বাণী বন্দনা (ধর্মীয় আলোচনা প্রসঙ্গ)
॥দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ॥
তথ্য-সংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
।। ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার দেবী হলেন সরস্বতী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি পালন করতে সাহায্য করা।
ঋগ্বেদে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দেবী সরস্বতীর।
সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্ত এবং বিবাহ নিয়ে অনেক কিংবদন্তী আছে। কেউ বলেন পরমাত্মার মুখ থেকে নির্গত হয়ে তিনি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হন: রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী। আবার কারও মতে পিতা ব্রহ্মার মানসকন্যা তিনি। যদিও ব্রহ্মার মানসকন্যা সরস্বতী, তবুও পিতা ব্রহ্মা তাঁর এই সুন্দরী কন্যাটিকে কামনা করে বসলেন। বৃদ্ধের এই চাহনি কন্যার পছন্দ হল না । কন্যা এড়িয়ে চলতে লাগল পিতাকে। পালিয়ে বেড়াতে লাগল। ব্রহ্মা অসন্তুষ্ট হলেন। কামদেব মদনকে অভিশম্পাত করলেন যে কেন এই সুন্দরী কন্যার প্রতি তাঁর সম্ভোগ লালসা রূপায়িত হচ্ছে না, এই বলে। অচিরেই শিবের দ্বারা মদন ভস্মীভূত হল সেই ক্ষমতার অপব্যবহার! আর প্রতি পদে পদে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর লাঞ্ছনার গল্প উঠে আসতে দেখলাম আমরা।
আরো একটি পৌরানিক ঘটনায় পাই
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মূলে যখন অগ্নির করাল গ্রাসে সৃষ্টি প্রায় ধ্বংসের মুখে তখন এই বিপর্যয়কে রুখতে দেবরাজ ইন্দ্র গেলেন নদী সরস্বতীর কাছে। সরস্বতীকে তার গতিপথ পরিবর্তন করে আগুন নেভাতে আদেশ দিলেন। সরস্বতী তখন সমুদ্রের দিকে ধাবমান। সে তখন বলল ব্রহ্মা স্বয়ং আদেশ দিলে তবেই সেই আগুন নেভাতে তার গতিপথ ঘোরাবে। ব্রহ্মা ইন্দ্রের অনুরোধে সরস্বতীকে আদেশ দিলেন। সরস্বতী সম্মত হল। গঙ্গা, যমুনা, মনোরমা, গায়ত্রী ও সাবিত্রী এই পাঁচ নদী তার সঙ্গ নিতে চাইল কিন্তু সরস্বতী একাই গেলেন সেই অগ্নিনির্বাপণ কাজে। পথে ক্লান্ত হয়ে ঋষি উতঙ্কর আশ্রমে বিশ্রাম নিতে গেলেন আর তখনি মহাদেব সমুদ্রাগ্নিকে একটি পাত্রে ভরে সরস্বতীর সম্মুখে হাজির করলেন।
নারী মহিমায় ভারতের কোণায় কোণায় বিখ্যাত ও স্মরনীয় হয়েছে বহু স্থান। পুরাণের সরস্বতী থেকে রামায়ণের সীতা কিংবা চিরস্মরণীয়া পঞ্চকণ্যাঃ অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দোদরী! বিদুষী ঘোষা-অপালা-গার্গী-খণা? মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস থেকে কল্পনা চাওলা অথবা পুরুষের লালসার স্বীকার হয়ে শহীদ হয়েছেন যাঁরা…. কত নির্ভয়া, দামিনী কিংবা অবলা নারীরা আমাদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।
ছোটবেলা থেকে আমাদের সরস্বতীর গল্প বলা হয় আর সরস্বতীর চারপাশে একটা বিশ্বাসের সুদৃঢ় বলয় তৈরী করা হয়। সরস্বতী ব্র্যান্ড নিঃসন্দেহে জবরদস্ত এবং নদী বা দেবী কিংবা দুটোই ভেবে নিয়ে সরস্বতীর পায়ে বছরের পর বছর চোখ বুজে ফুল ছুঁড়ে আসছি আমরা। কিন্তু যদি ভেবে নিই তিনি আদতে আমাদের মধ্যে কোনো একজন মেয়ে তাহলে সমাজের স্তরে স্তরে এমন মেয়ের গল্প কিন্তু আমাদের খুব চেনাজানা।
এমন আরও একটি গল্প ভাবিয়ে তোলে আজও যেখানে সরস্বতী নামের মেয়েটি পুরুষের লালসার স্বীকার হয় একাধিকবার। সেই সমাজের দুটি শক্তিমান পুরুষের সম্ভোগ লালসার টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত হয়ে যায় মেয়েটির জীবন। তবুও সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেঁচে থাকে।
একবার ঋষি বশিষ্ঠ সরস্বতীর তীরে তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। তাঁর শত্রু মুনি বিশ্বামিত্র এসে সরস্বতীকে বললেন বশিষ্ঠকে নিয়ে প্রচন্ড বেগে তাকে লন্ডভন্ড করে প্রবাহিত হতে। সরস্বতী প্রথমে রাজী হননি। অবশেষে বিশ্বামিত্রের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে দু’কুল ছাপিয়ে ধ্যানমগ্ন বশিষ্ঠকে নিয়ে বানভাসি হলেন। নদীর ঢেউয়ের সর্বোচ্চ শিখরে ধ্যানমগ্ন বশিষ্ঠ। একবার উঠছেন আবার একবার নামছেন ঢেউয়ের দোলায়। বিশ্বামিত্র তো বেজায় খুশি। কিন্তু এই প্লাবনে বশিষ্ঠের কোনো হেলদোল নেই দেখে তাঁর একটু সন্দেহ হল। বিশ্বামিত্র বুঝলেন সরস্বতী বশিষ্ঠকে নিশ্চয়ই রক্ষা করছে। অতএব সরস্বতীর এইরূপ ছলাকলায় যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হয়ে বিশ্বামিত্র সরস্বতীকে অভিশাপ দিলেন ও সরস্বতী অচিরেই রক্ত রূপী নদীতে পরিণত হল। মুনি ঋষিরা যখন সরস্বতীর তীরে স্নান করতে এলেন তখন বিশুদ্ধ জলের পরিবর্তে রক্ত দেখে খুব আশ্চর্য হলেন। সরস্বতী তাঁদের কাছে কেঁদেকেটে সব কথা খুলে বললেন ও বিশ্বামিত্রের এহেন দুরাভিসন্ধির কথাও জানালেন। নিজের মুক্তি চাইলেন ও পুনরায় পূত:সলিলা সরস্বতী রূপে ফিরে চাইলেন নিজের জীবন। সেই দয়ালু মুনিঋষিদের প্রার্থনায় শাপমুক্ত হলেন সরস্বতী এবং পুনরায় বিশুদ্ধ হল নদীর জল। এই কারণে সরস্বতীর অপর এক নাম “শোন-পুণ্যা’
এবার দেখি সরস্বতী নামে আমাদের মেয়েটি কি সুখী বিবাহিত জীবন পেয়েছিল নাকি কদর্য এই পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতি ঘৃণায়, লাঞ্ছনায় বিয়ের মত প্রহসনের দিকে পা-ই বাড়াল না? নাকি আজকের দিনের মত বিবাহ-বিচ্ছিন্নাই থেকে গেল আজীবন? নাকি একাধিক সপত্নীর সাথে ঘর করার অসহ্য বেদনা বুকে নিয়ে পালিয়ে গেল এই পৃথিবী ছেড়ে?
না,পালিয়ে যায়নি। পরাজিত হয়নি। দাপটের সঙ্গে লড়ে গেছে পুরুষের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ করে গেছে পুরুষের কামনার স্বীকার হতে হতে। কিন্তু বেঁচে রয়েছে আজও মানুষের মনে, কারণ সে অপারাজিতা।
সে যুগে বিয়ের ফাঁদে আদৌ কি বাঁধা পড়ত দেবদেবীরা? রক্তমাংসের সম্পর্কের মত দেবদেবীদেরও তো কৈশোরে বয়ঃসন্ধির সুবাদে দেহরসের ক্ষরণ ও সেই হেতু ছোঁকছোঁকানিও ছিল। ছিল ইভ-টিজিং ও মলেস্টেশন। আর জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বলি দেব-দৈত্যকুলে রেপিস্টের সংখ্যাও নিদেন কম ছিল না সে যুগে। তারা লিভটুগেদার বা “থাকাথাকি’ তে বিশ্বাসী ছিল না বিয়ের মত লিগাল ইনস্টিটিউশানে বিশ্বাসী ছিল সে তো পরের কথা। সেক্স ও ভায়োলেন্স এর দাপট কিন্তু এ যুগের চেয়ে সে যুগে কিছু কম ছিল না। সরস্বতী সাজগোজ, পোশাক-আশাকের মধ্য দিয়ে আর সর্বোপরি তাঁর গুণ, বুদ্ধি আর বিদুষী ব্যক্তিত্ত্বের দ্বারা পিতৃসম ব্রহ্মা থেকে শুরু করে প্রেমিক তুল্য নারায়ণের মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যাকে আমরা এখন শহুরে ভাষায় বলি “হেড টার্নার’; হতেই পারে। সমাজে এমন মেয়ের কদর তো হবেই যিনি একাধারে রূপসী আবার বিদুষী।
পুরাণে বলা হয় সরস্বতী ছিলেন অসম্ভব ঝগড়াটে আর তার মেজাজ ছিল দাপুটে। হতেই পারে। যিনি একহাতে বশিষ্ঠ থেকে বিশ্বামিত্র আর অন্যহাতে ব্রহ্মা থেকে বিষ্ণুকে নাচাতে পারেন তিনি তো অযোনিসম্ভবা, অসামান্যা। কিন্তু আজকের সমাজের চিত্রটাও ঠিক তেমনি আছে অনেক ক্ষেত্রে।
বিয়ের সত্যতা যাচাই করবে কিংবদন্তির দলিল। তবে পুরাণের আরেকটি গল্পের মতে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং গঙ্গা ছিলেন বিষ্ণুর তিন পত্নী। বিষ্ণু কিন্তু গঙ্গার প্রতি একটু বেশিমাত্রায় আসক্ত ছিলেন। নম্রস্বভাবের লক্ষ্মী এই ঘটনায় মনে মনে খুব দু:খ পেতেন কিন্তু কিছু প্রকাশ করতেন না। সরস্বতী কিন্তু বিষ্ণুর এই অতিরিক্ত গঙ্গাপ্রেমকে প্রশ্রয় না দিয়ে অশান্ত এবং রুষ্ট হয়ে প্রচন্ড উগ্রমূর্তি ধরলেন। গঙ্গার মুখোমুখি হলেন। লক্ষ্মী একটি ভয়ানক কলহের পূর্বাভাস পেয়ে সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন। সরস্বতী লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়ে একটি গাছে পরিণত করলেন। লক্ষ্মী আবার সেই অভিশাপে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সরস্বতীকে নদীতে রূপান্তরিত করলেন। সরস্বতী নিজেও তখন উগ্রচন্ডা। নিজে নদীতে পরিণত হয়েছেন বলে গঙ্গাকেও নদী হতে অভিশাপ দিলেন। ইতিমধ্যে বিষ্ণু সেইখানে হাজির হলেন। এতসব ঝগড়া বিবাদ দেখে ও শুনে স্থির করলেন সরস্বতী ও গঙ্গার সাথে আর নয়। এখন থেকে তিনি কেবলমাত্র লক্ষ্মীর সাথেই ঘর করবেন। সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে এবং গঙ্গাকে শিবের হাতে সমর্পণ করে বিষ্ণু হলেন লক্ষ্মীর প্রিয় পতিদেবতা। বিষ্ণুকে শান্ত হতে বলে সরস্বতী ও গঙ্গা মর্ত্যের ওপর দিয়ে নিজ নিজ গতিপথে বইতে লাগলেন। স্বর্গে তাদের দুজনার একটি করে শাখা বিষ্ণুর হাত ধরা রইল। অতএব আবারও পুরুষের সেই বহুগামীতাকে মেনে নিয়ে সরস্বতী কিন্তু এক সাংসারিক সমঝোতায় এলেন। নিজেই সরে এলেন।
এমন সরস্বতী যেন বারবার ফিরে আসে আমাদের সমাজে নির্ভয়া, দামিনী বা আমানত হয়ে যাকে মনে রাখার জন্য বছরে একটি নির্দ্দিষ্ট দিন পালন করা হবে ঠিক যেমন পালিত হয় নারীদিবস কিংবা নির্ভয়া দিবস। আর পূজাপাঠ-অঞ্জলি-আরতি এ সব তো মনগড়া! আসল তো সে মেয়ের ব্র্যান্ড যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে দাগ কেটে দিয়ে যাবে। সে তো আমাদেরই ঘরের চেনা এক নারী অথবা শুধুই মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়! আর তাই সরস্বতী পুজোয় তাঁকে আবারও সেলাম জানাই!
রচনাকাল : ১৬/২/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।