গ্রামটির নাম রামচন্দ্রপুর। এই গ্রামে দেবী কালীকে কেন্দ্র করে অনেক পৌরাণিক ঘটনা শোনা যায়। অবাক হওয়ার মতো, এই দেবীরূপ। এই দেবীর কাটা মুণ্ড পাশে ঝুলিয়ে রেখে পূজো করা হয়। কারণ আনুমানিক পাঁচশো বছর আগে এই বংশের পূর্ব পুরুষ রাজা অচিন্ত্য, এই দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পূজোর সূচনা করেন। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে দেবীর মূর্তি তৈরি করান এবং খুব ধুমধামের সাথে এই পুজো শুরু করেন। পূজো শেষ হবার ঠিক আগে, ছাগল বলির সময় ঘটে গেল এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। প্রথম ছাগল বলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেবীর মাথাও ভেঙে পড়লো মাটিতে । এই দেখা রাজা অচিন্ত্য একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেল। পূজোপাঠ প্রায় একরকম বন্ধ হওয়ার মতোই অবস্থা। ঠিক এমন সময় এক বাচ্চা মেয়ের উপর দেবী ভর করে বললেন, তোরা যে ছাগল বলি দিলি তার মধ্যে কি আমি নেই। সেও তো মায়ের এক সন্তান । সেও তো আমাকে মা বলে ডাকে, আর তোরাও। পারবি তোদের নিজের সন্তানের বলি দিতে আমার কাছে। পারবি না ।তোরা মন দিয়ে শোন, আমি এখন যা আদেশ করছি। আজ থেকে আর কোনদিন আমার সামনে কোন জীব বলি দিবি না। আর যদি আমার কথা অমান্য করিস, তাহলে আমি কিন্তুু তোদের চরম ক্ষতি করে দেবো। একথা শুনে রাজা অচিন্ত্য ভয়ে ভয়ে বললেন, মা তুমি যা আদেশ করবেন তাই হবে মা ।কিন্তুু মা শাস্ত্রে যে লেখা আছে বলির কথা, তাহলে আমরা কি করব মা? তখন দেবী বললেন বলি যদি করতেই হয় তাহলে চাল কুমড়ো বলি দিবি। এতেই আমি সন্তুষ্ট হবো। আর তখন থেকেই এখানে শুরু হয় কুমড়ো বলির প্রথা ।
আরো কথিত আছে দেবী কালী বাচ্চা মেয়ের রূপ ধরে তৎকালীন এই মন্দিরের পিছনে একটা সুন্দর ফল ও ফুলের বাগানের মধ্যে নৃত্য করতেন । আরো কথিত আছে কোন এক মুনি দেবীর মন্দিরে নিষ্ঠার সঙ্গে শক্তির আরাধনা পূজোর্চনা করতেন । তেমনি একবার পূজোর সমস্ত আয়োজন করে মন্দিরের বাইরে বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ এক বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর মুনি ডাকতে শুরু করেন। কিন্তুু মেয়েটি কোন সাড়া দিল না। এবার মুনি চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো। তখন মেয়েটি উত্তর দিল, আমি যতক্ষণ না দরজা খুলবো ততক্ষণ পযর্ন্ত আমাকে কেউ যেন বিরক্ত করবি না ।এদিকে মুনির মনে কৌতূহল জাগে, যদি ভিতরে সব ফল প্রসাদ এঁটো করে ফেলে, তাহলে মায়ের পূজা কিভাবে হবে? তাই জোরপূর্বক ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলেন ।আর দরজা খুলতেই মুনির চক্ষুস্থির। তিনি দেখেন কেউ নেই এই মন্দিরের ভিতরে । তিনি অনেক খুঁজেও সেই মেয়েটির দেখা আর পেলেন না।আরো জানা যায় মন্দিরের পিছনে থাকা বাগানের কিছু ঘটনা। মা কালী সুন্দর এক বাচ্চা মেয়ের রূপে সারা বাগান নৃত্য করেন মাঝে মাঝে। তখন দেবীর পায়ের নূপুরের ধ্বনি শোনা যায়। গ্রামের অনেক মানুষের মুখেই তা শোনা যায়। এই খবর পেয়ে এক তান্ত্রিক এখানে আসেন নিজের সাধনার জন্য । বাগানের শেষ প্রান্তে একটি ছোট নদী আছে, তার পাশেই একটা ছোট্ট ঘর করে তিনি সাধনা শুরু করেন। তিনি অনেক বছর সাধনা করেও মায়ের দর্শন পেলেন না। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি মায়ের প্রতিমার সামনে গিয়ে বললেন, যদি তুমি আমাকে দর্শন না দাও, তাহলে আমি কিন্তুু এবার ছোট্ট একটি শিশু বলি দেবো তোমার নামে। এই বলে তিনি বিছানার মধ্যে শুয়ে পড়লেন। রাত যখন গভীর হলো তখন একটা বাচ্চা মেয়ে এসে, বাবা বাবা বলে ডাকতে লাগলেন । তখন ওই তান্ত্রিক ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন । মেয়েটি তখন বলল কি বাবা তোমার তো আমার মতো একটি বাচ্চা মেয়ের দরকার বলি দেওয়ার জন্য, তাই না বাবা। আমি তৈরি আছি তুমি আমাকে বলি দিতে পারো।তান্ত্রিক একথা শুনে তো একেবারে আনন্দে আটখানা । সঙ্গে সঙ্গেই তান্ত্রিক বাচ্চা মেয়েটাকে বললেন বেশ তুই একটু দাঁড়া আমি তৈরি হয়ে নিই । তারপর মেয়েটাকে যখন খুঁটোর মধ্যে ভরে বলি দেবে ঠিক এমন সময় তান্ত্রিক দেখতে পেলেন, বাচ্চা মেয়েটির জায়গায় তার নিজের বৃদ্ধ মাকে। এই দেখে তান্ত্রিক চিৎকার করে কেঁদে মায়ের কাছে ক্ষমা চান। তখন ওই তান্ত্রিক কে মা দর্শন দেন।
এমনি আর এক ঘটনা, পাশের গ্রাম থেকে এক বৃদ্ধা মহিলা তার দুই যুবতী নাতনীকে সঙ্গে নিয়ে এই গ্রামে মায়ের পূজোর সময় মেলা দেখতে আসেন। এবং মেলা দেখার নেশায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে রাত হয়ে তা তাদের খেয়াল নেই। হঠাৎ সেই বৃদ্ধা মহিলা যখন মেলার বাইরে এসে দেখলেন যে এতো অনেকটাই রাত হয়ে গেছে । তাই তিনি সময় নষ্ট না করে দুই নাতনীকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন মেলা থেকে। মাঠের পথ । তাই তিনি ভয়ে ভয়ে হাটতে লাগলেন। যখন মাঠের মধ্যে এলেন তখন কোথা থেকে একদল ডাকাত এসে তার দুই নাতনীর উপর আক্রমণ করলো, এবং সেই বৃদ্ধা মহিলা অনেক অনুরোধ করেও ডাকাতরা তাদের ছাড়লো না। হঠাৎ তখন বৃদ্ধা মহিলার মাথায় এলো মায়ের কথা, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের নাম স্মরণ করতেই মা কালী তখন এক নাতনীর উপর ভর করে এমন তাণ্ডবলীলা শুরু করলো যে ডাকাতরা যে যেদিকে পারলো ছুটে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো । গ্রামে ফিরে এসে এই কথা যখন বৃদ্ধা মহিলা গ্রামের মানুষ কে খুলে বললেন তখন মানুষের মনে ভক্তি আরো বেড়ে গেল মায়ের প্রতি ।এবং তাদের মুখে একটাই কথা শোনা যায়, কোন ব্যক্তি যদি এই মায়ের নাম স্মরণ করে পথে বেড়িয়ে যায়, তাহলে বিপদও তার থেকে দূরে চলে যায়।
দাদুর মুখে এই ঘটনা শুনে, আমার মনে একটু হলেও বিশ্বাস জাগে ঈশ্বর বলে কিছু একটা আছে আর অধর্মের বিনাশ অবশ্যই করতে আসবেন মা, বাচ্চা রূপেই। যাইহোক মায়ের আরো ঘটনা আছে সেগুলি আমি পরের গল্পে তা প্রকাশ করবো।।
রচনাকাল : ১১/৩/২০২১
© কিশলয় এবং দীনবন্ধু দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।