উর্বশী ইন্দ্রের সঙ্গে স্বর্গে চলে গিয়েচিলেন। তিনি অপ্সরা শ্রেষ্ঠা। স্বর্গবেশ্যাদের মধ্যে তিনি প্রধান। উর্বশীর আরো একটা পরিচয় জানিয়ে দিয়ে যাই , তিনি বশিষ্ঠর জন্মের হেতু। কোনো এক যজ্ঞকালে, অপ্সরী উর্বশী’কে দেখে যজ্ঞকুম্ভে আদিত্য ও বরুণের বীর্যপাত হয়। ফলে, যজ্ঞকুম্ভ থেকে বশিষ্ট ও অগস্ত্য –এর জন্ম হয়। সে হিসাবে উভয়কেই মিত্র (তেজময় সূর্য) ও বরুণের পুত্র বলা হয়। এর অন্যান্য নাম– অরুন্ধতীজানি, অরুন্ধতীনাথ, অরুন্ধতীসহচর, আপব, উর্বশীয়, কলসী, কলসীসূত, কুম্ভজ, কুম্ভযোনি, কুম্ভসম্ভব, ঘটজ, ঘটযোনি, ঘটোৎভব, মৈত্রাবরুণ, মৈত্রাবরুণি।
♦উর্বশী কে অর্জুন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ,এবং একথা সত্য উর্বশী পুরুবংশের সর্বজনবিদিত জননী। তিনি উর্বশীকে মাতা বলে সংবধন করেন। উর্বশী কিভাবে এই বংশের জননী হলেন তা বলতে হলে আমাকে বলতে হবে চন্দ্র , তারা এবং ইলের কথা। এগুলি আমি এড়াতে পারবোনা।
প্রথমেই তাই বলি চন্দ্রের কথা
♦চন্দ্র পৌরাণিক দেবতা। ইনি চাঁদের অধিপতি। এই দেবতার অপরাপর নাম: অত্রিজ, অত্রিজাত, অত্রিনেত্রজে, অত্রিনেত্রপ্রসূত, অত্রিনেত্রপ্রভব, অত্রিনেত্রভব, অত্রিনেত্রভূ, অব্জ, অব্জদেব, অব্দিজ, অভিরূপ, অম্ভোজ, অর্ণবোদ্ভব, চন্দ্র, চন্দ্রদেব, চন্দ্রদেবতা।
♦মহাভারতের মতে- সমুদ্রমন্থনের সময় প্রথম চন্দ্রের উৎপত্তি হয়। এই কারণে একে বলা হয় অর্ণবোদ্ভব। সাগর থেকে উত্থিত হওয়ার পরে, চন্দ্র আকাশমার্গে গমন করেন এবং সেখান থেকে দেবতাদের পক্ষালম্বন করেন। দেবতাদের লুকানো অমৃত রাহুনামক এক দানব গোপনে পান করার সময় সূর্য ও চন্দ্র বিষ্ণুকে জানিয়ে দেন। বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্র দ্বারা রাহুর শরীর দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলেন। এই কারণে রাহু চন্দ্রের শত্রুতে পরিণত হন। সুযোগ পেলেই রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করেন। কিন্তু, শরীরের নিম্নাংশ কাটা বলে- ওই পথে চন্দ্র পুনারায় বের হয়ে আসেন। হিন্দু মতে- এইভাবে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।
[সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ অধ্যায়]
♦অন্যমতে, ব্রহ্মার মানসপুত্র অদ্রি’র পুত্র। জন্মের পর থেকেই ইনি ত্রিচক্র রথে পৃথিবীকে পরিক্রম করা শুরু করেন এবং আলো দান করতে থাকেন। দক্ষের ২৭টি কন্যাকে ইনি বিবাহ করেন। এর মধ্যে রোহিণী ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী। এই কারণে দক্ষের অন্যান্য কন্যারা দক্ষের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। দক্ষ প্রথমে চন্দ্রকে এরূপ পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরে ব্যর্থ হয়ে- চন্দ্রকে পুত্রকন্যাহীন ও যক্ষ্মারোগাগ্রস্ত হওয়ার অভিশাপ দেন। এই অভিশাপে ভীত হয়ে কন্যারা পিতাকে অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করলে- দক্ষ বলেন যে,- চন্দ্র একপক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত হবেন এবং অন্য পক্ষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে আগের রূপ পাবেন। চাঁদের এই দুই পক্ষ কৃষ্ণ ও শুক্ল নামে পরিচিত।
অর্জুন আর উর্বশীর যোগসূত্র আর উর্বশীর নামটা সঙ্গে কেন জড়ালো , তা আমার বলা হয়ে ওঠেনি। আসলে উর্বশী অর্জুনকে একটি অভিশাপ দিয়েছিলেন ,যে অভিশাপ তার বনবাসের ত্রয়োদশবর্ষের অজ্ঞাতবাসে ভীষণ ভাবে কাজে লেগেছিলো।উর্বশী কে অর্জুন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ,এবং একথা সত্য উর্বশী পুরুবংশের সর্বজনবিদিত জননী। তিনি উর্বশীকে মাতা বলে সংবধন করেন। উর্বশী কিভাবে এই বংশের জননী হলেন তা বলতে হলে আমাকে বলতে হবে চন্দ্র , তারা এবং ইলের কথা। এগুলি আমি এড়াতে পারবোনা।
চাঁদের ও কলঙ্ক থাকে , অবশ্যই থাকে। চাঁদের ইতিহাস ও যথেষ্ট কলঙ্কময়। দেবগুরু বৃহস্পতির আশ্রমে শিষ্যত্বে থাকা কালীন গুরুপত্নী তারার অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন চন্দ্র। চন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী তারাকে বিবাহপ্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি গুরুপত্নী তাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এতে রুষ্ট হয়ে চন্দ্র বলপূর্বক তাকে ধর্ষণ করেন। এই ধর্ষণের ফলে চন্দ্রের ঔরসে তারা অন্তঃসত্ত্বা হন ও এক পুত্রলাভ করেন।
♦বাই দা ওয়ে এবারে বৃহস্পতির স্ট্যান্ড কি ছিল , সেটা জানতে হলে বৃহস্পতির সম্পর্কে ও বলতে হয়। বৃহস্পতি ও একসময় নিজের দাদার উতথ্যের স্ত্রীর অর্থাৎ বৌদির প্রতি দুর্বল ছিলেন , এবং তার সঙ্গে সম্ভোগের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার বৌদি মমতা তাতে বাধা দেন , সেই সময় তিনি অন্তঃসত্বা ও ছিলেন বটে। বৃহস্পতি ও সেই এক ই কাজ করেছিলেন যা চন্দ্র করেছিলেন। মমতার গর্ভে যে ভ্রূণ টি ছিল সে বাধা দিয়েছিলো।
♦“ক্ষান্ত হোন। নিবৃত্ত হো্ন এই ভয়ঙ্কর কার্য থেকে। মনে রাখুন আপনি দেবগুরু বৃহস্পতি। আপনি অমোঘরেতা। আপনার নিক্ষিপ্ত বীর্য নিষ্ফল হওয়ার নয়। কিন্তু আমি এই ঘটনার বহুপূর্ব থেকেই এই মাতৃজঠরে আশ্রিত রয়েছি। তাই এখানে দ্বিতীয় কারো স্থান হতে পারে না। আমি থাকাতে আপনার ঔরস ধারণের কোনো স্থান নেই এখানে। তাই এখনি নিবৃত্ত হোন এই দুষ্কর্ম থেকে”’ — কথাগুলি অতি আশ্চর্যভাবে উচ্চারিত হোলো মমতার গর্ভস্থ সন্তানের মুখ থেকে। “’জন্মান্ধ হবি। জন্মান্ধ হবি। মহাপাতক কোথাকার।’—এর পরেই এলো সেই ঘোরমুহূর্ত। যার ফলে গভীর অন্ধকারে চলে গেলো একজনের জীবন। চিরকালের মতো। অবশ্য শতসহস্র বর্ণাঢ্য মানুষের বিপুল ইতিহাসে তাঁর স্থান বিন্দুমাত্র।
♦সেই ব্যাপারটাও বুঝতে হবে , এ যে সে ভ্রূণ নয়। যাই হোক বৃহস্পতি সেই ভ্রূণকে অন্ধত্বের অভিশাপ দিয়েছিলেন। যে গল্পটি বলছি তার সম্পর্কে জানতে হলে মহাভারতের আদি পর্ব দেখতে পারেন , মহাভারতে এরকম অজস্র ছোট গল্প রয়েছে। তার নাম হয় দীর্ঘতামস- তমসা মানে অন্ধকার , আর দীর্ঘ মানে তো জানেন ই।<চতুরধিকশততম অধ্যায়। ক্ষেৎত্রজ পুৎত্রোৎপাদনের বিবিধ দৃষ্টান্ত। দীর্ঘতমা ঋষির জন্মবৃত্তান্ত। স্ত্রীজাতির প্রতি দীর্ঘতমার শাপ। অঙ্গরাজাদির জন্ম-বর্ণন>
♦কিন্তু বৃহস্পতি সেই কথায় কর্ণপাত করলেন না। অসহায় মমতা শেষ বারের মতো কাতর নিবেদনে বললেন—‘হে প্রভু। আমার গর্ভস্থ পুত্র সর্ববেদজ্ঞ মহাজ্ঞানী ও অলৌকিক ক্ষমতাধারী। আপনি দয়া করে তার কথার মর্যাদা দিন।’ সঙ্গমের তুঙ্গ মুহূর্তে মমতার এইসব কথা বৃহস্পতির কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হোলো। তিনি তাঁর সমস্ত কামনাকে একাগ্র করে মমতাকে তীব্রতম উল্লাসে বিদ্ধ করতে উদ্যত হলেন। আর তখনই সেই গর্ভস্থপুত্রের এক প্রবল পদাঘাত এসে পড়লো বৃহস্পতির লিঙ্গমুখে। এই অতর্কিত আঘাতে মমতার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় ভূপতিত হলেন তিনি।
♦ তবে সেই অন্ধ ভ্রূণ পরবর্তী কালে মহাঋষি দীর্ঘতামস যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বৃহস্পতির ঔরসে যে পুত্রটি হয় , তিনি আমাদের অর্জুনের গুরুর পিতা , অর্থাৎ দ্রোণাচার্যের পিতা , তার নাম ঋষি ভরদ্বাজ।বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পতিত হয় এবং সেখান থেকে ভরদ্বাজের জন্ম হয়।
♦ ভরদ্বাজের জন্মের পর, স্বামীর পুত্র নয় বলে মমতা তাঁকে ত্যাগ করেন। কিন্তু বৃহস্পতি তাঁকে উতথ্যের ক্ষেত্রজ পুত্র হিসাবে প্রতিপালনের পরামর্শ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতি ও মমতা উভয়ই এই পুত্রকে পরিত্যাগ করেন। পরে মরুদ্গণ এই পুত্রকে পালন করেন। ইনি মরুদ্গণের ভুত বা ভর হয়েছিলেন এবং দ্বাজ (সঙ্কর) পুত্র বলে এর নাম হয় ভরদ্বাজ।
♦ ইনি স্নানকালে ঘৃতাচী অপ্সরাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে অত্যন্ত মোহিত হয়ে পড়েন। এর ফলে তাঁর বীর্যপাত হলে, ইনি এই বীর্যকে একটি দ্রোণের (পাত্র বিশেষ) ভিতর রাখেন। এখান থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন- পাণ্ডব-কৌরব অস্ত্রগুরু দ্রোণ।
♦ এবার ফিরে আসি তারা চন্দ্র এবং বৃহস্পতির গল্পে
রাজসূয় যজ্ঞ করে চন্দ্র অত্যন্ত অহংকারী ও কামাসক্ত হয়ে পড়েন। ইনি দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করেন। এই কারণে এক যুদ্ধের সূচনা হয়। চন্দ্রে পক্ষে ছিলেন- দৈত্য, দানব ও দেব শত্রুরা। অন্যদিকে বৃহস্পতির পক্ষ নেন ইন্দ্রসহ অন্যান্য দেবতা। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা এই যুদ্ধ নিবৃত্ত করেন। পরে তারাকে তাঁর স্বামী বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই সময় তারা অন্তঃসত্বা ছিলেন। বৃহস্পতির আদেশে তারা গর্ভত্যাগ করেন।ফলে যে পুত্র জন্মে- তার নাম রাখা হয় বুধ। ব্রহ্মা এই পুত্রের পিতা কে জিজ্ঞাসা করলে- তারা পুত্রের জনক হিসাবে চন্দ্রের নাম উল্লেখ করেন। পরে চন্দ্র পুত্রকে গ্রহণ করে তাঁকে আকাশে স্থাপন করেন। এই পুত্রই হলো বুধ গ্রহ।
♦বুধের গল্পে কাল না হয় আসা যাবে। তার আগে বৃহস্পতির স্ত্রী তারার কথা বলে আজকের পর্ব শেষ করি
.তারার সাহস কে কুর্নিশ , সেই সময় কোনো DNA টেস্ট ছিলোনা ,কিন্তু তারা তার সন্তান ধর্ষণের ফলশ্রুতি বা আমাদের ভাষায় জারজ হলেও সেই সন্তানের প্রকৃত পিতার নামটা বলতে কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করেন নি
রচনাকাল : ৩১/১/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।