হাত পা ছড়িয়ে সোফার উপর বিষন্ন মুখে বসে আছে সৌপর্ণা | মাটিতে নরম কার্পেটে স্কুলের কাজ করছে চার বছরের মেয়ে 'গুড্ডি'| রবিবার, কাজের তাড়া নেই ,তাও বাড়ীতে অনেক ঘরের কাজ |বার্সেলোনা , স্পেনের বাসিন্দা সৌপর্ণা | প্রায় বছর পনেরো কাটানো হয়ে গেছে | বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্প্যানিশ ভাষায় স্নাতক,স্নাতকোত্তর ও পি এইচ ডি করে অধ্যাপনা করে | সালামানাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছুদিন বিশেষ অধ্যয়ন করেছে |
রর্ডিগো লোপেজ, সৌপর্ণার স্বামী ,অর্থনীতির অধ্যাপক, বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে | বিবাহিত জীবন ছয় বছরের | কিছুটা জোর করেই মেয়ের নাম রেখেছে 'দ্যুতি '| ডাকে গুড্ডি বলে | রর্ডিগো কিছু বলেনি নামকরনে | নিজে আদর করে ডাকে Elena |
কলকাতায় বড় হয়েছে সৌপর্ণা | বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে ,বিশ্বভারতীতে স্প্যানিশে ডিপ্লমা করে স্কলারশিপ নিয়ে সোজা বার্সেলোনা | বাড়ীতে অনেক বিদেশী ভাষার চল | বাবা ভাল জার্মান জানতেন | দিদি ফ্রেন্চ জানে | শুনেছে দাদু নাকি ভাল রাশিয়ান জানতেন | অনেক রাশিয়ান বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন | ওরও লক্ষ্য ছিল ,অনুবাদ করার |বিদেশী ভাষা থেকে বাংলায় | সত্যি এখন সে অনেক স্প্যানিশ বইয়ের বাংলা অনুবাদক | কলেজ জীবনে মারাইয়াস্, মার্কেজ, মন্তেরোর ইংরাজী অনুবাদ পড়ে, স্প্যানিশ ভাষায় আকৃষ্ট হয় | আর মার্কেজ তো প্রিয় লেখক | কোথায় মনে হত নরম ভাষা ,ঠিক বাংলার মত |মাথায় ছিল বাংলায় অনুবাদ করা | হ্যাঁ, সেই সাফল্য সে অর্জন করেছে ,নিজের গুনে ও মাতৃভাষার টানে | কিন্তু এখন বড় দোটানায় | দ্যুতি, বাংলা শিখছে না |বাবার সাথে স্প্যানিশ বলে ,মার সাথে ইংরাজী,বাংলা,স্প্যানিশ সব মিশিয়ে একটা পাঁচমেশালী ভাষাচর্চা চলছে |
রর্ডিগো কিছু বাংলা বোঝে ,বলতে পারেনা, শ্বাশুড়ীর সাথে ফোনে দু একটা শব্দ বলে | মা কলকাতা থেকে জিজ্ঞাসা করেন গুড্ডি বাংলা শিখছে কিনা| কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না ,আর দূর থেকে ঠিক বোঝাতেও পারেনা | কলকাতা থেকে গুড্ডির জন্য সৌপর্ণার মা ,ছবিতে রামায়ন ও ছবিতে মহাভারত পাঠিয়েছেন | চেষ্টা করছে পড়াতে |গুড্ডি ,ওগুলো শোনেনা | বাবার কাছে গিয়ে পলিতো (pollito )বা মুরগী ছানার গল্প শোনে।
একদিন রর্ডিগোকে বলল মনের কথা | রর্ডিগো বলল ,আমিও পড়ব | যতই হোক এলেনার মার ভাষাতো |
খুশীমনে রোজ সন্ধ্যায় একটু বসে ,বাবা ও মেয়েকে নিয়ে ,রামায়ন নিয়ে | গুড্ডি বেশ আনন্দ পাচ্ছে,বাবার সাথে পড়তে | মাঝে মাঝে ছবি দেখে খিলখিল করে হাসে |
রর্ডিগো ও খুব আনন্দ পায় |
রর্ডিগো ছবি ও রামায়নের পাতা শেষ হতে বলল 'এনতেন্দি'। গুড্ডি হেসে টান দিয়ে বলে উঠল 'বুঝলাম'।
আনন্দে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল সৌপর্ণা | কি সুন্দর বাবার ভাষা মায়ের ভাষায় অনুবাদ করে নিল মন থেকে ,নিজে নিজে গুড্ডি| কেউ শেখালো না | রক্তের ধারা মিশে আছে তার ভাষায় |
মাকে জানাতে ফোনটা হাতে নিল সৌপর্ণা | মেয়ের মাতৃভাষায় সাবলীল অনুবাদে ,আজ সে আপ্লুত |
রচনাকাল : ২১/২/২০২১
© কিশলয় এবং শিখা চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।