অভিশপ্ত বছর ২০২০... হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (দ্বিতীয় পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
চেনাজানার বৃত্তে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে অতিমারি। যে পরিবর্তন দেখিয়েছে, পুলিশ অপারগের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে পারে। গান গেয়ে করোনা সচেতনতা বাড়াতে পারে। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দোকান থেকে কিনে বাড়িতে দিয়ে আসতে পারে। খারাপ সময় চিনিয়ে দিয়েছে মানবিক পুলিশকে। নতুন বছরেও নিশ্চয়ই আইনরক্ষার পাশাপাশি পুলিশ নাগরিকের পাশে দাঁড়াবে সঙ্কটের সময়।
করোনা-সময়ে অদ্ভুত শারদীয়া কাটিয়েছে বাঙালি। মণ্ডপে ভিড় নেই। শুধু প্রতিমা। রাস্তায় দর্শনার্থী নেই। শুধু পুলিশ। করোনার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বলে দিওয়ালিতে আতশবাজিও তেমন ভাবে পোড়ানো হয়নি। নিন্দুকেরা বলবে আদালতের নির্দেশ ছিল। কিন্তু বাঙালির সদিচ্ছা ছিল না, বলা যাবে না। বাঙালির ইদও ম্যাড়মেড়ে করে দিয়েছে অতিমারি। বাঙালি রমজানের মাসে সন্ধেবেলা তারাবির নমাজ মসজিদে গিয়ে না পড়ে বাড়িতে বসে পড়েছে! জুম্মাবারেও বন্ধ থেকেছে মসজিদ! নতুন বছরে এমন আশ্চর্য উৎসব-কাল কাটাতে চাইবে না বাঙালি। ভুলে যেতে চাইবে উদ্যাপনের একাকিত্ব।
খেলার মাঠে পৃথিবী জুড়ে একের পর এক টুর্নামেন্ট, লিগ বন্ধ হয়েছে। পিছিয়ে গিয়েছে অলিম্পিক। বছরের শেষদিকে যখন চালু হল খেলাধুলো, তখন মাঠ দর্শকহীন। টিভিতে কৃত্রিম চিৎকার। কিন্তু ঘোলে আর কতটা দুধের স্বাদ পাওয়া যায়! শুরুর একটা শুরু হয়েছে বটে। কিন্তু নতুন বছরে খেলার আসর পুরোদমে বসবে তো? গ্যালারি ভর্তি দর্শক থাকবে তো?
দর্শক নেই বলে অনেকগুলো সিঙ্গল স্ক্রিন আনলক পর্বেও বন্ধ করে দিতে হল। ‘জনতা কার্ফু’র পর পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্স, থিয়েটার, অডিটোরিয়াম, রেস্তরাঁ, পার্ক— বিনোদনের সব দরজা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রমরমা বেড়েছে লকডাউন পর্বে। একের পর এক সিনেমা রিলিজ করেছে সেখানেই। গৃহবন্দি দর্শকদের কাছে খুলে গিয়েছে নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজনের ব্যক্তিগত পরিসর।
কাজের পরিসরেও বড়সড় বদল এনে দিয়েছে কোভিড-১৯। এক দল লোকের কাজ একেবারে চলে গিয়েছে। এক দলের কাজকর্মের গোটাটাই চলছে বাড়ি থেকে। তৃতীয় একটা দল মধ্যপন্থায়। অফিস দরকার মনে করে ডেকে পাঠায়। আর এক দলের কাজের ধরনটাই পাল্টে গিয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের এক বইবিক্রেতা এখন প্লাস্টিক কারখানায় রাত জেগে খেলনা বানান। দিনের বেলা সেই তিনিই দোকানে দোকানে পাঁউরুটি-লাড্ডু-বিস্কুট ফেরি করেন। রোজগার হয়েছে ৩ ভাগের এক ভাগ। বেসরকারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। ভিন্রাজ্যে কাজে যাওয়া ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের কাজ হারিয়ে বেঁচে থাকা আর ঘরে ফেরার গল্প আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে।
একটা দীর্ঘ সময় মানুষ বাড়িতে বন্দি ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তার বাইরে বেরনো বারণ। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তো একেবারেই না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন সেটুকুই কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে আসা। সেই কেনাকাটার ফাঁকেই বাঙালি বেদম ভিড় বাড়িয়েছে বাজারে। সামাজিক দূরত্বের দফারফা করে ছেড়েছে। কিন্তু বাকি সবই ঘরে বসে। নির্ধারিত সময়ের বাইরে বেরোলেই পুলিশের ধমক, মার, অন্যের ভ্রূকুটি। তাতেই বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে। গোটা দুনিয়ায় চলতে থাকা নিয়ম-কানুনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে। বিষময় একটা বছর শুধু অদ্ভুত এক আঁধার পথে হাঁটিয়েছে, তা নয়। আলোকবর্তিকাও দেখিয়েছে। গোটা বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা সেখানেই। পরিবারকে সময় দেওয়া। অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পুরনোকে ভুলে সেই বাড়ানো হাত ধরেই যাওয়া যাক নূতন বছরে।
রচনাকাল : ৩১/১২/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।