আনমনে পুকুরপাড়ের বাঁশের ঘাটে জলে পা ডুবিয়ে বসে ছিল সোহা। পিছন থেকে এসে চোখ টিপে ধরলো শুভ। হাত দুটি ছুঁয়েই বুঝলো সোহা। বলল- "এত দেরি কেন শুনি? যাও কথা বলব না।"
--"প্লিস কলি রাগ করিস না।"
আদর করে সোহাকে চুপিচুপি কলি ডাকে শুভ। চোখ ছেড়ে পাশে বসল সে। বলল- আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাজ সেরে বাবার সাথে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। দুপুরের খাবার তার সাথে খেতে হলো। তাই..
-- বাহ, বেশ তো ভালই হলো। আমিই কিনা না খেয়ে একা একা বসে আছি।
-- স্যরি আমার ফুলকলি।
-- এই খবর্দার আমায় ফুলকলি বলবে না বলে দিলাম।
-- আচ্ছা আচ্ছা আর বলব না। এই নে ধর।
বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কয়েকটা বড় বড় মিষ্টি কুল বার করলো শুভ। খুশিতে ভরে উঠলো সোহার মুখ। কুল খুব ভালবাসে কিনা। এই হাসিমুখটা ভীষণ ভাল লাগে শুভর। এই হাসির অমোঘ আকর্ষণেই প্রতি রবিবার শুভ ছুটে আসে এই পুকুর পাড়ে। এদিকটা কলকাতা থেকে বেশ দূরে। তাই এলাকাটাও গ্রাম্য। এই পুকুর সোহাদের নিজস্ব। পাঁচিল ঘেরা এই পুকুর কারোর নজরে আসবে না। একমাত্র সোহারাই এ পুকুর ব্যাবহার করে। দুপুর মা ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ির পিছনদিকের এই পুকুরে চলে আসে সোহা। একা একাই কাটায়। মা এদিকটা দুপুরে আসেননা।
সোহা বড় প্রকৃতি প্রেমী। পুকুরপাড় টা তার বড় প্রিয়। কি সুন্দর টলটলে স্বচ্ছ জল। ছোট্টছোট্ট নুড়ির টুকরো যখন সোহা জলে ছুঁড়ে ফেলে, তখন কি সুন্দর বৃত্ত তৈরি হয়। অবাক হয়ে সোহা দেখে প্রকৃতির খেলা।
সোহার বাড়ির পাশেই শুভদেরই একমাত্র দোতলা বাড়ি। দুজনে একই স্কুলে পড়ে। সোহা ক্লাস এইট আর শুভ এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। দুজনের খুব ভাব। সোহার অভিমান মেটানো যেন শুভর নিত্য কাজ। কিশোরী সোহার গভীর অন্তঃকরণ যেন সদাই শুভর চিন্তায় নিমগ্ন। আর শুভ, সে তো বেশ কিছুটা বড় সোহার থেকে। তার হৃদয় চায়, একদিন সোহাকে আপন করে ঘরে তুলবে। তবে বাবাকে খুব ভয় পায় শুভ। জানে বাবা কখনো সোহা কে মেনে নেবেননা। সোহার বাবা সামান্য কর্মচারী মাত্র। তবে শুভর মা বড় ভালবাসেন সোহাকে। শুভ মা কে সব কথা বলে। মা সান্তনা দিয়ে বলেন- বড় হ, পড়াশোনা শিখে চাকরির ব্যাবস্থা কর। তারপর সোহাকে নিয়ে আসিস। তখন আর বাবা কিছু বলতে পারবেনা। এটাই ভাবে শুভ।
আজ সোহাকে বড় ভাল লাগছে। হলুদ সাদা একটা শাড়ি পরেছে। খোলা চুল পুকুরের হাওয়ায় উড়ছে। নাকে ছোট্ট সাদা পাথরের নাকফুল যেন কয়েকগুণ সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে সোহার। অবাক হয়ে চেয়ে আছে শুভ।
-- এই কি দেখছ শুনি?
-- তোকে?
-- কেন?
-- তুই হঠাত শাড়ি পরেছিস কেন?
-- ইচ্ছা হল।
-- তুই খুব সুন্দর রে কলি। আর শাড়ি পরে তো ভীষণ সুন্দর লাগছে। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ তুই।
-- যাও। সব মিথ্যে।
-- তাই মনে হয় তোর? কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে শুভ।
শুভ এত কাছে এসে কখনো কথা বলেনি। তাই একটু চমকে গেলো সোহা। শুভ আজ হাতে হাত রাখলো। বলল- জানিস কলি, আজ প্রমিস ডে। আজ আমরা দুজন দুজনকে কিছু প্রমিস করব।
-- কি প্রমিস করবে?
-- আমি তোকে খুব ভালবাসি সোহা। তাই আজীবন তোর সাথে থাকার প্রমিস করলাম।
-- আমারও তোমায় খুব ভাললাগে, আমিও চাই সারাজীবন তোমার সাথেই থাকতে।
-- প্রমিস করছিস তো?
-- হ্যাঁ
-- জানিস কলি- আমরা খুব শীঘ্র চলে যাব এখান থেকে। এই গ্রাম বাবার মোটেই পছন্দের নয়। কিন্তু কি করে তোকে ছেড়ে থাকি বলতো?
ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো সোহার
-- কি বলছ তুমি? না যাওয়া হবে না তোমার। আমি আঙ্কেলের সাথে কথা বলব, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো সোহা।
-- শোন, বাবা এখন বাড়িতে নেই আর বলেও কিচ্ছু লাভ হবেনা। এই দুইছরেই এখানে বাবার হাঁফ ধরে গেছে।
বলতে বলতে হাত ধরে টান দিলো শুভ। টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে গেল সোহা।
"এ তুমি কি করলে?" - বলেই হাত ধরে শুভকেও টেনে নিলো সোহা। দুজনেই ভিজে গেছে। ভিজে গিয়ে আরো সুন্দর লাগছে সোহাকে। নারীত্ব এখন শুভর সামনে প্রস্ফুটিত। কি সুন্দর একরাশ ভিজে চুল। সরু কোমর, উন্নত বক্ষদেশ। চিকন গ্রীবা সমস্ত ভিজে গিয়ে মুক্তো দানার মত জল লেগে আছে। ঠাণ্ডা জলের মধ্যেও যেন সর্বাঙ্গ জুড়ে আগুন লেগে গেল শুভর। হাত বাড়িয়ে কাছে টানলো সোহাকে। বুকে জড়িয়ে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল- "আমায় ছেড়ে যাবি না তো কলি? তোকে খুব ভালবাসিরে।"
সোহা কিছু উত্তর দিতে পারলো না। মাথা নাড়লো শুধু। শুভর উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে যেতে থাকলো সোহার গাল, কপাল, খোলা কাঁধ। নরম দুটি গোলাপি ঠোঁট পুড়তে থাকলো শুভর আদরের উষ্ণতায়। ওরা এতটাই আবিষ্ট ছিল যে দেখতে পেলো না- দোতলার জানলা দিয়ে ওদের দেখছে শুভর বাবার আর একজোড়া চোখ।
এর পর একসপ্তাহের মধ্যে কলকাতা চলে গেলো শুভরা। খুব মনমরা হয়ে থাকলো সোহা। শুভ যাবার আগে বলে গেলো - চিন্তা করিসনা কলি। আমি আবার আসবো তোকে নিয়ে যেতে। শুধু তোর প্রমিস টা ভুলিস না। মন দিয়ে পড়িস কিন্তু। অনেক বড় হতে হবে তোকে। এই নে ধর এটা রাখ। সাদা গন্ধরাজ হাতে গুঁজে দিল কয়েকটা। গন্ধরাজ যে বড় প্রিয় সোহার।
পাঁচ বছর কেটে গেছে। শুভর আর কোন খোঁজ নেই। প্রতি বছর প্রমিস ডে আসে। অপেক্ষা করে থাকে সোহা। শুভ আর ফিরে আসেনি। বাবাকে শুভর ঠিকানায় কলকাতা পাঠিয়েছিল সোহা। কিন্তু খুঁজে পায়নি। ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে। সোহাদের তখন ফোন ছিলনা কিন্তু শুভর বাবামায়ের নাম্বারে বহুবার কল করেও সিম বন্ধ পেয়েছে সোহা। বুক ঠেলে কান্না এসেছে বারবার, তবু আসেনি শুভর কোন সন্ধান।
আজ সোহার বিয়ে।
আজও প্রমিস ডে।
অঝোর ধারায় কাঁদছে সোহা। এটা কি হলো তার সাথে? তার শুভ তো কথা রাখেনি। কিন্তু সেও যে রাখতে পারছেনা। এই নিয়ে অনেকগুলি বিয়ে ভেঙেছে সে। কিন্তু বাবা অসুস্থ। উনি একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হতে চাইছেন। গরীব, চিন্তাক্লিষ্ট বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েতে রাজী হয়েছে সোহা। বুক ফেটে যাচ্ছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়। বাবা বলেছেন- ছেলে নাকি ভাল চাকরী করে। কলকাতায় মা আর ছেলের সংসার। সোহাকে স্কুলে যাবার পথে দেখেই ছেলের পছন্দ। ছেলের মা এসে কথা পাকা করে গেছেন। ছেলের ফটো দেখেছে সোহা। ছেলেকে দেখতেও খারাপ নয়। তবুও মানতে পারছেনা সে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত হচ্ছে তার হৃদযন্ত্র।
তবু বিয়ে হয়ে গেলো নির্বিঘ্নে। শেহরা ঢাকা নতুন বরের দিকে তাকিয়েও দেখলো না সোহা। বাসর ঘরে তাকে একা বসিয়ে চলে গেছে মেয়ের দল। সারা ঘর গন্ধরাজ আর গোলাপে সাজানো। খাট থেকে নেমে চিঠিটা লিখে ভাঁজ করে টেবিলে চাপা দিলো সোহা। তারপর গিয়ে দাঁড়ালো জানলার ধারে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে বিশ্ব চরাচর। মনের মধ্যে শুধু অন্ধকার আর রক্তক্ষরণ। খুট করে আওয়াজ হলো। স্বামী হয়ত ঘরে ঢুকলেন। দরজা দেওয়ারও শব্দ হলো। তবু এগিয়ে গেল না সোহা। যদিও জানে- আজ রাতে সে ধর্ষিতা হবে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কেউ তাকে নিয়ে ফুলশয্যার বিছানার ফুল নষ্ট করবে। শয়নকক্ষ জুড়ে ভাসবে রমনের সৌরভ।
পুরুষটি এগিয়ে এসেই প্রথমে দেখলো ভাঁজ করা চিঠিটা। পড়লো আদ্যোপান্ত। লেখা রয়েছে--" আমি অন্যের ( শুভর) স্ত্রী। তার পরশ লেগে আমার প্রতিটি কোষে কোষে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমি তাকে ছাড়া আর কাউকে স্বামী মানতে পারিনা। ক্ষমা করুন।"
পুরুষটি এগিয়ে এলো সোহার দিকে। গাঢ় স্বরে ডাকলো "কলি..."
"কে?" চমকে উঠলো সোহা। এ কণ্ঠস্বর যে তার বড় চেনা, বড় আকাঙখিত। ঘুরে তাকাতেই দেখে -দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারই শুভ। একি ম্যাজিক নাকি? নাকি কোন সিনেমার সিন, ভাবতে পারলো না সোহা। তবু ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শুভর বুকে। শুভ আরো জোরে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় সোহাকে। অস্ফুটে বলে- আমি জানতাম আমার কলি কখনোই তার প্রমিস ভাঙতে পারেনা।
---কিন্তু কি করে তোমার সাথে বিয়ে হলো? আমি তো অনেক খুঁজেও পাই নি তোমায়?
সোহার হাত ধরে খাটে বসায় শুভ। তারপর সোহার কোলে মাথা রেখে বলে- "যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়, সে আমারই বন্ধু। সে জানতো না তুমিই কলি। তাই বিয়েতে রাজি হয়। ওর কাছে ফটো দেখে আমি আমার সব কথা ওকে খুলে বলি। বন্ধু শুনে অবাক হয়। -বলে ক্ষমা করে দে ভাই। আমি জানতামই না ওই তোর কলি। ওখান থেকে আসার পর বাবার ট্রান্সফার চাকরির জন্য আমরা ধানবাদ যেতে বাধ্য হই। একবছর আগে বাবা মারা গেছেন। আমি নতুন জব পেয়েছি। বর্তমানে আমি আর মা থাকি। মা সব কথা আমার বন্ধুর মাকে জানায়। বন্ধুর মা বলেন- ঠিক আছে। তোমাদের সোহা তোমাদেরই থাক। এর পর অন্য মেয়ে দেখে বন্ধুর বিয়ে ঠিক করা হয়। একসাথেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। আর এই ম্যারেজ হলেই আমাদের দুই বন্ধুর বাসরশয্যা রচনা হয়।
-- তা আমায় আগে কেন বলনি?
-- বললে কি আর এভাবে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে আসতিস পাগলি?
-- অসভ্য, যাও আর কথা বলবো না।
সোহার কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসে শুভ। বার করে কয়েকটা কুল। হেসে ফেলে সোহা।
সোহাকে বুকে ধরে আদরে আদরে পাগল করে দেয় শুভ। আজ আর কোন বাধা দেয় না কলি।
সারা ঘর জুড়ে তখন গন্ধরাজের সৌরভ।
টেবিলে রাখা ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছে প্রমিস ডে।
রচনাকাল : ১১/২/২০২১
© কিশলয় এবং মুসকান ডালিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।