসুরেরা, কচের খণ্ডবিখণ্ড শরীরটাকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেললো একেবারে। তারপর সেই ছাই শুক্রাচার্যের প্রাত্যহিক বৈকালিক সুরায় মিশিয়ে দিল। ঠিক আগের দু'বারের মতই কচের দেখা নেই অথচ সন্ধ্যা ঘন হয়ে এল। তবে এবার আর দেবযানীকে ডাকখোঁজ করে আনতে হল না শুক্রাচার্যকে। দেবযানী নিজেই উৎসুক পায়ে এসে দাঁড়ালো বাবার কাছে অন্ধকার মুখে, জানালো কচ ফেরে নি।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শুক্রাচার্য বুঝতে পারলেন, কচ তাঁর উদরস্থিত। কচকে এবার ফিরিয়ে আনতে হলে নিজের প্রাণ দিতে হবে। সে কথা মেয়েকে জানালেন তিনি। দেবযানী কাঁদতে শুরু করলো, “না, কিছুতেই না, তুমি বা কচ কাউকেই আমি হারাতে পারবো না। তোমাকে একটা উপায় ভেবে বার করতেই হবে বাবা।”মেয়ের জলভরা চোখের দিকে চেয়ে শুক্রাচার্যর মনটাও দ্রব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দোনামনা করে তিনি মনস্থির করে ফেললেন আর অবশেষে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন, মন্ত্রবলে উদরস্থ কচকে চেতনা দান করে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কচ, মন দিয়ে শোন। আজ আমি তোমাকে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা দান করবো। আমার ছাত্রদের মধ্যে কেউ যদি এর উপযুক্ত হয়, সে তুমি। তুমি বোধ হয় এই নিগূঢ় জ্ঞান লাভ করতেই আমার কাছে এসেছিলে, যদিও ভাষায় কখনো প্রকাশ করো নি সেই অভিলাষ। আজ সেই মহাক্ষণ উপস্থিত, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। তোমায় এই মন্ত্র দান করে আমি তোমাকে পুনর্জীবিত করে দেব। আমার উদর বিদীর্ণ করে বার হয়ে এসে তুমি আমাকে বাঁচিয়ে তুলবে তোমার নবলব্ধ বিদ্যা দিয়ে।" গুরুর আদেশমত কচ শুক্রাচার্যের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে গুরুকে বাঁচিয়ে তুললো। দৈত্যগুরু জীবন ফিরে পেয়েই সুরাপান নিষিদ্ধ করে দিলেন, সেইদিন থেকে মদ্যপানের গায়ে পাপের ছাপ লেগে গেল। দেখতে দেখতে এক হাজার বছর পেরিয়ে গেল। যে জন্য আসা, সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে কচের, এবার ফেরার পালা। দেবযানীর কাছে বিদায় চাইতে গেল কচ।
দেবযানীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও বোধ হয় আঘাত তত লাগতো না, কচের এই বিদায়ের সংবাদে যতটা হানলো। বিশেষ করে কচ যখন নিশ্চিতভাবে জানালো, "আজি পূর্ণ কৃতার্থ জীবন, কোনো ঠাঁই মোর মাঝে কোনো দৈন্য কোনো শূন্য নাই সুলক্ষণে।" হায়া-লজ্জা ত্যাগ করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজের অনুরাগ ব্যক্ত করলো দেবযানী। উত্তরে কচ বললো, "তুমি গুরুপুত্রী, গুরুর তুল্যই পূজনীয়, আমার প্রণাম নাও, আমাকে আশীর্বাদ করো।" হাজার অনুনয়, বিনয়েও কিছুতেই কচের মন টলাতে না পেরে দেবযানী যুক্তির আশ্রয় নিল, মনে করিয়ে দিতে চাইলো বিগত দশ শত বর্ষের কথা। প্রত্যুত্তরে দেবযানীকে 'ভগ্নী' সম্বোধন করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, শাস্ত্রবচন আউড়ে কচ ফেরার পথ ধরলো। বেচারী দেবযানী.... কি মনে হয়েছিলো ঠিক সেই মুহূর্তটাতে দাঁড়িয়ে তার? কি মনে হয়েছিলো, যখন সে বুঝতে পারলো, কিভাবে তাকে ব্যবহার করেছে কচ, স্রেফ উদ্দেশ্যপূরণের জন্য? কি মনে হয়েছিলো তার, যখন সে বুঝতে পারল যে তার স্বপ্নগুলি সব আসলে জলের আখরে লেখা হয়েছে এতদিন ধরে? না, ধরণীকে দ্বিধা হতে আর্তি জানায় নি সে। বরং নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের অকরুণ অপমানের লজ্জা আড়াল করতে সেই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত অভিশাপ দিয়েছিলো সে তখন কচকে, তার অধীত মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা ফলবতী হবে না-- "তুমি শুধু তার ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ; শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।“ না, তার উত্তরে সেই যে শেষ দুটো বাক্য কচের বয়ানে সেই বিখ্যাত কবিতার, "আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে, ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে" .... সে শুধুই কবির কল্পনা।
কচ মোটেই চুপচাপ মাথা পেতে অভিশাপ মেনে নিয়ে ফিরে চলে যায় নি। যাবার আগে সেও পাল্টা অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো দেবযানীকে, "এত ক্রোধ কোন ব্রাহ্মণকন্যাকে শোভা দেয় না শুচিস্মিতে, তাই কোন ঋষিপুত্র কোনদিন তোমার পাণি গ্রহণ করবেন না আর তুমি কামের বশে আমাকে এমন অন্যায় অভিশাপ দিলে, আমার এত বছরের সাধনা ব্যর্থ করে দিলে, তোমার কামনা কোনদিন পূর্ণ হবে না।" সত্যিই হয় নি, কচের অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে, ভালোবাসাহীন কেটেছে দেবযানীর সারাটা জীবন। কেউ ছিল না সেই বিদায়বেলায় কচকে মনে করিয়ে দিতে যে দেবযানীর নিষ্পাপ সাধনাকে সে কিভাবে বিফল করে দিয়েছে সর্বতোভাবে। কাজের বেলা কাজী, কাজ ফুরালেই পাজি ..... কচ তো লহমায় ভোল পাল্টে আশিক থেকে কনিষ্ঠ ভ্রাতাটি হয়ে গিয়ে স্বর্গে ফিরে গেল। ধন্য ধন্য পড়ে গেল স্বর্গে কচের জয়জয়কারে। কিন্তু সে চলে যাবার পরে দেবযানীর কিভাবে দিন কেটেছে, কতদিন লেগেছে সেই দুঃসহ অপমান অন্তরালে চাপা দিয়ে আবার ফুলের সাজি হাতে তুলে নিতে, ছিন্নবীণা তুলে আবার নতুন তারে বাঁধতে, কেউ তার হিসেব রাখে নি। সময়ের সাথে সাথে সংসারে সবই আবার আগের ছন্দে ফিরে গেল, ফিরল না শুধু দেবযানীর ঝর্নার মত উচ্ছ্বল হাসি আর কৌতুক। গম্ভীর, রাশভারি, ভয়ানক আত্মসচেতন এক নতুন দেবযানীর জন্ম হল। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা এখন হাতের মুঠোয়। ইন্দ্রর আনন্দ আর দেখে কে? অসুরদের সাথে ঝগড়া লাগাবার একটা অছিলা খুঁজতে তিনি স্বর্গ থেকে নেমে এলেন।
দেবযানী তখন সখীদের সাথে নদীতে নাইতে নেমেছে। অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠাও ছিল সখীদের সেই দলে। বাতাসের রূপ ধরে ইন্দ্র লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলেন মেয়েদের জলকেলি। উত্তেজনার চোটে হু হু বয়ে যাওয়ার সময়ে কন্যাদের সবার কাপড়চোপড় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। স্নান সেরে উঠে ভালো করে লক্ষ্য না করেই শর্মিষ্ঠা দেবযানীর বস্ত্র অঙ্গে ধারণ করে ফেললো ভুল করে। দেবযানী ঋষিকন্যা, সামাজিক নিয়ম মতে ধনে খাটো হলেও মানে বড় শর্মিষ্ঠার চেয়ে। তায় তার পিতা রাক্ষসকুলের সকলের গুরু। সহচরীর এই ভুল মেনে নিতে তার সম্মানে বাধলো। ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে সে শর্মিষ্ঠাকে তিরস্কার করলো রুঢ় ভাষায়। শর্মিষ্ঠাও রাজনন্দিনী। অপমান, অসম্মনে অভ্যস্ত নয়। রেগে গিয়ে সেও যা মুখে এল তাই বলে গালি দিল দেবযানীকে। কলহ বাড়তে বাড়তে বিশ্রী আকার নিল। অবস্থা এতটাই খারাপ হল শেষে যে এক ধাক্কায় দেবযানীকে একটা কুয়োর মধ্যে ঠেলে ফেলে দিল শর্মিষ্ঠা প্রাসাদে ফিরে যাবার আগে। দাসীরা ছুটলো আশ্রমের দিকে শুক্রাচার্যকে খবর দিতে। ইতিমধ্যে রাজা যযাতি মৃগয়া সেরে ফেরার পথে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সেই কুয়োর কাছে এসে নামলেন ঘোড়া থেকে।
শুক্রাচার্য যখন হন্তদন্ত হয়ে এসে পৌঁছোলেন ততক্ষণে যযাতি দেবযানীকে উদ্ধার করে ফেলেছেন সেই কুয়ো থেকে। রোরুদ্যমানা দেবযানী সবিস্তারে সব কথা জানালো পিতাকে, "তোমাকে শর্মিষ্ঠা ভিখারী ব্রাহ্মণ বলে অপমান করেছে, বাবা। আমাকে ভিখারী দুহিতা বলেছে। বলেছে তার পিতার দাক্ষিণ্যে আমাদের জীবনধারণ। এর প্রতিবিধান না করলে আমি আত্মঘাতী হব।" অনেক বুঝিয়ে দেবযানীকে নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন শুক্রাচার্য। তারপর গেলেন রাজদরবারে, রাজাকে বললেন, "জেনে রেখো পাপের ফল সদ্য দেখা যায় না, কিন্তু যে বার বার পাপ করে সে সমূলে বিনষ্ট হয়। অমার নিরপরাধ ছাত্র কচকে তুমি তিনবার বধ করিয়েছিলে, আজ তোমার শর্মিষ্ঠা দম্ভভরে আমার মেয়েকে কটু কথা বলে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে। অভিশাপ দেব না বৃষপর্বা। তবে তোমার রাজ্যে আমরা আর থাকবো না।" রাজা করজোড়ে মাপ চাইলেন অনেক করে।
শুক্রাচার্য বললেন, "দেবযানী আমার বড় আদরের, তার দুঃখ আমি সইতে পারি না। তোমাকে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তাকে প্রসন্ন করতে হবে।" রাজা সবান্ধবে আশ্রমে গিয়ে দেবযানীর পায়ে পড়লেন। দেবযানী শর্ত দিল, "শর্মিষ্ঠাকে সারা জীবনের জন্য আমার দাসী করে যদি পাঠাতে পারেন, তবে ক্ষমা করে দিতে পারি।" শর্মিষ্ঠা দাসী হয়ে এল দেবযানীকে সেবা করতে, সাথে আরো এক হাজার দাসী। ওদিকে দেবযানীকে কুয়ো থেকে উদ্ধার করার সময়ে যযাতি তার দখিন হাতটি ধরে টেনে তুলেছিলেন। কাজেই প্রথামাফিক ক্ষত্রিয় যযাতি দেবযানীর পাণি গ্রহণ করেই ফেলেছেন। কচের অভিশাপ তো আর মিথ্যে হবার নয়। দেবযানীর কাছে এই খবর জানতে পেরে শুক্রাচার্য যযাতিকে ডেকে এনে বললেন, "তোমার হাতে আজ আমার কন্যা দেবযানীকে দান করলাম, ওকে সসম্মানে তোমার মহিষী করে নিয়ে যাও, ওর কোন অযত্ন, অসম্মান যেন না হয় তোমার গৃহে কোনদিন। আমার বরে তোমার বর্ণসঙ্করজনিত কোন পাপ হবে না। আর বৃষপর্বার এই কন্যা কুমারী শর্মিষ্ঠাও যাবে দেবযানীর দাসী হয়ে তোমার ঘরে, ওকেও সম্মানের চোখে দেখো, কিন্তু কোনদিন শয্যায় ডেকো না।" আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়ে গেল।
দেবযানী, শর্মিষ্ঠা আর দাসীদের নিয়ে যযাতি ফিরে গেলেন তাঁর রাজধানীতে। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে রাজভবনের নিকটস্থ উপবনে শর্মিষ্ঠার জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিলেন। শুরু হল দেবযানীর জীবনের নতুন অধ্যায়। সেই নতুন সংসারে প্রথম পা রেখে কি স্বপ্ন দেখেছিল সেদিন দেবযানী---- "যবে রানীর মতন বসিব রতন-আসনে, যবে বাঁধিব তোমারে নিবিড় প্রণয়শাসনে, যবে দেবীর মতন পুরাব তোমার বাসনা, ওগো প্রিয়তম".....? না, স্বপ্ন নয়, প্রণয় নয়, দেবযানীর কপালে শুধুই কচের অভিশাপ লেখা ছিল। প্রথম থেকেই শর্মিষ্ঠার রূপে মুগ্ধ ছিলেন যযাতি। তবু শুক্রের সাবধানবাণী মনে রেখে নিজেকে সামলে রেখেছিলেন। দেবযানীও রূপমতী, বুদ্ধিমতী, সুশিক্ষিতা। শুরু শুরুতে কিছুদিন একেবারে মন্দ কাটলো না। দুই ছেলে হল দেবযানীর, যদু আর তুর্বসু। এই যদুই যদুবংশের আর যাদবদের আদি পুরুষ। কিন্তু দেবযানীর এই মধুচাঁদের লগ্ন দীর্ঘস্থায়ী হল না। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে যযাতির ঘনিষ্ঠতা শুরু হল। কালক্রমে তাঁর তিনটি পুত্র জন্মাল শর্মিষ্ঠার গর্ভে, দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু। এই দ্রুহ্যু ভোজরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আর পুরু হলেন কুরুবংশের জনক। দেবযানী প্রথমে জানতে পারে নি। শর্মিষ্ঠার সাথে ঘনিষ্ঠতার কথা যযাতি তো আর নিজে থেকে উপযাচক হয়ে তাকে বলতে যাবেন না। শর্মিষ্ঠাও নিরন্তর অনৃতভাষণ চালিয়ে গেছে তার সন্তানদের পিতৃপরিচয়ের প্রশ্নে। কিন্তু শর্মিষ্ঠার ছেলেরাই সত্য উদ্ঘাটন করে দিল একদিন, দেবযানীর উপস্থিতিতে যযাতিকে পিতৃ সম্ভাষণে ডেকে। রাগে দুঃখে যযাতিকে ত্যাগ করে দেবযানী ফিরে গেলেন পিতার কাছে।
যযাতিও চললেন পিছু পিছু। কিন্তু দেবযানীকে ফেরাতে পারলেন না আর। শুক্রাচার্য সব শুনে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন যযাতিকে, "মহারাজ, তুমি খুব অন্যায় করেছ, ধর্মজ্ঞ হয়েও তুমি মহা অধর্ম করেছ, দেবযানীর মর্যাদা লঙ্ঘন করেছ, আমার উপদেশ অগ্রাহ্য করেছ। এই অপরাধের জন্য দুর্জয় জরা তোমাকে গ্রাস করবে।" এর পরের গল্প তো সবার জানা। অনেক ক্ষমা চেয়ে যযাতি শেষে শুক্রের কাছ থেকে জরা হস্তান্তরের অনুমোদন পেয়েছিলেন। ছেলেদের মধ্যে একমাত্র পুরুই রাজি হয়েছিল এক হাজার বছরের জন্য পিতার জরা শরীরে ধারণ করতে। কিন্তু সে সব তো অন্য গল্প, তার মধ্যে কোথাও আর দেবযানী নেই। দেবযানীর গল্প এখানেই শেষ। একটা মন কতবার ভাঙা যায়, কতবারই বা আবার নতুন করে গড়া যায়? আবার কি জোড়া দিতে পেরেছিল মনটাকে দেবযানী? সময় থেমে থাকে না কারো জন্যই। দেবযানীর জন্যেও থামে নি। জীবন বয়ে গেছে জীবনের মত, কামনায়, বাসনায়, যাতনায়, সম্ভাবনায়, শেষের ঠিকানায়। শুধু দেবযানী ফুরিয়ে গেল, হারিয়ে গেল, কেউ একটিবারও তাকে ডেকে বললো না, 'ভালোবাসি'....
রচনাকাল : ২০/৩/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।