গাড়ির জানলা দিয়ে গোলাপের গুচ্ছটা ছুঁড়ে ফেলে দিল শুভ্র। না- আর এই টুকটুকে লাল রঙের গোলাপ আর দেখতেও চায় না সে। বিক্রেতা কিশোরী মেয়েটি কেঁদে উঠল। ছুটে ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বলল- দাদাবাবু চাইলে নাই নিতে পারতেন। কিন্তু এভাবে ছুঁড়ে ফেললেন কেনো? কত গুলো পাপাড়ি ঝরে গেছে। আর কি কেউ দাম দিয়ে কিনবে? আজ কি করে দাদার জন্য ওষুধ কিনব? আজ ভেবেছিলাম কিছু রোজগার হবে। আর এভাবে আপনি? আর বলতে পারলো না কিশোরীটি।
মেয়েটির কান্নায় সম্বিত ফিরল শুভ্রর। গাড়ি থেকেই দেওয়া যেতো টাকাটা। কিন্তু মেয়েটির কান্নায় কেমন যেন কষ্ট হতে লাগলো। নরম সুরে বলল- চল ওদিকটায় দাঁড়া। আমি আসছি। তোর গোলাপের দাম দিয়ে দেব। কান্নাভেজা চোখে মৃদু হাসি ফুটলো মেয়েটির। সরে দাঁড়ালো রাস্তার সাইডে। গাড়ি পার্ক করে সেখানে এলো শুভ্র। এতক্ষণে মেয়েটিকে লক্ষ্য করল সে। কিশোরী মেয়েটির চোখেমুখে মায়াবী ছাপ। ফর্সা রঙটা অভাবের আগুনে জ্বলেপুড়ে কালোই হয়েই গেছে। কিন্তু মুখের মৃদু হাসিটা বড় অমলিন।
কত দাম রে গোলাপের?
-দুশো টাকা।
অবাক হলো শুভ্র। এতগুলো টাটকা রক্তগোলাপ আজ "রোজ ডে"-তে দুইহাজারের কম হবে না। আর মেয়েটি বলে কিনা দুশো!
বলেই ফেললো শুভ্র -এত দাম কম কেন রে? দোকানে তো অনেক বেশি দাম।
দাদাবাবু এ আমার গাছের গোলাপ। আমি দামও জানিনা। শুধুমাত্র দাদার ওষুধ কেনার জন্য আমি দাদাকে লুকিয়ে এগুলো তুলে এনেছি। দাদার খুব প্রিয় এই গোলাপগুলো। জানিনা দাদা এগুলো না দেখে কি বলবে? কিন্তু ওষুধ টাও যে খুব দরকার।
-কি হয়েছে তোর দাদার?
পড়ে গেছে দাদা। রঙের কাজ করে যে। ভারা ভেঙে পড়ে গিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে। ব্যাথার ওষুধটা দরকার ছিল।
--তোদের বাড়ি নিয়ে যাবি আমায়?
-আপনি যাবেন? চলুন না।
গাড়ি সেখানেই রেখে মেয়েটির সাথে গলির ভিতর ঢুকলো শুভ্র। অবাক চোখে দেখছিল সবাই।
সামনেই বাড়ি। ঘরই বলা যায়। সামান্য টালির চালের বাসা। বারান্দার এক পাশে রান্নার ব্যাবস্থা। খুব পরিচ্ছন্ন আর সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ে- সেটা হল গোলাপ গাছ। খুব যত্নেই রাখা হয়েছে গাছটাকে। ফুলে ফুলে ভরে আছে এখনো।
--কে এসেছে রে লালি?
লালি!!
চমকে ওঠে শুভ্র।
লালি ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতরে শুয়ে এক যুবক। সুন্দর কিন্তু মলিন। শুভ্র নমস্কার জানায়।
ছেলেটিও। ওর নাম জানায় শিমুল।
শুভ্র শিমুলের হাতে দুই হাজার টাকা গুঁজে দেয়।
অবাক হয় শিমুল।
কি ব্যাপার আপনি কিসের টাকা দিচ্ছেন? আমি গরীব কিন্তু ভিক্ষা নিই না।
--না ভাই-ভিক্ষা নয়। বোনকে দিলাম। আমাকেও এক ভাই বলে জেনো।
--লালি- চা খাওয়াবি না?
অবাক হয় দুই ভাইবোন। এত বড়লোক এক ছেলে কিনা চা খেতে চাইছেন?
--কিরে দাঁড়িয়ে রইলি যে?
লালি ছুটে গেলো বারান্দায়। এককাপ লাল রঙের চা নিয়ে এলো। সাথে সস্তার কিছু কুচো বিস্কুট।
চায়ে চুমুক দিলো শুভ্র। কি অপূর্ব স্বাদ। যেন তারই লালির হাতে চা। দুচোখ জলে ভরে এলো শুভ্রর।
শিমুল বলল- কাঁদছেন কেন দাদা?
শুভ্র কাছে ডাকলো লালিকে। বললো - "জানিস- লালি আমারও এক বোন ছিল, তারও নাম ছিল লালি। তখন আমরা ছোট ছিলাম। খুব মিল ছিল দুজনের। তখন আমরা "রোজ ডে" বলে কিছু জানতাম না। সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। ব্যালকনির টবে আমরা দুই ভাইবোন গোলাপ গাছ লাগিয়ে ছিলাম। প্রচুর ফুল ফুটেছিল। বোন আমায় উপহার দেবে বলে অনেকগুলো গোলাপ তুলে সাজাচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগেই গাছে জল দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ করেই পা পিছলে ব্যালকনি থেকে পড়ে গেল লালি। আর ওকে ফিরে পেলাম না। হাতে তখনও তার রক্তগোলাপ। ক্ষীন কন্ঠে বলল- দাদা এগুলো তোর। আমি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম গোলাপগুলো। নীথর বোনকে দেখে মা নির্বাক হয়ে গেলেন। বাবা গত হয়েছেন আগেই। মাও এক বছরের মধ্যেই চলে গেলেন। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। মামা নিঃসন্তান ছিলেন। তার কাছে কেটে গেছে এত গুলো বছর। আর কখনও জন্মদিন মানাই নি। গোলাপ দেখলেই আমার বুকের ভিতর যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। তাই লালির গোলাপ গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
শিশুর মতো কাঁদছিল শুভ্র।
লালি এগিয়ে এসে দুচোখ মুছে দিল। বলল -দাদাভাই আজ থেকে আমিই না হয় তোমার হারিয়ে যাওয়া লালি।
লালিকে বুকে জড়িয়ে নিল শুভ্র। অবাক হয়ে শিমুল দেখলো শুভ্র আর লালি যেন সত্যিই দুই ভাইবোন।
লালিকে ক্লাস এইটে ভর্তি করেছে শুভ্র। দাদার অসুস্থতায় পড়া বন্ধ করতে হয়েছিল। শিমুল সুস্থ হয়েছে। নতুন করে কাজ করছে। কেটে গেছে আরো এক বছর। আজও রোজ ডে। লালি আর শিমুল এসেছে পায়েস নিয়ে।
জলভরা দুচোখে আজ খুশির ঝিলিক। লালি তার জামার আড়াল থেকে টুকটুকে লাল গোলাপ দেয় শুভ্র দাদার হাতে। শুভ্রর মনে হয় আজ সত্যিই "হ্যাপি রোজ ডে"।
রচনাকাল : ৭/২/২০২১
© কিশলয় এবং মুসকান ডালিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।