পুরাণের গল্প কথা ও কাহিনী (চতুর্থ পরিচ্ছেদ)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ আসনে থাকা তিন দেবতার অন্যতম হলেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে নিয়েই ত্রিমূর্তি। পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা হলেন স্বয়ম্ভু্। অর্থাত্ তাঁর কোনও পিতা ও মাতা নেই। তিনি নিজেই নিজের জন্ম দিয়েছেন। এই আশ্চর্য জন্মের পর ব্রহ্মা ধ্যানে বসেন। সেই ধ্যানে তিনি তাঁর সকল ভালো গুণকে একত্র করতে থাকেন। আর ব্রহ্মার সকল ভালো গুণ একত্রিত হয়ে তা ধীরে ধীরে এক নারীর আকার নিতে থাকে। এই ভাবেই ব্রহ্মার মুখ গহ্বর থেকে সৃষ্টি হয় দেবী সরস্বতীর। ব্রহ্মার প্রথমে একটিই মুখ ছিল। অত্যন্ত সুন্দর সেই দেবীকে দর্শন করার জন্যই ব্রহ্মার আরও চারটি মুখের সৃষ্টি হয়।
পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেও নিজের সৃষ্টি নিয়ে তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। সরস্বতী তাঁকে এই বিশ্বকে কী ভাবে আরও সুন্দর করে তোলা যায়, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেন। পুরাণের কোথাও কোথাও সরস্বতীর স্বামী হিসেবে বিষ্ণুর কথা উল্লেখ করা আছে। আবার কোথাও ব্রহ্মাকে সরস্বতীর স্বামী হিসেবে বলা হয়েছে। পুরাণের একটি কাহিনি অনুসারে একবার কোনও একটি অনুষ্ঠানে ব্রহ্মার পাশে সময়মতো এসে উপস্থিত হতে পারেননি সরস্বতী। সেই কারণে ব্রহ্মা গায়ত্রী নামে নিজের আরও এক স্ত্রীর সৃষ্টি করেন। সেই কথা জানতে পেরে অত্যন্ত ক্রুাদ্ধ হয়ে ওঠেন সরস্বতী। তিনি ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে ত্রিমূর্তির অন্যতম হলেও মর্ত্যলোকে ব্রহ্মার পুজো করা হবে না। সেই কারণে শিব ও বিষ্ণু পূজিত হলেও ব্রহ্মার মন্দির সে ভাবে কোথাও দেখা যায় না।
পুরাণ অনুসারে বসন্ত পঞ্চমীতেই দেবী সরস্বতীর জন্ম হয়। সরস্বতী সকল বেদের মা বলে মনে করা হয়। সকল শব্দ ও ভাষার উত্পসত্তি তাঁর থেকে হয়েছিল বলে ব্রহ্মা সরস্বতীর নাম দেন বাগদেবী। আমাদের রাজ্য সহ পূর্ব ভারতের অনেক জায়গাতেই সরস্বতীকে শিব ও পার্বতীর কন্যা বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মে সরস্বতীকে মঞ্জুহশ্রী নামে আরাধনা করা হয়।
আকাশগঙ্গা শুনলেই কী মনে হয়? খুবই পবিত্র কিছু একটা। মনে বেশ একটা শুদ্ধ ভাব জেগে ওঠে। স্বাভাবিক, একে আকাশ, তায় আবার গঙ্গা। যেখানেই থাকুন, গ্রাউন্ড ফ্লোরে বা কোনও বহুতলের খোপে, এক লহমা চোখটা চলে যাবেই আকাশের দিকে। কিন্তু, পুরাণের পাতা যদি ওল্টান, দেখবেন এই ‘আকাশগঙ্গা’র শুরুতে আছে খুবই অদ্ভুত একটা গল্প। যৌনাচারের গল্প। তা-ও আবার অন্য কেউ নয়, মহামান্য একটি দেবতার যৌন কেচ্ছা।
তিনি ব্রহ্মা। প্রচলিত হিন্দু ধর্মে ত্রিদেবের অন্যতম। বিষ্ণু আর মহেশ্বরের পাশেই তাঁর স্থান। প্রশ্ন হল, সেই ব্রহ্মার সঙ্গে আকাশগঙ্গার যোগটা কোথায়? সে প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে পুরনো কথায় একটু ঢুকতে হবে।
পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী, ব্রহ্মা হলেন স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ, তাঁর কোনও পিতা বা মাতা নেই। তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। সেই অলৌকিক জন্মের পর তিনি ধ্যানে বসলেন। সদ্যোজাত ব্রহ্মার সেই ধ্যান ছিল একাগ্র। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন। আশ্চর্য সেই ধ্যানের তেজ ক্রমে বাড়িয়ে তুলল দেব ব্রহ্মার ভিতরে বিভিন্ন সদগুণ। তাঁর ভিতরে যা কিছু ভালো, সে সব জড়ো হয়ে ধীরে ধীরে একটি আকার নিতে থাকল। পরমা সুন্দরী একটি কন্যার আকার। তারপর এক সময় অপরূপা সেই কন্যাটি ব্রহ্মার মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন। বলা যায়, তাঁর জন্মই হল ব্রহ্মার মুখগহ্বর থেকে। এবং, মনে রাখা দরকার, তখনও কিন্তু ব্রহ্মার মুখ চারটি নয়। মাত্র একটি।
এই পর্যন্ত অবশ্য এই গল্পের ভূমিকামাত্র, আসল কাহিনিটি ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে। ব্রহ্মার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সেই সুন্দরী মেয়েটিই হলেন বাক বা সরস্বতী। সেই মেয়ের রূপে মুগ্ধ হলেন ব্রহ্মা। তিনি সেই কন্যার পিতা, কারণ তাঁর থেকেই সেই মেয়ের জন্ম। অথচ, ব্রহ্মা কিন্তু সরস্বতীকে পিতার দৃষ্টিতে দেখলেন না মোটেই। দেখলেন কামার্ত পুরুষের চোখে। তিনি সেই সুন্দরীর সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতে চাইলেন, যদিও সম্পর্কের দিক থেকে ভাবলে, তিনি স্বয়ং সেই মেয়ের বাবা।
এর কারণ কি এটাই যে, ব্রহ্মার নিজের উৎপত্তি কোনও পারিবারিক বাঁধন থেকে নয়? যেমন বলা হয়েছে আগে, তাঁর কোনও পিতা বা মাতা নেই। তিনি স্বয়ম্ভূ, ফলে পিতার সঙ্গে কন্যার সম্পর্ক কী হতে পারে, সে বিষয়ে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না। পুরাণ এ প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব দেয়নি, কিন্তু পুরাণের গল্পগুলিকে ফিরে দেখতে বসলে এ রকম কিছু প্রশ্ন জাগতেই পারে। সেই ব্যাখ্যায় আমরা পরে আবার ফিরব, আপাতত সেই ব্রহ্মার কাহিনিতে যাই।
পিতার কামলোলুপ রূপ দেখে সরস্বতীর ভয় হল। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যেন লেপ্টে যাচ্ছে সেই দৃষ্টি। সরস্বতী সেই কামার্ত পুরুষ-দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইলেন। যথাসাধ্য সেই চেষ্টায় ফল বিশেষ হল না, কারণ তিনি যে দিকেই যান, সেই দিকেই ব্রহ্মার একটা করে মুখ তৈরি হয়ে যায়। এই ভাবে এক এক করে ব্রহ্মার পাঁচটি মুখ তৈরি হয়ে গেল। কোনও ভাবেই পিতার যৌনকাতর দৃষ্টি এড়াতে না পেরে সরস্বতী অন্য একটি পথ নিলেন। তিনি একটি রাজহংসীর রূপ ধরলেন, আর উড়ে গেলেন শূন্যে। ব্রহ্মাও ছাড়ার পাত্র নন। তৎক্ষণাৎ একটি রাজহাঁস হয়ে তিনিও আকাশপথে সরস্বতীর পিছু ধাওয়া করলেন। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। পিতার যৌনক্ষুধা থেকে বাঁচতে কন্যা রাজহংসী হয়ে উড়ে চলেছেন। পিছনে রাজহংসের রূপ ধরে উড়ে চলেছেন পিতাও।
রাজহংসীর রূপ ধরে সরস্বতীর এই উড়ানপথকেই পুরাণে বলা হয়েছে আকাশগঙ্গা।
শব্দটি শুনলে কখনও মনে হয়, তার আড়ালে আছে কামজর্জর এমনই এক পিতার গল্প? শেষ পর্যন্ত অবশ্য পালাতে পারেননি সরস্বতী। ব্রহ্মার কাছে তাঁকে ধরা দিতেই হয়েছিল। পুরাণ জানাচ্ছে, পিতা-কন্যার সেই মিলনের ফলে জন্ম নিল পৃথিবীর প্রথম মানুষ। মনু সায়ম্ভূব।
পুরাণে দেবদেবীদের যৌনাচারের এমন কাহিনি অগণিত। বোঝা যায়, ভারতীয় সমাজের আদিকাল থেকেই মানুষের কল্পনায় বিচিত্র রূপে দেখা দিয়েছে যৌন কামনা। তারই ছাপ এসে পড়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রকাহিনিতে। আমরা, এ কালের জনতা, সেই গল্পগুলি পড়ি। ভাবতে থাকি কেমন ছিল সে কালের যৌনকল্পের ছবি।
রচনাকাল : ১৩/২/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।