প্রেমের কথা এলেই আমাদের চোখের সামনে আসে একটাই ফুল, গোলাপ। কিন্তু মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে এই গোলাপের সাথে প্রেমের এমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক হলো কিভাবে?
সত্যিই তো! এত ফুল থাকতে শুধু গোলাপই কেন?
কথায় আছে যখনই মনে এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন আসবে, কোনো না কোনো এক পৌরাণিক কাহিনী আপনার পথপ্রদর্শক হয়ে যাবে। এক্ষেত্রেও তাই - এই ব্যাপারে এক লম্বা গল্প আছে যার সবটাই পাওয়া গ্রীক পুরাণ থেকে। পৌরাণিক কাহিনী হলেও নানান জায়গা থেকে টুকটাক তথ্য সংগ্রহ করে এই গল্পটা একটু নিজের মতো করে সাজানোর চেষ্টা করলাম.........
--------------------------
কোনো এক গরমকালের সকাল, যদিও আগের রাতে তুমুল ঝড়ঝঞ্ঝার ফলে পরিবেশটা বেশ মনোরম। সকাল সকাল বেশ ফুরফুরে হাওয়া চলছে দেখে আর চারপাশটা বেশ বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে আছে দেখে দেবী ক্লোরিস একটু পায়চারী করতে বেরোলেন, গত রাতের ঝড়ে সব ঠিক আছে কিনা দেখার জন্যে। দেবতামহলে এই দেবী ক্লোরিসের বেশ চর্চা আছে বসন্ত ঋতুর দেবী হিসেবে, তবে তার মূল পরিচয় হলো যে তিনি হলেন ফুলের দেবী। তার সুবিশাল বাগানের নানান ফুল এই পৃথিবীর শোভাবর্ধনে লালিত হয়ে আসছে। তার বাগানে যেন চির-বসন্ত, সবসময় পরীরা সেখানে খেলে বেরায়, তারা সেখানেই থাকে ফুলের মধ্যে।
তা মনোরম পরিবেশে হাঁটাটা বেশ উপভোগই করছিলেন দেবী ক্লোরিস, যদিও গত রাতের ঝড়ের ফলে কিছু ক্ষয়ক্ষতি তার মনকে বেশ কষ্টই দিচ্ছিলো। তিনি জানেন প্রকৃতির এরকমই নিয়ম, সেই নিয়ম মেনেই ভারসাম্য রক্ষার জন্যে ঝড়-বৃষ্টির দেবতা তার দূত পাঠান। তাও, গাছেরা যে তার খুব কাছের, ফুলেরা তার সন্তানসম, তাই কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশে পাশে কিছু ভাঙ্গা গাছের ডাল দেখে তিনি মনে মনে ঠিকই করছিলেন যে এবারে ঝড়ের দেবতাকে অভিযোগ করবেন তার পাঠানো দূতের নামে, যে এবারে সে বড় কঠোর আঘাত করেছে তার বাগানের কোমল গাছে, এমনসময় তিনি দেখলেন পথের ওপর কিছু একটা যেন পরে আছে। "কোনো গাছের ডাল তো এভাবে পরে থাকবে না" - ভেবেই সেইদিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়েই তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দেখলেন এক পরীর নিঃস্পন্দ দেহ, পথের ওপর শায়িত। এরা তো সারাদিন ফুলের সাথেই থাকতো, দেখাশোনা করতো গাছের, তাই এরা দেবীর খুব প্রিয়পাত্র। এরকম সন্তানতুল্য এক প্রিয়পাত্রের এমন হতভাগ্য দশা দেখে দেবী ক্লোরিস শোকে কষ্টে দিশেহারা হয়ে গেলেন।
একটু ধাতস্থ হয়ে তিনি ঠিক করলেন এই বনপরীকে তিনি বাঁচিয়ে তুলবেন, তবে একটু অন্যভাবে, অন্যরূপে। নতুনরূপে এই পরী হয়ে উঠবে আরও সুন্দর, আরও কোমল যাতে এরপর ঝড়-বৃষ্টির দেবতা বা তার নির্দয়ী দূতও ওকে আঘাত করার আগে দু'বার ভাববেন। ফুলের দেবী ক্লোরিস ঠিক করলেন একে পুনর্জীবিত করবেন এক অনন্যসুন্দর ফুলের রূপে। এমন এক ফুল, যা আগে কেউ দেখেনি বা কল্পনাও করেনি। সেই ফুল হবে রূপে বর্ণে অদ্বিতীয়।
সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েই গেল তখন আর দেরি করা উচিৎ নয় মনে করে সবার আগে তিনি সাহায্য চাইলেন তাঁর স্বামীর কাছে। তার স্বামী, জিফিরাস, হলেন পশ্চিমা বায়ুর দেবতা, যিনি পরিচিত পুরনোর আগল ভেঙে নতুনের আবাহন করা। গতরাতের ঝড়-বৃষ্টির পরে আকাশ মেঘলাই ছিল। কোনো দেহে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে অলিম্পিয়ান দেবতা অ্যাপোলোর আশীর্বাদ সবার আগে লাগবে, কারণ সূর্যের কিরণেই জীবনের চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকে। তাই দেবী তাঁর স্বামীকে অনুরোধ করলেন প্রবল হাওয়া দেওয়ার জন্যে যাতে আকাশের বাকি সব মেঘ কেটে যায় এবং সূর্যের আলো ও তাপ সরাসরি এই নতুন ফুলে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে। জিফিরাস তাঁর স্ত্রীর অনুরোধমতো আকাশের সব মেঘ সরিয়ে দিলেন। এভাবে সূর্যের আলো পরীর দেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটালো। ধীরে ধীরে নিজের সন্তানকে পুরর্জীবিত হতে দেখে ক্লোরিস খুবই আনন্দিত হয়ে উঠলেন। এবার তাঁর খেয়াল হলো, এই সন্তানকে সাজিয়ে তুলতে হবে, করে তুলতে হবে অনন্যসুন্দর। তাই তিনি এবার সাহায্য চাইলেন সৌন্দর্যের দেবী, আফ্রোদিতির কাছে।
দেবী আফ্রোদিতি হলেন ১২ জন অলিম্পিয়ান দেবতাদের একজন, পদমর্যাদায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দেবী। দেবী আফ্রোদিতি হলেন ভালবাসা, সৌন্দর্য, আনন্দ, আবেগের দেবী। নতুন প্রাণকে ভালোবাসায় এবং সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্যে দেবী ক্লোরিস দেবী আফ্রোদিতির কাছে অনুরোধ করলেন। দেবী আফ্রোদিতি নিজের সন্তানসম এক ছোট্ট প্রাণের পুনরুজ্জীবনে খুবই উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি এই নতুন প্রাণকে নিজের সমস্ত সৌন্দর্য উপহার দিলেন। এই নতুন ফুল সৌন্দর্যে আর জাঁকজমকে একেবারে অতুলনীয় হয়ে উঠল। সকম দেবতারা এই ফুলকে একবাক্যে "ফুলের রাণী" হিসেবে স্বীকার করে নিলেন।
ফুল তো হয়ে গেল, কিন্তু এই নতুন ফুলের নাম কি হবে? কেউ আর নাম ঠিক করতে পারে না। যে যা নাম বলে অন্যদের সেই নাম পছন্দ হয়না। 'ফুলের রাণী' র তো আর যেমন তেমন নাম হলে চলবে না! কি করা যায়? এই বিষম মুশকিলের সময়ে এগিয়ে এলেন দেবী আফ্রোদিতি। তিনি বললেন, "আমি একে আমার সন্তানের মত করে ভালোবেসে সাজিয়েছি, এ আমার মেয়ের মতো। একে তাই আমার ছেলের নামের সাথে মিলিয়ে নাম দিলাম রোজ (ROSE)। আমার ছেলে এরোজ (EROS) হলো প্রেমের দেবতা, আর এই ফুল তাঁর নাম নিয়ে হয়ে উঠবে প্রেমের প্রতীক, ভালোবাসার পূর্ণ নিদর্শন।" সকলে সমস্বরে নতুন ফুল 'রোজ'কে স্বাগত জানালো এই পৃথিবীতে।
সেই থেকেই প্রেমের প্রতীক হিসেবে ROSE কে মান্যতা দেওয়া হয়।
রচনাকাল : ১১/২/২০২১
© কিশলয় এবং অর্ণব দত্ত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।