বাণী বন্দনা (ধর্মীয় আলোচনা প্রসঙ্গ)
তথ্য-সংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
।। ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার দেবী হলেন সরস্বতী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি পালন করতে সাহায্য করা।
ঋগ্বেদে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দেবী সরস্বতীর।
দুর্গাপুজোর পাশাপাশি মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো হয়। জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার দেবী হিসেবে পূজিত হন দেবী সরস্বতী।
ভারতের বাইরে জাপান, ভিয়েতনাম, বালি ও মায়ানমারেও চল আছে সরস্বতী পুজোর।
দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে জানা যায়, পরম কুস্মন্দেরে প্ৰথম অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী।
প্রথমে ব্রহ্মা দেবী সরস্বতীর পুজো করেন। পরে তার পুজো জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়, তিনি নারায়ণের থেকে সৃষ্টি হন তাই তিনি নারায়ণকে স্বামী হিসেবে ভাবতে লাগেন। পরে তিনি গঙ্গার দ্বারা অভিশাপ পান ও পুনরায় শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হন ও ব্রহ্মাকে স্বামী রূপে গ্রহণ করেন। আর এরপরই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পুজো প্রবর্তন করেন শ্রী কৃষ্ণ।
আবার অন্য আর একটি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়, নারায়ণের তিন পত্নী ছিলেন গঙ্গা, লক্ষ্মী ও সর্বস্বতী। একদা গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে, সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমুল বিবাদ লেগে যায় তিন দেবীর মধ্যে। এই বিবাদের পরিণামে তিন দেবী একে অপরকে অভিশাপ দেন। গঙ্গার অভিশাপে নদীতে পরিণত হন সরস্বতী। এই ঘটনার পর নারায়ণ বিধান দেন যে, সরস্বতী এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও শিবের কন্যা হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন ঘটবে।
আর সেই মতই গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী মর্ত্যে নদী হলেন এবং ব্রহ্মার পত্নী হলেন ও শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হয়ে তার কন্যা হলেন।
অন্যদিকে, স্কন্দপুরাণ অনুসারে জানা যায়, জগতে সকল দেবতার তীর্থ আছে, শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই। একদা একদিন ভেবে পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। স্কন্দপুরাণের কাহিনী অনুসারে জানা যায়, নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেন ব্রহ্মা। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়লে ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবেন।
এরপর, ব্রহ্মার নির্দেশে তার স্ত্রী সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে আসনে ব্রহ্মা তাকে সবসময় তার কাছে থাকতে বলেন। সরস্বতীকে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করবেন বলেও জানান ব্রহ্মা। ব্রহ্মার এই কথায় সরস্বতী ভয় পেয়ে বলেন যে, তিনি লোকের স্পর্শ ভয় পান বলে সব সময় তিনি পাতালে থাকেন। পাশাপাশি, ব্রহ্মার আদেশও তিনি অমান্য করতে পারেন না। তাই, ব্রহ্মাকেই সবদিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করতে বলেন সরস্বতী। জানা যায়, এরপরই ব্রহ্মা সেখানে সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করেন এবং সেই হ্রদে সরস্বতী অবস্থান করতে থাকেন। সেই হ্রদ ও সরস্বতীকে রক্ষা করার জন্য ব্রহ্মা সেখানে ভয়ংকর সাপেদের রক্ষক নিযুক্ত করেন।
দেবী সরস্বতী হলেন শুক্ল বর্ণ, শুভ্র হংসবাহনা, বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে থাকে তার। অর্থাৎ, সাদা গায়ের রঙের পাশাপাশি সাদা রাজহাঁস হল দেবী সরস্বতীর বাহন। আবার অন্যদিকে, দেবীর এক হাতে থাকে বীণা অন্য হাতে থাকে বই বা পুস্তক।
কিন্তু সরস্বতী দেবী শুক্ল বর্ণা কেন?
জানা যায়, শুক্ল বর্ণ অর্থাৎ সাদা হল ভাল গুণের প্রতীক, স্বচ্ছতার প্রতীক, নির্মলতার প্রতীক।
আবার অন্যভাবে জানা যায়, জ্ঞানময়ী সর্বশুক্লা দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতী জ্ঞানে গুণান্বিত বলে তার গায়ের রঙ শুক্লবর্ণ অর্থাৎ দোষহীনা অর্থাৎ যার কোন দোষ নেই।
একদিকে দেবী সরস্বতী পবিত্রতার মূর্তি। আর অন্যদিকে, তিনি জ্ঞানদান করেন বলে তিনি আবার ‘জ্ঞানদায়িনী’ও।
জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস।
জানা যায়, হাঁস অসারকে ফেলে সার গ্রহণ করতে পারে। কাদায় মিশ্রিত স্থান থেকে তার খাদ্য খুঁজে গ্রহণ করতে পারে একমাত্র হাঁসই। দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকুও গ্রহণ করতে পারে হাঁস।
দেবী সরস্বতীর সঙ্গে পূজিত হয়ে সবাই যেন অসার, ভেজাল, অকল্যাণকরকে পরিহার করে নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করে এবং পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে তারই শিক্ষা দেয় হাঁস। আর তাই দেবী হংসবাহনা।
দেবী সরস্বতী বীণাপাণি কেন ?
বীণার ঝংকার থেকে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। বীণার জীবন ছন্দময়। মনে করা হয়, বিদ্যার দেবী সরস্বতীর ভক্তরা সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধিলাভ করলে বীণার ধ্বনি শুনতে সক্ষম হন। বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। তাই বিদ্যার্থীদেরও মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর ও সঙ্গীতময় হয় তাই দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে। তাই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’।
দেবী সরস্বতীর হাতে পুস্তক থাকে কেন ?
বিদ্যার্থীদের লক্ষ্য জ্ঞান অন্বেষণ করা। আর জ্ঞান ও বিদ্যার অন্বেষণের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার ‘বেদ’ দেবী সরস্বতীর হাতে থাকে। সেই বেদই হল বিদ্যা। দেবী সরস্বতী আমাদের জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র করতে আশীর্বাদ করেন।
জানা যায়, সরস্বতী শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘সার’ এবং ‘স্ব’ দুটি শব্দের সমন্বয়ে।
সরস্বতী শব্দের অর্থ হল, যিনি কারো মধ্যে সারজ্ঞান প্রকাশ করেন। আবার অন্যদিকে, জানা যায়, সরস্বতী শব্দটি সংস্কৃত ‘সুরস বতি’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হল জলের আধার। সরস্বতী সাক্ষাৎ দেবী মূর্তি এবং নদী এই দুই রূপেই প্রকট হন।
দেবী সরস্বতীর আবির্ভাবের রয়েছে আরও কাহিনী,
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে আরও জানা যায় যে, গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের কন্ঠদেশ থেকে উদ্ভূতা হয়েছিলেন দেবী সরস্বতী।
আবার পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে আরও জানা যায় যে, এক সময় যখন সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন শ্রীব্রহ্মা, শান্তভাবে ধ্যানস্থ হয়ে চিন্তা করছেন কী করবেন, কী করা উচিত ? তখন সেই সময়ে শ্রীব্রহ্মার শরীর থেকে এক সুন্দরী দেবীমূর্তি প্রকাশিত হন। ওই সুন্দর দেবী মূর্তি ব্রহ্মাকে বলেন, হে বিধাতা আমি আপনার থেকে প্রকাশিত হলাম। এখন দয়া করে আমার স্থান এবং কী কর্ম তা আপনি আমায় বলে দিন।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ব্রহ্মা তখন তাকে বলেন, তোমার নাম সরস্বতী। তুমি অবস্থান করবে সকলের জিহ্বাতে বিশেষভাবে সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে তুমি নৃত্য করবে। পৃথিবীতে তুমি একটি নদীরূপে প্রকাশিত হবে।
পুরাণে বিচিত্র লীলাময়ী রূপে ধরা দিয়েছেন
বেদের যজ্ঞধাত্রী সরস্বতী। অনেকগুলি পুরাণেই সরস্বতীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
দেবী সরস্বতীর আরও রূপ
বেদ আর সরস্বতী অভিন্ন। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির দেবী হলেন সরস্বতী। সরস্বতীর বিশেষ অর্থ হল জোতির্ময়ী। তিনি তিমির বিনাশী।
আবার রূপে লক্ষ্মী হলেও গুণে তিনি সরস্বতী। দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক হওয়ার কারনে তিনি শ্বেতবর্ণা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা। বীণা ও পুস্তকধারিণী মহাশ্বেতা।
অন্যদিকে, বৈদিক জনগোষ্ঠী ভরতদের আরাধ্য বলেই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ভারতী।
যজ্ঞস্থলে সারস্বত বীণাধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রতিটি স্তোত্র। আবার কারও মতে, গন্ধর্ব কিন্নরদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলেই দেবী সরস্বতীর অপর নাম বীণাপাণি।
পৌরাণিক বাগদেবী বরদা বাগেশ্বরীর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে ওঠেন বৈদিক সরস্বতী।
কালক্রমে ভাষার দেবী হয়ে ওঠেন সরস্বতী। বাক্য দিয়ে সজ্জিত হয়ে ওঠে ভাষা। সরস্বতী তাই বাক্যদেবী। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাণীসরস্বরতী রূপেই আরাধিতা তিনি।
অন্যদিকে, সপ্তসিন্ধুর অন্যতম নদী হল সরস্বতী।
খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ সহস্রাব্দে উত্তরপশ্চিম ভারতে এক সুবিশাল তটিনী সরস্বতী। হিমালয়ের সিমুর পর্বতের প্লক্ষ প্রস্রবণ ছিল সরস্বতীনদীর উৎসস্থল।
সরস্বতী নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতার প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এই নদীর তীরেই অনুষ্ঠিত হত বৈদিক সারস্বত যজ্ঞ।
সারস্বত সমভূমি ছিল অতি ঊর্বরা। কৃষিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। আর সেই কারণে একসময় একসময় কৃষিদেবী হিসাবে পূজিত হতেন দেবী সরস্বতী।
মেয়েরা “সারস্বতব্রত” পালন করতেন উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায়। আবার অন্যদিকে, আরোগ্য শুশ্রুষা অর্থাৎ মেডিসিনেরও দেবী হলেন সরস্বতী। চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে এখনও যোগ রয়েছে দেবী সরস্বতীর তা বলাই যায়। এখনও তার পুজোয় পুজোর উপকরণ হিসেবে বাসক ফুল ও যবের শিষ আম্রমুকুল ব্যবহার হয়। আয়ুর্বেদে যেগুলির ভেষজ মূল্য অপরিসীম।
কালক্রমে ধীরে ধীরে সরস্বতী নদীর অবলুপ্তির পাশাপাশি নদী হয়ে উঠলেন বিদ্যার দেবী। বেদের দেবী।
দেবী সরস্বতী একসময় শাক্তদেবী রূপেও সুপরিচিত ছিলেন। পুরাণ অনুসারে দানা যায়, তিনি বৃত্র নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন। সরস্বতী হংসবাহিনী নন, সিংহবাহিনী দনুজদলনী দেবী ছিলেন। তিনি ত্রিনয়না। জটামুকুট ধারিনী ছিলেন। তবে ক্রমশ কালের নিয়ম দেবীর এই শাক্তরূপটি ক্রমশ চাপা পড়ে গিয়ে সূক্ষ্ম কোমল অনুভূতি ও সৌন্দর্য তথা ললিতকলার দেবী হয়ে ওঠেন দেবী সরস্বতী।
রচনাকাল : ১৬/২/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।