রিক্সাওয়ালা
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : শিব প্রসাদ হালদার
দেশ : India , শহর : কোলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২১ , মার্চ
প্রকাশিত ১০ টি লেখনী ১৫ টি দেশ ব্যাপী ১৪৫০ জন পড়েছেন।
রিক্সাওয়ালা বাদল কাল সারারাত রিক্সা টেনেছে। ওর যে বড্ড টাকার দরকার। মা মৃত্যুশয্যায়। সোমবার রাত পোহালেই অপারেশন। দিন আনা দিন খাওয়া বাদলের ভাবনার শেষ নেই। মাকে যে করে হোক বাঁচাতে হবে। মা ছাড়া যে তার কেউ নেই। আপন বলে যারা ছিল- তারা সবাই থেকেও আজ নেই। স্বার্থান্বেষী স্বজনেরা সবাই মাকে ফেলে সরে গেছে একে একে। বছর সাতেক হ'ল পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে মাকে নিয়ে ঘর গড়েছে রেললাইনের পাশে। ভাগ্যের পরিহাসে বাদল আজ রিক্সাওয়ালা।

              মায়ের মুখে শুনেছে আষাঢ়ের বাদলা হাওয়ায় জন্ম ব'লে তার নাম রেখেছিল বাদল। ঘন ঘন মেঘের গর্জনে চমকানো বিদ্যুতের আলোয় মায়ের কোল আলোকিত করেছিল। তবুও মায়ের মনে ছিল সংশয়। প্রচন্ড দুর্যোগের মাঝে যে ছেলের জন্ম হ'ল, তার জীবনে মিলবে কতটুকু সুখের কর্ম? সতেরটা বছর একে একে কেটে গেছে। সুখ কিন্তু বাদলের জীবনে আসেনি। এসেছে দিনে দিনে আরও দুঃখ। তবুও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। সৎভাবে সৎপথে সকল কষ্টকে করেছে জয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর ভাগ্যের পরিহাসে আর পড়া হলো না। কলেজে ভর্তি হবে এই আশাতে গিয়েছিল মেজদার কাছে একটু সহানুভূতি পেতে। কিন্তু মেজো বৌদির কাছ থেকে সে যা পেয়েছিল তাতেই এলো তার জীবনে পারিবারিক পটপরিবর্তন। বইখাতা ছেড়ে হাতে তুলে নিল রিকশা। সেই থেকেই তার পরিচয় রিক্সাওয়ালা।

           অনেক দুঃখ কষ্ট অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে কাটতে থাকে দিন। কোন দিন অর্ধাহারে,কখনো অনাহারে কাটিয়েছে বাদলের মা। আগে ছেলেকে খাইয়ে অবশিষ্ট যেটুকু থাকতো তাতেই নিবৃত্ত হ'ত মায়ের ক্ষুধা। মাঝে মাঝে বাসি তরকারিতে খিদের যন্ত্রণা মেটাতে গিয়ে মনের অজান্তে জন্ম নিল গ্যাস্ট্রিক আলসার। দিনের-পর-দিন পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন বাদল ভেঙ্গে পড়ল। মায়ের করতে হবে জরুরী অপারেশন। যেভাবে হোক মাকে সারিয়ে তুলতে হবে। দিনরাত অজস্র পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করতে থাকে। কষ্ট হয় হোক তার চাই টাকা। হবে অপারেশন। লাগবে দামি দামি ওষুধ, রক্ত, পথ্য-----। মাকে সুস্থ করতে পারলেই পাবে স্বস্তি।

              রবিবার ছুটির বাজার। ভোর পাঁচটায় রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সারাদিন অবিরাম খেটে চলেছে। সন্ধ্যায় এক পশলা ভারী বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমে গেল। সেই জলের মধ্যে টেনে চলেছে রিক্সা। রোজগারও কম হয়নি কিন্তু আরো চাই টাকা। ভিজা জামা প্যান্ট নিয়েই চলেছে এ রাস্তা থেকে সে রাস্তা। রাত দশটা। খিদেয় আর পারছেনা। কিন্তু পারতে থাকে হবেই। আরো চাই টাকা। পরশু যে মার অপারেশন। বিটি রোডে টবিন রোডের মোড়ে এসে থামলো। ফুটপাতের হোটেলে এক প্লেট আলুর দম দুটো আটার শুকনো রুটি নিয়ে গোগ্রাসে গিলে নিল। সঙ্গে এক গ্লাস নয়- তিন গ্লাস জল খেয়ে অশান্ত জঠরজ্বালা শান্ত হলো। মৃত্যুশয্যায় শায়িত মায়ের মলিন মুখখানার কথা ভেবেই আবার বেরিয়ে পড়ল। ন পাড়া থেকে ভাড়া নিয়ে এলো সিঁথির মোড়।

                ঘড়িতে রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ। পথঘাট প্রায় জনমানব শূন্য। বাদল রিক্সার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যদি মেলে আর একটা ভাড়া। সময় কেটে চলেছে তবুও অপেক্ষায়--। রাত এগারোটা ত্রিশ। একটা ডাবলু বি ওয়াই এর সাদা প্রাইভেট এসে থামলো। নেমে এলো উঁচু লম্বা এক ভদ্রলোক। প্রাইভেটের কাচ নামিয়ে গাড়িতে বসা এক অবিন্যস্তা নারী হাত নেড়ে গুড নাইট জানিয়ে চোখের নিমিষে মিলিয়ে গেল। ভদ্রলোক দাঁড়াতে পারছেন না। পা দুটো টলছে। সুরার নেশায় পা আর সোজা চলছেনা। ঝমঝমিয়ে এলো আবার জোর বৃষ্টি। রিক্সায় উঠেই ভদ্রলোক শুরু করলেন অভদ্র ব্যবহার। অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বাদলকে চলতে বললেন। দুটো পয়সার লোভে সে ছুটলো ভিজে ভিজে। এ গলি থেকে সে গুলি। অবশেষে সঠিক দরজায়। ভাড়া মেটানোর আগেই বাদল বলল- "বাবু আমায় দশটি টাকা বেশি দিন। মা মৃত্যুশয্যায়। পরশু অপারেশন। অনেক টাকার দরকার। মার বাঁচা মরা আপনাদের দশ জনের --" বলতেই ঠাস করে সজোরে গালে মারলেন এক চড়। "হারামজাদা টাকা চাইলেই পাওয়া যায়? রোজগার করতে কষ্ট হয়না---?" বাদলের কোন কথাই তিনি শুনছেন না অথচ বাইজি বাড়ি থেকে ফুর্তি করে হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে এসেছেন। দুটো টাকার জন্য হাত জোড় করে পা দুটি ধরতে গেল কিন্তু তার আগেই মুখের 'পরে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

               ঘাত প্রতিঘাতে আহত বাদল বড় পরিশ্রান্ত। অব্যক্ত যন্ত্রণায় সারাদিনের যেটুকু রোজগার- বুকে নিয়ে এবার ছুটলো বাড়ির দিকে। রায়পাড়া থার্টি এ বাস স্ট্যান্ড পেরিয়েই তার বাসস্থান। বাড়ি ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল সে। এত রাতে বাড়িতে এত লোক কেন? তাকে দেখেই পাশের ঘরের বলাইয়ের মা বলে উঠলো- "ওরে বাদল! মা আর নেই। তোকে আর রাত জেগে রিকশা টেনে টাকা রোজগার করতে হবেনা, তোর যে সব শেষ--!" বাদল আর সইতে পারছে না। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যেতে লাগলো। সে নির্বাক -নিথর- বোবা। ভোম্বলের সান্তনায় বাদল ফিরে পেল সম্বিৎ। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো- "মা তুমি এ কি করলে? আমি তো তোমার অপারেশনের টাকা যোগাড় করেছি। অনেক খেটে পেয়েছি অনেক টাকা। আজই পথে পেয়েছি বাড়তি আবদারের যোগ্য পাওনা। পরশুই তো তোমার অপারেশন হোত। এত কষ্ট করলে আর একটা দিন পারলে না? তুমি চলে গেলে! আমায় কার কাছে রেখে গেলে-----?" কাছে এগিয়ে এলো সজলের বাবা। তার চোখেও জল। পিঠে হাত রেখে বললো- "বাবা মা কারো চিরকাল বেঁচে থাকে নারে বাদল! সময় হলে আমাদেরও চলে যেতে হবে। দুঃখ করো না -তোমার পাশে আমরা আছি।" এগিয়ে এলো বস্তির পচা, ভোম্বল, খুদে। এরাই তো আজ তার আদর্শ প্রতিবেশী।

              আভিজাত্যের দম্ভে যে মেজদার পা মাটিতে পড়ে না, যার বাড়ির দরজা থেকে বিতাড়িত বাদল বুকভরা ব্যথায় হলো রিক্সাওয়ালা। আজ কর্তব্যের খাতিরে তাকে মায়ের মৃত্যু সংবাদ জানালো। কিন্তু এলোনা মায়ের প্রতি শেষ কর্তব্য টুকু পালনে। সকাল দশটা বরানগর রতন বাবুর শ্মশান ঘাটের উদ্দেশ্যে বের হল শব যাত্রা। তারা চলেছে সেই সিঁথির মোড় হয়ে। শোকার্ত বাদলের মনে পড়ছে গত রাতের দোমড়ানো-মোচড়ানো আঘাতের স্মৃতি! সকল শ্মশান যাত্রীর সমবেত চিৎকার- বল হরি হরি বল জোরছে বলো হরি বল ধ্বনিতে মিলিয়ে গেল সেই বিষাদিত স্মৃতি।সবাই ছুটে চলেছে। লক্ষ্য শ্মশান ঘাট।

                 এক সপ্তাহ বাদে সেই সিঁথির মোড়। বাদল বিকালে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আজ তার পরনে সাদা ধুতি -গলায় ধড়া। সদ্য মাতৃহারা চিহ্ন। মিনিবাস থেকে নামলেন গত সপ্তাহের সেই ভদ্রলোক। হাতে শ্যামবাজারের এক অভিজাত বস্ত্র বিপনীর উন্নত দুটি ক্যারিব্যাগ। নিয়তির অদ্ভুত  যোগাযোগ। আজও তিনি উঠলেন সেই বাদলের রিকশায়। কিন্তু শান্ত।  তিনি সুরার নেশায় আজ আসক্ত নন। ঠিক চিনতে পারলেন বাদলকে। মনে পড়লো গত সপ্তাহের নির্জন রাতের কথা। নিজেই আজ অনুতপ্ত। সেদিন কি ভূলই তিনি করেছিলেন! হয়তো ক'টা টাকা বেশি দিলে বেচারিকে আজ আর এই বেশে দেখতে হ'তো না! সেদিন তো মদের মত্ততায় কত টাকাই উড়িয়ে এসেছিলেন। ভদ্রলোকের বুকের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। দরজায় এসে নামলেন। পকেট থেকে দুটো একশ টাকার নোট বাদলের হাতে গুঁজে দিলেন। চোখ দুটো ছল ছল করছে। মুখ দিয়ে যেন কিছু বলতে পারছেন না। ঠোঁট দুটি কাঁপছে। গলা ধরে গেছে। ভাঙ্গা স্বরে বললেন- "ভাই! এটা দিয়ে কিছু ফল কিনে খেও।" বাদল অবাক হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে পারছে না - উনিই কি সেই ভদ্রলোক! বাদলের চোখে জল। হাতজোড় করে বললো- "বাবু আজ আর আমার বেশি টাকা দরকার নেই। যা ভাড়া তাই দিন। সেদিন ভিক্ষা চেয়েছিলাম শুধু মাকে বাঁচাবার জন্য। কিন্তু মা আর বেঁচে নেই! আপনি রেখে দিন আপনার টাকা"। বাদলের চোখ বেয়ে নেমে এল শোকাশ্রু! পড়লো ভদ্রলোকের পায়ের উপর। তার কয়েক ফোঁটার স্পর্শে জ্বলে পুড়ে যেতে লাগলো তার অন্তর। মনের মাঝে তখন চলেছে তোলপাড়। বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। হাতে সেই একশ টাকার দুটি নোট। রিক্সাওয়ালা চলে গেল কিন্তু খুলে দিয়ে গেল হৃদয়ে মানবতার সমস্ত বন্ধ দরজা দরজা গুলি। তার বুকে জেগে উঠল বিক্ষিপ্ত ঝড়। দমকা হাওয়ার তোড়ে উড়ে যেতে লাগলো মনের দুয়ারে জমে থাকা ধুলো ময়লা গুলো। তখনও দাড়িয়ে ভাবছেন কত বড় শিক্ষা দিয়ে গেল সামান্য একটা রিক্সাওয়ালা।।
রচনাকাল : ১০/৩/২০২১
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 7  France : 1  Germany : 2  India : 77  Ireland : 9  Russian Federat : 4  Sweden : 1  Ukraine : 2  
United States : 139  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 7  France : 1  
Germany : 2  India : 77  Ireland : 9  Russian Federat : 4  
Sweden : 1  Ukraine : 2  United States : 139  
© কিশলয় এবং শিব প্রসাদ হালদার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
রিক্সাওয়ালা by Shibaprasad Halder is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৩২৬৮
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী