পুরাণের কথা ও কাহিনী (প্রথম পরিচ্ছেদ)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
বেদজ্ঞ মহামুনি উতথ্যের (মতান্তরে উশিজ) স্ত্রী অপরূপ সুন্দরী মমতা আর ছোটভাই দেব-পুরোহিত বৃহস্পতি। একদিন বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে বৃহস্পতি কামাতুর হয়ে গর্ভবতী বৌদির সঙ্গ কামনা করে বসলেন। মমতা তাঁর দেবরকে সাধ্যমত বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বৃহস্পতির কামচেতনা তখন তুঙ্গে। মমতা যখন পরাজিত এবং বৃহস্পতির চরম মূহুর্ত সমাগত, তখন বাধা দিল গর্ভস্থ সন্তান। বলে উঠল, ”হে পিতৃব্য, আপনি পৃথিবীতে ক্ষমতাবান হতে পারেন, কিন্তু এই জঠরে আমি পূর্ব হতেই উপস্থিত। এখানে আপনার বীর্য ধারণের স্থান নেই। অতএব, আপনার বীর্য সংবরণ করুন।“ এই বলে সে নিজের পা দ্বারা ভেতর থেকে বীর্য প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়। ছোট মুখে বড় কথা এমনিতেই সহ্য হয় না, আর এতো না-হওয়া মুখ। তার উপর বৃহস্পতির তখন চরম অবস্থা! এ অবস্থায় সংযম পালন? ক্ষেপে গিয়ে বৃহস্পতি শাপ দিলেন অনাগত সন্তানকে, ” আমাকে তুই বাধা দিলি? যা তুই দীর্ঘ তমোরাশির মধ্যে প্রবেশ করবি।“
যথাসময়ে সে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় এবং ‘দীর্ঘ তমোরাশি’ অর্থাৎ চির অন্ধকারের অভিশাপের কারণে সে সন্তান হয় জন্মান্ধ। তার নাম দীর্ঘতমা। কালক্রমে দীর্ঘতমাও বেদজ্ঞ ঋষি হয়ে ওঠেন।
এই দীর্ঘতমার জ্ঞানের পরিধি যেমন বড়, অভিজ্ঞতার বিচিত্রিতাও তেমনি। একেতো মায়ের পেট থেকেই চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হয়েছে কামুকতার, পরবর্তীতে বেদশাস্ত্র অধ্যয়ন করে বেদজ্ঞ হন, তার উপর তিনি আবার ষাঁড়ের কাছ থেকে ‘গো-ধর্ম’ও শিক্ষা নেন (ষাঁড়ের কাছে গো-ধর্ম মানেই সব গাভিতেই ইচ্ছেমত উপগত হবার শিক্ষা)। গোধর্ম আর কাম-শিক্ষা সময়ে সময়ে তাঁর বেদের শিক্ষাকেও ছাপিয়ে যেত। আর তারই প্রমাণ তিনি দেন তাঁর আপন ছোট ভাই মহর্ষি গৌতমের স্ত্রীর বেলায়। ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তিনি জোরপূর্বক গৌতমের স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ যাকে বলে মায়ের পেট থেকে শিখে আসা লাম্পট্যবিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগ। অনেক কষ্টে ভাসুরের কাছ থেকে সেবার রেহাই পেয়েছিলেন মহিলা।
এই দীর্ঘতমারই আরেক কীর্তি খুব বিখ্যাত। দৈত্যরাজ বলির সন্তান হয় না। তাই প্রচলিত নিয়মানুসারে সন্তান উৎপাদনের জন্য দৈত্যরাজ তাঁর স্ত্রী সুদেষ্ণাকে পাঠালেন দীর্ঘতমার কাছে। এ প্রথাকে বলা হত ‘নিয়োগ প্রথা’। এ প্রথার রীতি অনুসারে কর্মকান্ড হতে হবে রাতে এবং ‘নিযুক্ত’ পুরুষটি হবে ‘মৌনী’ ও ‘ঘৃতচর্চিতদেহী’ (দেহে ঘি মাখা)। এর ব্যাখ্যা হল এরকম – যৌনক্রিয়াটি রাতে হবে, কারণ এটি একটি আবশ্যিক কিন্তু লজ্জাজনক ব্যবস্থা, তাই আঁধারে করতে হবে ; পুরুষটি মৌনী হবে কারণ এতে সে মধুর বাক্যব্যয়ে নারীর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাতে পারবে না ; আর দেহে ঘি মাখা থাকবে, কারণ এতে ঘিয়ে জবজব শরীরের সাথে সঙ্গমে নারী সন্তান লাভ করবে ঠিকই, কিন্তু সে দেহের প্রতি কোন পুলক বা আকর্ষণ জন্মাবে না। মোদ্দা কথায় পুরো ব্যাপারটিকে সাময়িক ও এককালীন করার দারুণ ব্যবস্থা !
যাহোক, সুদেষ্ণার বেলায় একটু ব্যতিক্রম ঘটল। ঘিয়ের বদলে দীর্ঘতমার দেহে মাখানো হল দই, একটু লবণ আর মধু দিয়ে। সঙ্গমের সময় অন্ধ মুনি মায়ের পেট থেকে পিতৃব্যের কাছ থেকে শিখে আসা বিকৃতির পরিচয় দিলেন। সুদেষ্ণাকে বললেন, ” তোমার সঙ্গমের প্রয়োজন নেই। তুমি যদি আমার সারা দেহ লেহন করে দিতে পার, তবেই তোমার পুত্র মিলবে।“ সুদেষ্ণা স্বামীর বংশরক্ষার্থে সারা দেহ চাটলেও মুনির লজ্জাস্থান এড়িয়ে যান। তখন মুনি শাপ দিলেন, ”তুমি আমার লিঙ্গকে ঘৃণা করেছ। আমার শাপে তোমার পুত্র হবে গুহ্যবিহীন।“
সুদেষ্ণা তখন ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করে মুনির পায়ে পড়লে মুনি বলেন, ”ঠিক আছে, তোমার পুত্র নয়, তোমার নাতি হবে গুহ্যদ্বারবিহীন। তবে তোমার লেহনে আমি দারুণ পুলক অনুভব করেছি, তাই আমার বরে তোমার পাঁচ পুত্র সন্তান হবে। যাদের প্রত্যেকের নামে একটি করে দেশ হবে। এভাবেই তারা হবে চিরস্মরণীয়।“
বিকৃতরুচির এ মুনির বরে সুদেষ্ণার পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্মায় – যাদের নামে একেকটি ভূখণ্ড হয়। এরা হল- পুন্ড্র, কলিঙ্গ, সুহ্ম, অঙ্গ এবং বঙ্গ। এদের প্রত্যেকের নামে একটা করে দেশ হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বঙ্গের থেকেই আসে আমাদের বঙ্গদেশ। ( এ দেশে ধর্মের নামে, বিশ্বাসের নামে তথ্যের এত ভেদ-বিকৃতির মূলে এটাই কিনা কে জানে ! )
পুরাণের বর্ণনামতে হিন্দুধর্মের ধনদায়িনী দেবী লক্ষ্মীর অবস্থাও একটু সঙ্গিন । সমুদ্রমন্থনের সময় ক্ষীরোদসাগর থেকে অমৃত-গরল-ধনরত্ন যাই উঠে আসছিল, তার প্রতি দেবতা আর অসুরদের প্রখর দৃষ্টি ছিল। এরই মধ্যে উঠে এলেন দেবী লক্ষ্মী। এতকিছু থাকতে ভগবান শ্রীহরির দৃষ্টি পড়ল দেবীর স্বর্ণাভ নিটোল স্তনাগ্রের প্রতি ! ধীরে ধীরে সকল দেবতা-অসুরের দৃষ্টিও পড়ল তাঁর নিখুঁত কামোদ্রক দেহবল্লরীর প্রতি। তবে শ্রীহরির চোখই প্রথম সে রূপসুধার প্রশংসাকারী বিধায় লক্ষ্মীর বরমাল্য তাঁর গলায় যায়।
লক্ষ্মীর দেবীর কাছে তাঁর বোন সরস্বতী হার মানবেন সে কি হয় ! বিদ্যার দেবীর আবাহন শ্লোকেও আছে বিবরণ – “কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে”। মুক্তার হারখানা কিসের শোভা বর্ধন করছে তা দেখিয়ে না দিলে যেন চলছিল না! তবে এই শ্বেতশুভ্রতার প্রতীক সরস্বতীকে নিয়ে টানাহেঁচড়া কম নেই। আদি পুরাণ মতে সরস্বতী ব্রহ্মার মুখজাত । মুখজাত অর্থ জ্ঞান। ব্রহ্মার মুখজাত জ্ঞান মানেই বেদ। তাই সরস্বতী প্রাচীন বৈদিক দেবী, জ্ঞানের দেবী। তাঁর আরেক নাম ভারতী।
আবার শিবপুরাণ বলছে, সরস্বতীর রূপে কামমোহিত হয়ে ব্রহ্মা তাঁর সঙ্গ প্রার্থনা করেছিলেন। তখন সরস্বতী তাঁকে শাপ দেন। অন্যদিকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে সরস্বতী বিষ্ণুর মুখজাত, ব্রহ্মার স্ত্রী। সেখানে বিষ্ণু ব্রহ্মাকে গোলকে পাঠাচ্ছেন প্রকৃতির অংশরূপী ভারতীর সাথে যৌনমিলনের জন্য।
এদিকে ঋগ্বেদে ইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুৎ ও অশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনোবা ইন্দ্রের চিকিৎসক। ঋগ্বেদেই আবার যে বাক-দেবীর সাথে ব্রহ্মার যৌনসংসর্গ দেখানো হয়েছে, সে বাক-দেবী সরস্বতী ভিন্ন আর কেউ নন।
পক্ষান্তরে, কোন কোন পুরাণকারের মতে ব্রহ্মা স্বীয় কন্যা সরস্বতীর সাথে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হন। কলকাতার জাদুঘরে রক্ষিত এক সুপ্রাচীন মূর্তিতে এর পক্ষে প্রমাণ মিলে, যেখানে দেখা যায় ব্রহ্মার বামজানুর উপর সরস্বতী বসে আছেন এবং তাঁর এক হাত ব্রহ্মার কাঁধে জড়িয়ে বেশ ঘনিষ্ঠ।
নেপালে চতুর্দশ শতকের পাওয়া এক শিলালিপিতে আছে দেবী বন্দনা – “সারদা তুমি মাতৃরূপী, তুমি কামমূর্তি”! সারদা সরস্বতীরই নাম। এতো দেবতার সান্নিধ্য পেয়েছেন বলেই হয়তো মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা সরস্বতীর গায়ে কোন আব্রু নেই।
মকবুল ফিদা তো একেবারে কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলা যুগের ; এরকম অজস্র যৌনতা বা কামজ কাহিনি ছড়িয়ে আছে ভারতীয় পুরাণের পরতে পরতে। যার কারণে মেঘদূত, গীতগোবিন্দ সহ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কাব্যেও দেহজ রূপ বর্ণনার ছড়াছড়ি। চোখ-নাক-ঠোঁট-মুখ ইত্যাদি কম ধর্তব্য ছিল বিধায় পটল-বাঁশি-কমলার কোয়া-পানপাতা ইত্যাদি রূপকের তেমন পাত্তা দেখা যায় না। বরং পীনোন্নতবক্ষ-স্বর্ণাভ স্তনাগ্র-কদলীসদৃশউরু-বর্তুলাকার নিতম্ব ইত্যাদি রূপকের সেখানে জয়জয়কার। আর তাতেই যেন রূপের প্রকাশ আরো খোলতাই হয়েছে। আবার একইসাথে কুচ-জঘন-উরু এসব রীতিমত ভক্তিস্নাত হয়ে গেছে।
তবে একথাও সত্য যে, প্রাচীন অনেক শব্দের ব্যবহার আজকাল সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ হয় বিধায় প্রাচীন শাস্ত্রপাঠে কোন কোন শব্দ পাঠকের মনে দ্বিধার জন্ম দিতে পারে। যেমনঃ প্রাচীন তন্ত্রমতে শিব দুর্গাকে বলছেন, “কুলবেশ্যা, মহাবেশ্যা, ব্রহ্মবেশ্যা প্রভৃতির মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ বেশ্যা। যোনিপীঠ সাধনায় তুমি প্রসন্না ও তুষ্টা হয়ে সাধকের সকল কামনা, বাসনা, অভীষ্ট সিদ্ধ করে থাকো।“ (“ত্বং হি প্রধানা বেশ্যা,/কুলবেশ্যা ব্রহ্মাদি বেশ্যামধ্যে,/ বেশ্যা যোনিপীঠ সাধনে প্রসন্না, তুষ্ঠাতু কামান সকলানাভিষ্টাম“)।
এখানে বেশ্যা বলতে বারভোগ্যা নয়, বরং যে নারীকে পেতে হলে নিজেকে বিসর্জন দিতে হয় তাকে বুঝান হচ্ছে।
এখানে বেশ্যা বলতে বারভোগ্যা নয়, বরং যে নারীকে পেতে হলে নিজেকে বিসর্জন দিতে হয় তাকে বুঝান হচ্ছে। তন্ত্রমতে যে বীরভাবা সাধিকা পুরুষকে ‘লিঙ্গ’রুপে কল্পনা করে সে লিঙ্গকে নিজ যোনিতে স্থাপন করে সাধনা করে, সে সাধিকা মহামায়া দুর্গাস্বরূপিনী বেশ্যারূপে গণ্য হন। সাধিকা বেশ্যারা দিনে তিনবার ভৈরব বা পুরুষের সাথে রমণ দ্বারা গুপ্তসাধনা সম্পন্ন করে। এসব গুপ্তশাস্ত্রে বেশ্যা-লিঙ্গ-যোনির অহরহ যাতায়াত।
তন্ত্র নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনায় এগুলো আসবে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ভারতীয় পুরাণে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হল লিঙ্গপূজা। মজার ব্যাপার হল ‘লিঙ্গ’ শব্দটি অস্ট্রিক বা কোল ভাষার এবং বেদে এর কোন স্থান নেই। বেদে লিঙ্গের প্রতিশব্দ হল শিশ্ন। সেখানে বলা আছে কিছু রাক্ষস শ্রেণিভুক্ত অনার্য (অর্থাৎ, নিম্নবর্ণের অচ্ছ্যুত মানুষ) শিশ্নপূজার মত ঘৃণিত বস্তুর পূজা করে। বেদের সপ্তম মন্ডলের একুশ সুক্ত থেকে জানা যায় যে এই শিশ্নপূজকরা বেদবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিল। এদের বলা হোত –শিশ্নদেবাঃ।
অনেক গবেষকদের মতে প্রাচীন হরপ্পা এবং মহেঞ্জদারোতে শুরু হয় এ লিঙ্গপূজা। বেদ এবং বেদজ্ঞ মুনিঋষিরা এ পূজা এবং শিবকে কখনোই মেনে নেননি। কিন্তু পরে তাঁদের বংশধরেরা এ দেবতা আর পুজাকে মেনে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন আখ্যান রচনা করে শিবকে প্রধান তিন দেবতার একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও করে দেন।
কালিকা ও লিঙ্গপুরাণ বলছে যে, বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলে শোকার্ত, ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত শিব প্রস্তরময় লিঙ্গরূপ ধারণ করেন। তবে তা শুধুই প্রতীক মাত্র, পুরুষ চিহ্ন নয়। আবার বামন পুরাণে আছে সতীর দেহত্যাগের পর শিব কামদেবের বানে কামজর্জর হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় দারুবনে প্রবেশ করেন। তিনি ঋষিপত্নিদের সঙ্গ কামনা করেন। অরুন্ধতি আর অনসূয়া ছাড়া বাকি সব ঋষিপত্নিরাও শিবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লে ক্রুদ্ধ ঋষিদের শাপে শিবের লিঙ্গ খসে পড়ে এবং তা শুধু বড় হতেই থাকে। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু সহ সব দেবতারা এসে শিবকে লিঙ্গ ধারণের অনুরোধ করেন। তাঁর লিঙ্গের পূজা করতে হবে – এই শর্তে শিব আবার লিঙ্গ ধারণ করেন। অবশ্য এসব নিয়ে আমরা মূল পুরাণগুলোর আলোচনার সময় আরো বিশদভাবে পাব।
রচনাকাল : ২১/১/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।