ফুল বিছানো খাটের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল নয়ন। ডাগর দুটি চোখ জুড়ে এক আকাশ স্বপ্ন আর অজানা অনুভূতি। খুট করে দরজা খোলার শব্দে সচকিত হলো ইন্দ্রিয়। সাকিব ঘরে ঢুকেছে। মাথার কাপড়টা একটু বেশি করে টেনে নিল নয়ন। সাকিব এসেই ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো - যাও নিচে নেমে শোও। তোমাকে নিয়ে ফুলশয্যা করার কোন ইচ্ছে আমার নেই।
অবাক হয়ে গেলো নয়ন। এ কি শুনছে সে! মানছে ওকে সাকিব না দেখেই বিয়ে করেছে, কিন্তু তাই বলে গ্রহণ করবেনা কেন?
ও কিছুটা দ্বিধা নিয়েও বলেই ফেলল - আপনি তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন যে? কেন করলেন?
-- মায়ের জন্য। মায়ের পছন্দ ছিল বলে। আমি বিশাখাকে ভালবাসি। মা এসব জানেননা। নেহাত মা হার্টের পেসেন্ট তাই, নাহলে ওকে বিয়ে করেই এখানে ফিরতাম।
বুকটা কেঁপে উঠলো নয়নের। বললো - সত্যিই কি আমাকে গ্রহণ করা যায়না? আমি এবার কি করব?
আর সহ্য করলো না সাকিব। নয়নকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে দিল বিছানা থেকে। একটা বালিশ ছুঁড়ে দিল মুখের উপর। তারপর পিছন ঘুরে শুয়ে পড়লো খাটে।
নীচে বসে থাকতে থাকতে কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল বুক। তবুও একটা সময় ঘুমিয়ে গেল নয়ন।
পরদিন ভোরেই কলকাতা চলে গিয়েছিল সাকিব। বিগত তিন বছরে যতবার এসেছে, একটা কথাও বলেনি নয়নের সাথে। দূরে থেকেই একটা দুটো রাত কাটিয়ে চলে গেছে কলকাতায়। সব বুঝেছিলেন সাদিয়া। একমাত্র ছেলেকে চিনতে তার এত ভুল হবে ভাবতেও পারেননি। নয়ন ছিল তার বান্ধবীর মেয়ে। রংটা শ্যামলা হলেও চোখ দুটো যেন গভীর জলাশয়। স্নিগ্ধ শান্ত ব্যাবহার আর লম্বা দীঘল চুলের মেয়েটি বড় মায়াময় লেগেছিল সাদিয়ার চোখে। নয়নের মায়ের অসুখ শুনে গিয়েছিলেন সাদিয়া। সেখানে যাবার দুদিনের মধ্যেই মারা যান নয়নের মা। একমাত্র মামা ছাড়া আর কেউ ছিল না মাতৃহারা নয়নের। সাদিয়া নয়নকে নিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে। ছেলেকে কলকাতা থেকে আসতে বলেন। বিয়েও হয় মাত্র কয়েক জনের উপস্থিতিতে। কিন্তু তারপর সব কিছু স্পষ্ট হয় তার কাছে। নয়নকে দেখলেই খুব কষ্ট হয় সাদিয়ার। নয়ন কিন্তু হাসিমুখেই থাকে। সাদিয়ার দেখাশোনা করে পরম যত্নে। স্বামী না থাকলেও সাকিবের বাবার ব্যাবসাটা লোক মারফত চালান সাদিয়া। আয় যা হয়- দুজনের চলে যায় ভালভাবেই। তবু একটা শুন্যস্থান তিনি কি করে পূরণ করবেন? সাকিব কই? মেয়েটার জীবনটা গড়তে গিয়ে ভেঙেই ফেললেন তিনি। ভীষণ কান্না আসে বুকের ভিতর থেকে।
৮ই ফেব্রুয়ারী। সাকিবের ফোন আসে সেদিন সন্ধ্যাবেলা। সাকিব নাকি ঘরে আসছে, কলকাতায় থেকে অফিস আর করবেনা। বাবার ব্যাবসাটাই দেখবে। অবাক হয় নয়ন। এর আগে যাও বা দু একবার এসেছে ওকে দূরে থাকতে হয়েছে। আর এখন বরাবরের জন্য কি ওকে সহ্য হবে সাকিবের? হয়তোবা নতুন বউ নিয়েই ফিরবে সাকিব? কিন্তু সাকিব একাই ফেরে ঘরে। সাকিবকে কেমন যেন ক্লান্ত মনে হয় নয়নের। কাছে যাবার অনুমতি নেই, তাই দূর থেকেই দেখে প্রানভরে। মেরুন রঙের বোতাম খোলা শার্টের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ঘন লোম।
দিন গড়িয়ে রাত নামে। এই ফেব্রুয়ারীতেও শীতভাবটা বেশ রয়েছে। হু হু হাওয়া দিচ্ছে বাইরে৷ আজ অনেক করেই সাদিয়া বলেছিলেন সাকিবের ঘরে যেতে৷ কিন্তু রাজি হয়নি নয়ন। তবে বরাবরের মতো রান্নাসহ সব কাজ করে গেছে। সাকিবের খাওয়ার সময়ে একফাঁকে সাকিবের ঘরের মশারি টাঙিয়ে রেখে এসেছে গরম দুধের গ্লাস, জলের বোতল।
ঘরে আসে সাকিব। নিঁখুত সাজানো ঘর। প্রতিটি কোনায় কোনায় পরিচ্ছন্নতা। সাকিব দুধের গ্লাস মুখে তুলতে গিয়েও থমকে যায়। নয়নের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে এই গ্লাসে। মনে পড়ে বিয়ের রাতটার কথা। দুধের গ্লাস সেদিন রাগে ছুঁড়ে ফেলেছিল মেঝেয়। সাদা তরলের ধারা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে।
আজ আকাশটা আধো অন্ধকার। একফালি চাঁদের মৃদু আলোয় চারপাশ মায়াময়। শীতের কাঁথায় মুড়ে ঘুমিয়ে আছে গোটা গ্রাম। ঘুম নেই এই বাড়ির তিনটি প্রানীর চোখে। সাদিয়ার চোখ বেয়ে জলের ধারা। পাশ ফিরে শুয়ে আছে নয়ন। সাদিয়া জানেন ঘুমানোর অভিনয় করলেও নয়ন ঘুমায়নি আজ। বাইরে বারান্দায় চেয়ার টানার শব্দ। সাকিব এসে বসে। সাদিয়া নিঃশব্দে উঠে যান সাকিবের কাছে। ছেলে মাথা নিচু করে দু'হাতে মুখে ঢেকে তখন কাঁদছে নিঃশব্দে।
---কি হয়েছে বাবা?
এবার দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে সাকিব। বলে- আমি খুব ভুল করেছি মা। ক্ষমা করে দাও আমায়।
-- কি হয়েছে বল বাবা।
--বিশাখা আর আমি ভালবাসতাম পরস্পরকে। এরই মধ্যে আমাদের বিয়ে হলো। আমি বিশাখার প্রেমে নয়নকে ত্যাগ করে চলে গেলাম। আমার আর নয়নের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়নি। কটা মন্ত্রের উচ্চারণ আমার কাছে খেলনা মনে হলো। ওটাকে বিয়ে না মেনে ফিরে গিয়ে আবার বিয়ে করলাম বিশাখাকে। ছয়মাস কেটে গেল স্বপ্নের মতো। ফ্ল্যাট কিনবো ঠিক করলাম। ও বললো আমি তোমাকে সেখানে যেন নিয়ে না যাই। আমি অবাক হলাম কিন্তু তবু কিছু বলিনি। কিন্তু দিনের পর দিন বুঝলাম ও আমাকে ঠিক মেনে নিতে পারছেনা। ওর বন্ধুবান্ধব, শপিং যখন তখন যা খুশি করা কষ্ট হলেও মেনে নিয়ে ছিলাম। রাতের রান্না আমিই করতাম। একদিন বুঝলাম ও অন্য একজনের সাথে কথা বলে, তার সাথে ইচ্ছামত সময় কাটায়। আমি বারন করায় ও বলল- ওই বাড়িটা ওর বাবার। আমি যেন বেরিয়ে যাই। আমি চলেও এলাম রাগে। কিন্তু ও ফিরে যেতে বললনা। কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্স নোটিশ এলো। নীরবে সই করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলনা আমার। আরও তিনমাস কেটে গেলো। শুনলাম ওর বিয়ে খুব জাঁকজমক ভাবে। যার সাথে ওর সম্পর্ক ছিল সে ওর বাবারই পছন্দের। ওরা খুব সুখী মা। আমিই এক দুর্ভাগা। যে ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটিকে অপমান করে চলে গেছি। আর সে এই দীর্ঘ তিন বছরে তোমায় নিয়ে আছে। আমি কি করব মা? নিজেও শেষ হলাম আর নয়নের জীবনটা যে আমি শেষ করে দিলাম। মায়ের হাতে মুখ রেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো সাকিব।
-- তুই ফিরে আয় বাবা, নয়নকে কাছে ডাক। ও যে তোর জন্যই আছে। আমি ওর অন্যত্র বিয়েও দিতে চেয়েছি, কিন্তু ও রাজি হয়নি।
--কিন্তু কোন মুখে ফিরবো মা?
-- যে মুখে ত্যাগ করে গিয়েছিলে? সেই মুখেই ফিরে এসো।
চমকে তাকায় মা ছেলে দুজনেই। বলে- তুমি?
সাকিবের সামনে তখন নয়ন এসে বসেছে হাঁটু মুড়ে। হাতে হাত রেখে বলে- আমি জেগেই ছিলাম। সব শুনেছি আড়াল থেকে। ভুলে যাও সব। অনুতাপের আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়েছে তুমি। এই খাঁটি সোনাকে ফিরিয়ে দেবার সাধ্য আমার নেই।
-- সাকিব ওকে তুলে দাঁড় করায় -- ভুলে যায় সামনে মা আছেন। দুকাঁধে হাত রেখে বলে -সত্যি!! সত্যি আমায় গ্রহণ করবে নয়ন? সব ভুলে? আমার সব ভুল, সব অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারবে তুমি?
মাথা নাড়ে নয়ন।
দুহাতের পাতায় নয়নের অবনত মুখটা তুলে ধরে সাকিব। কি সুন্দর দুটো গভীর জলাশয়ের মতো চোখ। সেই চোখে মুক্তোর মতো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ছে। ঠোঁট দিয়ে সেই অমূল্য ধারা শুঁষে নেয় সাকিব। নিঃশব্দে ঘরে ফিরে এসেছেন সাদিয়া। চোখ তার অপার আনন্দ। নয়নকে কোলে নিয়ে ঘরে আসে সাকিব। কি অপূর্ব মায়াময় মেয়েটি। এতদিন এই স্নিগ্ধ রুপ চোখে পড়েনি তার। চাঁদের মৃদু আলো জানলা গলে এসে পড়ছে নয়নের মুখে। বুকে জড়িয়ে ধরে সাকিব বলে- ফিরে এসো আর একটিবার।
ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন দিনটা জ্বলজ্বল করছে-৮ ই ফেব্রুয়ারি, যার এখন আধুনিক নাম- "প্রোপোজ ডে।"
রচনাকাল : ৮/২/২০২১
© কিশলয় এবং মুসকান ডালিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।