~ অপূর্ণ ~
রূপক ঘোষ
মল্লিক বাজারের কাছে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর পাশ থেকে একটা চওড়া রাস্তা সোজা চলে গেছে বেনিয়াপুকুর। এই রাস্তাতে সবসময় জ্যাম-জট লেগেই থাকে। হাতে টানা রিকসা আর রাস্তার দুধারে সারি-সারি দোকান রাস্তাটাকে অপরিসর করে তুলেছে। ওখানকার মানুষজন চলতি কথায় বলে বেনেপুকুর। এই বেনেপুকুর থানার ঠিক কাছেই আছে একটা বড় শিব মন্দির আর একটা বড় বস্তি। বস্তির ঠিক সামনেই একটা বড় মাঠ। এই মাঠেতেই বস্তির মেয়েরা হাতে তৈরী গুল দিয়ে সামান্য রোজগার করে নিজেদের সংসার চালিয়ে নেয়। বস্তির পাশেই ইদানিং গড়ে উঠেছে নতুন নতুন আবাসন। আবাসনের বাবু-বিবিরা কাউকে নিজের ফ্ল্যাটের অবস্থান জানাতে হলে বলে গুল মাঠের পাশেই আমাদের আবাসন।
এই বস্তির ঠিক উল্টোদিকেই আমার মামাদের দোতলা বাড়ি। বাবা মারা যাবার পর ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতেই আমরা বড় হয়েছি। আমরা বলতে আমি, মা আর আমার বোন শম্পা। আমার মা হল ভাই-বোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বাড়িতে আর থাকার মধ্যে আছেন দিদিমা, তিন মামা, তিন মামী আর তাদের ছেলে-মেয়েরা। মামারাই মিলেমিশে আমাদের সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি নিজে একটা ভ্যাগাবন্ড, কোনরকমে বি.এ. পাস করেছি। সম্প্রতি দু-চারজন ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে নিজের হাতখরচটা চালিয়ে নিচ্ছি আর বসে বসে বাড়ির অন্ন ধ্বংস করছি। আমার বোন শম্পা মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে, পড়ার পাঠ চুকিয়ে দিয়েছে। শম্পা খুব সুন্দরী না হলেও সুশ্রী বলা চলে। গায়ের রঙ পরিষ্কার, মুখে একটা আলগা লাবণ্য আছে।
যাইহোক, মূল ঘটনায় ফিরে আসি। সাইকেল নিয়ে বাজারে যাচ্ছি হঠাত্ দেখি রাস্তার উল্টোদিকে একটা পান-সিগারেটের দোকান থেকে জগাদা আমায় ডাকছে।
“ এই মলয় কোথায় চললি? দাঁড়া তোর সাথে আমার কথা আছে।”
জগাদার ভাল নাম জগন মল্লিক। ব্রাহ্মণের সন্তান, থাকে এই বস্তিতেই। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
“বলো কি বলবে?”
“ তোকে চন্দ্রাকে সময় করে একটু পড়াতে হবে। ও এখন ক্লাস নাইনে পড়ে।”
চন্দ্রা হল জগাদার একমাত্র ছোট বোন।
আমি বললাম-“ সে আমি যে ভাবেই হোক সময় বার করে নেব। তুমি চিন্তা কর না। তোমার বোন বলে কথা!”
“দুর শালা, ওই সব ন্যাকা-ন্যাকা কথা রাখ। কত গুরুদক্ষিণা দিতে হবে তাই বল।”
“তাহলে আমি তোমার বোনকে পড়াতে পারব না জগাদা। তুমি অন্য মাস্টার দেখে নাও। টাকাই যখন দেবে তখন তুমি আমার চাইতে অনেক ভাল মাস্টার পাবে। আমি হলাম গিয়ে বিনি পয়সার মাস্টার, অবশ্য সবার জন্য নয় শুধু তোমার জন্য।”
আচ্ছা, আচ্ছা সে দেখা যাবে! এখন আয় বসে চা-বিস্কুট খা।”
এই বলে জগাদা ভোম্বলদাকে হাঁক দিল।
“এই ভোম্বলদা, দু কাপ চা আর দুটো টোস্ট বিস্কুট দাও তো। আর খাতায় আমার নামে লিখে রাখ। মাসের শেষে একসাথে পাবে।”
ভোম্বলদা লোকটা বড় ভালোমানুষ। চা, তেলেভাজা, বিড়ি, সিগারেট আর সামান্য কিছু টুকিটাকি জিনিস বেচে যে আয় হয় তাতেই সংসার চালিয়ে নেয়। ভোম্বলদা দু কাপ চা আর দুটো টোস্ট বিস্কুট এগিয়ে দেয়।
এই ফাঁকে আমি জগাদার সম্বন্ধে দু-চার কথা জানিয়ে রাখি। গুণ্ডামিতে জগাদার এই বস্তিতে বেশ নাম ডাক আছে। এই বস্তির সকলেই জগাদাকে ভয় পায়। জগাদার শাকরেদরাও এই বস্তিরই ছেলে- কালু, কচি, প্যাঙার দল। যতদূর জানি জগাদা ওয়াগান ব্রেকার। তবে নিজের মুখে আমার কাছে স্বীকার করে নি কোনদিন। আমিও নিজে থেকে অযথা কৌতূহল দেখায় নি। তবে ওদের পকেটে দেশী পিস্তল থাকে এটা আমার চোখে পড়েছে বহুবার। কেন জানি না জগাদা আমাকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করে। এই বস্তির মধ্যে সম্প্রতি আর একটা দল গজিয়ে উঠেছে। দলটার নেতা ফন্টে। ফন্টে বাজার থেকে তোলা তোলে আর সুযোগ পেলেই রাত-বিরোতে ছিনতাই করে। এই নিয়ে জগাদার সাথে ফন্টের দলের বিরোধ। জগাদা অনেকবার ফন্টেকে নিজের এলাকা থেকে তোলা তুলতে বারণ করেছিল কিন্তু ফন্টে কথা রাখে নি। এইতো সেদিন স্বরস্বতী পূজার দিন দু-দলের মধ্যে বোমাবাজি শুরু হল। কারণটা কি, না ফন্টের দলের একটা ছেলে নেপু না কি যেন নাম বস্তির-ই একটা মেয়েকে অশালীন ইঙ্গিত করেছিল। পুলিশ এল, দু-দলের কয়েকটাকে থানায় তুলে নিয়ে গেল ব্যাস ওই পর্যন্ত। বস্তিটা বেশ কয়েকদিন শান্ত রইল। কয়েকদিন পর জামিনে ছাড়া পেতেই আবার যে কে সেই!
বস্তি বলে বস্তি- টালি-খাপরার চাল। দশ ফুট বাই দশ ফুট একটা করে ঘর টিন দিয়ে ঘেরা অথবা তিন ইঞ্চি ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। ওই একটা ঘরেই সবকিছু। বাথরুম বলতে ঘরের বাইরে সবার জন্য ছেঁড়া পর্দা বা পলিথিন দিয়ে ঢাকা কয়েকখানা টিনের ঘেরা জায়গা। মেয়েদের আলাদা আর পুরুষদের আলাদা। খাওয়ার জল নেবার জন্য আছে সরকারী কয়েকটা টিউবওয়েল যেটা বস্তির মানুষজনের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তার মধ্যে আবার কয়েকটা কল বছরের বেশীরভাগ সময়ই খারাপ থাকে, তাই জল নেবার লাইনে মারপিট, ধাক্কা-ধাক্কি, গালিগালাজ লেগেই থাকে। তবে এই ঘটনাগুলো বস্তিবাসীদের কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে।
বাজার করে বাড়ি ফিরে দেখি শম্পা গান গাইছে। শম্পার গানের গলাটা খুব সুন্দর। অনিমেষদা সপ্তাহে একদিন করে এসে শম্পাকে গান শিখিয়ে যায়। এই অনিমেষদাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। বড়লোকের ছেলে, চালচলন মোটেই ভাল নয়। এই নিয়ে আমি বেশ কয়েকবার শম্পাকে বলেছি যে ওর থেকে সাবধানে থাকতে, কিন্তু শম্পা আমার কথা রাখে নি। বাজারটা রান্নাঘরে রেখে শম্পাকে জলখাবার দিতে বললাম। শম্পা থালায় করে রুটি আর আলুর তরকারী দিয়ে গেল। জলখাবার খাচ্ছি, ঠিক সেই সময় শম্পা বলে ওঠে-
“জানিস দাদা, অনিমেষদা আমায় ওদের পাড়ার ক্লাবে গান গাওয়ার জন্য বলেছে। ওরা আমায় সামান্য কিছু টাকা ও দেবে বলেছে।”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। মনটা ভাল নেই। শম্পার কথাটা মনের মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি মাকে বলেও কোন লাভ হবে না। অভাবের সংসারে শম্পা কিছু রোজগার করুক এটা মা ও চায়। মামারা সংসার চালালেও আকার-ইঙ্গিতে অসুবিধার কথা বুঝিয়ে দেয়। আমার নিজের উপরই নিজের রাগ হল। শালা! এতদিনে একটা সামান্য কাজ ও যোগাড় করতে পারলাম না!
এখন মাঝে-মধ্যেই শম্পা স্টেজ-শো করতে যায়। হাতে কিছু টাকা ও আসছে। একদিন বিকেলবেলা জগাদার বোনকে পড়াতে যাচ্ছি- রাস্তার মোড়ে অনিমেষদার মোটর-সাইকেলের সামনে দেখি শম্পা হেসে হেসে গল্প করছে। কেন জানি না মাথায় রক্ত উঠে গেল। সরাসরি অনিমেষদাকে বললাম-
“দেখ অনিমেষদা, আমার বোনের সাথে রাস্তায় এইভাবে মেলামেশা আমার মোটেই পছন্দ নয়। তুমি গান শেখাতে যাও ওই পর্যন্ত তার বেশি কিছু নয়।”
এই বলে টানতে টানতে বোনকে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়িতে এসেই বোন চিত্কার জুড়ে দিল আর যা মুখে আসে তাই আমায় বলে দিল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার দেখি শম্পা ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে সস্তা দামের পাউডার মেখে সেজেগুজে সন্ধ্যেবেলা বের হচ্ছে।
আমি বললাম-“এই সন্ধ্যেবেলায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
শম্পা বিরক্ত সহকারে উত্তর দেয়- “পাশের পাড়ায় গানের প্রোগ্রাম আছে।”
“ক্লাবের নাম কি?”
ঝাঁঝালো কন্ঠে উত্তর দেয়-“তোর জেনে লাভ কি?”
“কখন ফিরবি?”
“ফিরতে রাত হবে।”
“রাতে একা একা ফিরবি কি ভাবে?”
“তোকে চিন্তা করতে হবে না। অনিমেষদা আমায় গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে যাবে।”
এই বলে গটগট করে আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মনে মনে ক্ষেপে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। সত্যিই তো! আমি দাদা হয়ে সংসারে কিছুই দিতে পারি না, আমার বলার মুখ কোথায়?”
সেদিন বস্তিতে পড়াতে যাচ্ছি, হঠাত্ বস্তি থেকে রুমা আমায় ডাকল। কলেজে পড়ার সময় রুমার সাথে আমার একটু-আধটু মেলামেশা ছিল। একটা ভাল লাগালাগির ব্যাপার ও ছিল। কিন্তু বেকার আমি, চাকরি-বাকরি নেই, ভবিষ্যতে কি ভাবে আমি ওর দায়িত্ব নেব? এই চিন্তা করেই আমি ধীরে ধীরে ওর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। যদিও রুমা আমায় কাছের করে নিতে চেয়েছিল। বলেছিল তুমি চিন্তা কর না একদিন দেখ তুমি ঠিক চাকরি পাবে। আমি মত দিই নি। তবুও আজ হঠাত্ যখন রুমা আমায় ডাকল, আমার অতীতের কথা মনে পড়ল। আমি ডাক এড়াতে পারলাম না। আমি রুমার ঘরে গেলাম।
“এই মলয় চা খাবে?” বলেই মুখ টিপে হাসল।
“ঘরেতে এখন কেউ নেই বলে বোধহয় ডাকা হচ্ছে?”
হ্যাঁ, ঠিক তাই, ঘরেতে এখন আমি একা।”-বলেই চোখের দৃষ্টিতে ঝিলিক তুলল।
রুমার পরনের শাড়ি শিথিলভাবে গায়ে জড়ানো। আমি রুমার খাটে বসলাম।
“তুমি এখন অনেক পাল্টে গেছ।”
“পাল্টাবো না কেন? আমি তো আর এখন কচি খুকিটি নই! মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে।”
চা খেতে খেতে বললাম-“তুমি এখন আগের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখতে হয়েছ।”
“করবে নাকি মন চুরি?” বলেই ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি করল।
কথার মর্মার্থ এতটাই স্পষ্ট যে আমি চুপ করে রইলাম।
রুমা দেখছিল আমাকে। কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ। তারপর রুমা বলল-
“জান মলয়, পেটের ক্ষিদে লাজ-লজ্জা মনে না। ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।”
এই বলে আমার বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল রুমা। সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই আমার কাছে। কি বলতে পারি আমি? আমি উঠে পড়লাম। বুকের ভিতরটা চিনচিন করছে। রুমার করুণ-অসহায় মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। বস্তিতে থাকলেও রুমার মধ্যে চিরদিনই একটা শালীনতা ছিল। পড়াশুনাতে খুব একটা খারাপ ছিল না। দেখতেও যথেষ্ট সুন্দর, গায়ের রঙ অতীব ফর্সা। এরূপ মেয়ের পাত্রের অভাব হবার কথা তো ছিল না? তবে কেন আজ এই পরিণতি? মাথাটা আমার কাজ করছিল না। রুমার এই অবস্থার জন্য আমিও কি দায়ী নই? কেন আমি পারলাম না রুমাকে নিরাপত্তা দিতে? না, জগাদার সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে।
ভাগ্য ভাল, বেশিদূর যেতে হল না, বস্তির গলির মুখেই জগাদার সাথে দেখা হয়ে গেল।
“জগাদা হয় তোমাদের দলে আমায় ভিড়িয়ে নাও, আর তা নাহলে আমাকে যে কোন একটা সামান্য কাজ জুটিয়ে দাও। আমি আর পারছি না! আমি জানি পারলে তুমিই পারবে কিছু করতে। কারণ তোমার অনেক চেনা-জানা আছে।”
“কি হয়েছে কি তোর? আজ যেন তোকে বড্ড বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। আগে একটু স্বাভাবিক হয়ে বোস তারপর শুনব তোর কথা।”
আমি একে-একে শম্পা ও রুমা দুজনের কথাই বললাম। কোনও কিছুই লুকালাম না।
জগাদা মন দিয়ে আমার কথা শুনল।
“মলয় তুই নিজের মনকে প্রশ্ন কর, তুই কি চাস? তুই কি মনেমনে এখনো রুমাকে ভালবাসিস?”
“আমি নিজেই ঠিক জানি না সত্যিই আমি ওকে ভালবাসি কিনা! কিন্তু ওর জন্য আমার কষ্ট হয়। বুকের মধ্যে রুমার স্পন্দন অনুভব করি। জানিনা এটাই ভালোবাসা কিনা!”
“ঠিক আছে, এখন তুই শান্তভাবে বাড়ি যা। মন শান্ত হলে দু-তিনদিন পর আমার সাথে দেখা করিস দেখি কি করতে পারি তোর জন্যে।”
তিনদিন পর আমি দেখা করলে জগাদা আমায় নিয়ে জগনলাল ছাবারিয়ার অফিসে গেল। অফিস বললে ভুল হবে, ছোট একটা আট ফুট বাই আট ফুটের ঘর। ঘরে একটা ছোট টেবিল, দুটো চেয়ার আর একটা ল্যাপটপ। জগাদকে দেখতে পেয়েই জগনলাল বলল-
“আইয়ে আইয়ে জগনবাবু, বৈঠিয়ে।”
জগাদা বসতে বসতে আমাকে দেখিয়ে বলে-
“এর কথাই বলেছিলাম ছাবারিয়াজী।”
ছাবারিয়া মুখ তুলে আমাকেও বসতে বলে।
ঘরের পিছনেই টিন দিয়ে ঘেরা কারখানা। কারখানায় জনা-দশেক লোক কাজ করছে। কারখানা লাগোয়া গো-ডাউন, ওখান থেকেই বোধহয় কলকাতার বিভিন্ন দোকানে মাল সাপ্লাই হয়। ঘরে জগনলাল বসে আছে। মোটা-সোটা, ছোটখাটো মানুষ, মাথায় সাদা-পাকা চুল, বয়স অন্তত: পঞ্চাশ হবে। দেখলেই মানুষটকে ধূর্ত বলে মনে হয়।
“বলিয়ে ক্যায়া পিয়েঙ্গে? চায়ে য়া কফি?”
“ না,না-আমি এখন কিছুই খাব না বরং কাজের কথায় আসা যাক।”- জগাদা বলে।
“ বতাইয়ে, ম্যায় আপ কি ক্যায়া সেবা কর সকতা হুঁ?”
“এর নাম মলয় দাস। বি.এ. পাশ, ভদ্রঘরের ছেলে, আমার মত গুণ্ডা, বদমাশ নয়। একে আপনার অফিসে যে কোন একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।”
“ও তো ঠিক হ্যায় জগনবাবু, লেকিন ......”
“ও সব লেকিন-ফেকিন পরে হবে। এখন ওর কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।”
ছাবারিয়ার মুখে একটা চাপা হাসি ফুটে ওঠে। দেখলেই মনে হয় লোকটা একটা পাক্কা শয়তান।
“ঠিক হ্যায় জগনবাবু। আপ বোল রহে হ্যায় তো ম্যায় জরুর কোশিশ করুঙ্গা। লেকিন ওহি জো আপকা অপনেণ্ট ফন্টেবাবু আছে না, ওহি হারামী মেরা ধন্দা মে রুকাবট ডাল দেতা হ্যায়। আপ উসে থোড়া সমঝা দিজিয়ে, কি মেরে কাম মে রুকাবট না ডালে।”
“ঠিক আছে ছাবারিয়াজি আমি ওকে কড়কে দেব। ফন্টে আর আপনার ব্যাপারে মাথা গলাবে না।”
“তব তো নোকরী ভী পাক্কা হয়ে গেল।”
ছাবারিয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে- “কাল সে আপ আ যাইয়ে। আপকো হর চীজ কা হিসাব রখনা হোগা। জো রেজিস্টার হ্যায় উসে ভী সম্ভাল কে রখনা পড়েগা। ইস কে অলাবা ডেলিভারী ভী করনা হ্যায়।”
আমি মিনমিন করে বললাম- “মাইনে কত?”
“তনখা কি বাত ছোড়িয়ে আপকে সাথ আপকা দোস্ত হ্যায় না?”
আমিও নাছোড়বান্দা, তাই বললাম-
“তবু একটু আভাস দিলে ভাল হয়।”
ছাবারিয়া হো-হো করে হেসে ওঠে।
“ঠিক হ্যায় আপকো ইস মহিনা সে দশ হাজার তনখা মিলেগা। অভী খুশ হ্যায় না?”
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এত টাকা! এত আমার কল্পনার বাইরে। আমি ছাবারিয়া কে ধন্যবাদ জানালাম। যেতে যেতে আমি জগাদার হাত দুটো ধরে অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানালাম।
ভোর হয়েছে, আজ আমার কাছে পৃথিবীটা যেন নতুন করে ধরা দিয়েছে। আজ যা দেখছি সবই সুন্দর লাগছে। এই মুহূর্তে আমার কারোর প্রতি রাগ নেই। কাউকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছা করছে না। জীবনের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছে আমার কাছে। মাসের শেষে, জীবনের প্রথম উপার্জনের নগদ কড়কড়ে দশ হাজার টাকা হাতে পেয়েই স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করলাম। আসতে আসতে রুমার কথাই ভাবছিলাম। ছোটবেলা থেকে এই বস্তিতে রুমাকে দেখে আসছি। রুমার বাবা মারা যাবার পর রুমার মা-ই মানুষ করেছে রুমাকে। রুমার মা একটা স্কুলে পিয়নের কাজ করে। হঠাত্ মনে পড়ল রুমা ভোম্বলদার দোকানের বেগুনি খেতে খুব ভালবাসতো। আগে কতদিন দুজনে মিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা-বেগুনী খেয়েছি। ভোম্বলদা দারুণ তেলেভাজা ভাজে। আজ বহুদিন পর ভোম্বলদার দোকান থেকে রুমার জন্য বেগুনি কিনলাম। রুমার কাছে যাবার আগে একটা শাড়ির দোকান থেকে আগেই রুমার জন্য একটা ভাল শাড়ি আর সায়া-ব্লাউজ কিনেছি। ব্লাউজের মাপটা এখনও মনে আছে আমার। তাড়াতাড়ি বস্তির দিকে পা বাড়ালাম। রুমার ঘরের সামনে এসে রুমাকে ডাকলাম। আমি জানি এই সময় রুমার মা ঘরে থাকে না, স্কুলে থাকে।
রুমা আমায় দেখে অবাক হয়। রুমা ভাবতেও পারেনি যে একমাস আগের ওই ঘটনা শোনার পর ও আমি আবার আসতে পারি।
“কি হল আমায় ঘরে আসতে বলবে না?”
রুমা সম্বিত ফিরে পায়। আমায় ঘরে আসতে বলে। সেই ঘর, সেই পরিবেশ। রুমা খাটের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমা প্রাণভরে আমায় দেখছিল। কিছুক্ষন আমাদের দুজনের মুখেই কোন কথা নেই।
আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম- “দু কাপ চা কর দেখি। ভোম্বলদার দোকান থেকে তোমার পছন্দের বেগুনি নিয়ে এসেছি।”
রুমা তাড়াতাড়ি চা করতে বসে।
“জানো তোমায় একটা সুখবর দিই, জগাদা আমায় একটা কাজ জুটিযে দিয়েছে। মাইনে কড়কড়ে দশ হাজার টাকা।”
রুমা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেগুনিটা খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিলাম। তারপর অলসভাবে একটা সিগারেট ধরালাম।
“তোমার হাতে ওটা কিসের প্যাকেট?”
“ওহ! প্যাকেটের কথা একদম ভুলেই গেছি। ওটা তোমার জন্য।”
“কি আছে প্যাকেটে?” আগ্রহভরে রুমা জিজ্ঞেস করে।
“খুলেই দেখ না।”
“ওমা! এতো একটা দামী শাড়ি, তার সাথে সায়া, ব্লাউজ ব্যাপারটা কি? এগুলো নিয়ে কি করব আমি? তার চেয়ে তোমার যার সাথে বিয়ে হবে তাকে দিও। এখন তুলে রাখ।”
“আমি এটা তোমার জন্যই এনেছি শুধু তুমি পরবে বলে, অন্য কারোর জন্য নয়।”
রুমার বিশ্বাস হচ্ছিল না! ওকি কোন স্বপ্ন দেখছে? নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটে।
“তুমি আমার ব্লাউজের মাপ জানলে কি করে? এখন মনে আছে বুঝি?” -বলেই দুষ্টুমির হাসি হাসে।
আমি রুমাকে আলতো ভাবে স্পর্শ করলাম। রুমা লজ্জা পায়। রুমা সরে যেতে চাইলে আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম। আবেশে রুমার চোখ বুজে আসে। মাথাটা এলিয়ে দেয় আমার বুকে। এ যেন এক পরম নির্ভরতার জায়গা।
“রুমা।”
“হুঁ।”
“শাড়িটা পরে দেখাবে আমায়? দেখি আমার প্রিয়তমাকে কেমন দেখায়!”
“ছি:! তোমার সামনে আমি শাড়িটা পরব কি ভাবে? দেখছ না একটাই ঘর।”
“কেন আমি পিছন ঘুরে থাকব, তুমি শাড়ি পরে নেবে।”
“অসভ্য! দুষ্টু কোথাকার! দুষ্টু বুদ্ধি যায় নি এখন তাই না?”
রুমা আমার চোখে চোখ রেখে বাঁকা করে হাসে। তারপর পরনের শাড়িটা খুলে আমার শাড়িটা পরতে শুরু করে। প্রাণভরে দেখলাম রুমাকে। নতুন করে আবিষ্কার করলাম আমার রুমাকে। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল রুমাকে।
“রুমা।”
“কি বলছ?”
“আচ্ছা, আমরা আবার নিজেদের ফেলে আসা জীবনটা শুরু করতে পারিনা ঠিক যেখানে আমাদের গতির চাকাটা থেমে গিয়েছিল?”
“ভয় হয়, যদি আবার তোমায় হারিয়ে ফেলি। আমার মত মেয়ের জন্য যদি তোমার গায়ে কলঙ্ক লাগে, তা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না।”
“তোমার তো কোন কলঙ্ক নেই। আমার কাছে তুমি এখনও পবিত্র, ফুলের মতই সুন্দর।”-আবেশে গলা বুজে আসে আমার।
রুমা সজোরে আমায় জড়িয়ে ধরে। দুজনে মুখোমুখি, চারিদিক নি:স্তব্ধ, শুধু সময় বয়ে চলে। আসার সময় রুমা পরম নির্ভরতায় আমার ওষ্ঠে গভীর চুম্বন এঁকে দেয়।
জগাদার সময়টা খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না। জগাদা ফন্টেকে ছাবরিয়ার সাথে ঝামেলা করতে বারণ করে।
ফন্টে বলে-“এটা কি রকম কথা হল জগাদা? তুমি শালা মাল কামাবে, আর আমি কামালেই দোষ?”
“ফন্টে, মুখ সামলে কথা বল।”
“ওটা হবে না জগাদা। এটা আমার ধান্দার ব্যাপার। আমার ধান্দাতে আমি কাউকে নাক গলাতে দেব না, যেমন আমি তোমার ধান্দাতে নাক গলাতে যাই না।”
জগা পকেট থেকে পিস্তল বার করে।
ফন্টে বলে-“জগাদা পিস্তল দিয়ে আমায় ভয় দেখিও না। আর শোন আমায় বেশি ঘাঁটিও না। বেশি ঘাঁটালে শালা তোমাকেই ফাঁসিয়ে দেব। তোমার কাজের গোপন খবর ও আমার কাছে থাকে এটা ভুলে যেও না।”
জগাদা সজোরে ফন্টের মুখে ঘুঁষি চালায়। ফন্টের ঠোঁট থেকে গলগল করে রক্ত বেরতে থাকে। ফন্টে ঠোঁটের পাশ থেকে গড়িয়ে আসা রক্ত রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে উঠে পরে।
“ঠিক আছে আবার মুলাকাত্ হবে।”
রাত্রিবেলায় আমি বিছানায় শুয়ে আছি, মা ঘরে প্রবেশ করে। আমি চমকে উঠে বসি। মা তো রাতে আমার ঘরে আসে না, আজ আবার কি হল?
“কিছু বলবে আমাকে?”
“তোর সাথে আমার কথা আছে।”
“সেটা তো কাল ভোরে বলতে পারতে, এত রাতে কেন?”
“না কথাটা জরুরী এবং গোপনীয়- কথাটা তোর বোনের সম্বন্ধে।”
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিম শীতল স্পর্শ নেমে গেল। তাকিয়ে দেখি দরজার বাইরে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে শম্পা।
মা বলতে শুরু করে-“ তুই তো জানিস তোর বোন অনিমেষের সাথে এখানে ওখানে বিভিন্ন পাড়ার ক্লাবে গান করতে যায়। এখন আবার বেশ কিছুদিন ধরে ফাংশন সেরে রাত করে বাড়ি ফেরে। অনিমেষই তোর বোনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। এই নিয়ে তোর বোনের সাথে আমার অশান্তি ও হয়েছে বেশ কয়েকবার।”
উত্তেজনার কারণে মা খানিকটা দম নেয়- তারপর আবার বলতে শুরু করে-
“আমি জানতাম না তোর বোন কবে থেকে অনিমেষের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর তারই জন্য ......” -মা আর বলতে পারে না, কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ওদিকে দরজার ওপারে শম্পাও ডুকরে কেঁদে ওঠে।
পুরো ঘটনাটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। যতই বোনকে বকাঝকা করি, আমি তো ওকে মন থেকে ভালো ও বাসি।
আমি বোনকে বললাম- “তুই তোর এই ঘটনার কথা অনিমেষকে জানিয়েছিস? সব শুনে কি বলেছে ও?”
“অনিমেষ এখন আমায় বিয়ে করতে অস্বীকার করছে। দাদা তুই আমায় যে ভাবে হোক বাঁচা।” –বলেই আমার হাত দুটো ধরে কেঁদে উঠল।
আমি দু-হাত দিয়ে ওকে ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম- “আমায় একটু ভাবার সময় দে। আমি দেখছি কি করা যায়।”
পরের দিন খুব সকালেই আমি অনিমেষদার ফ্ল্যাটে গেলাম। ফ্ল্যাটটা আমাদের বস্তি থেকে হাঁটা পথে মিনিট দশেক। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলল অনিমেষদার মা।
“এত সকালে কি ব্যাপার বলতো?” মুখে বিরক্তির ছাপ সুপষ্ট।
“দরকারটা অনিমেষদার সাথে, আপনি অনিমেষদাকে বলুন শম্পার দাদা মলয় এসেছে।”
“অনিমেষ এখন ঘুমাচ্ছে, তুমি বেলা করে এস। এখন ডাকলে বিরক্ত হবে।”
না এখনই আমায় দেখা করতে হবে।”
দরকারটা কি আমায় বল।”
“আপনাকে বলা যাবে না।”-বলে একপ্রকার জোর করেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে অনিমেষদাকে ডাকলাম।
বেশ কয়েকবার ডাকার পর অনিমেষদা ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
“কি ব্যাপার মলয়? এত সকাল সকাল?”
“তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে শম্পার ব্যাপারে। ঘরে চল।”
“তুমি এখানেই বলতে পার।”
ভণিতা না করে আমি শম্পার ঘটনা জানালাম।
“এখন তুমি কি করবে বল?”
“দেখ এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। ডাক্তারের কাছে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে। এত চিন্তা করার কারণ নেই। এরকম আকছার হয়ে থাকে।”
অবাক বিস্ময়ে আমি অনিমেষদার দিকে তাকালাম। অনুতপ্ত হবার কোন চিহ্নই নেই মুখে! মাথায় রক্ত উঠে গেল-
“লুচ্চা, বদমাশ! মেয়েদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা? আমার বোনের সর্বনাশ করে এখন সাধু হতে চাইছ?”-বলেই অনিমেষের জামার কলারটা চেপে ধরলাম। চিত্কার চেঁচামেচি শুনে অনিমেষদার মা ছুটে এলেন।
সব শুনে বললেন-“ তোমার বোন মোটেও ভদ্রঘরের মেয়ে নয়। তা না হলে আমার ছেলের সরলতার সুযোগ নিয়ে আগেই এরকম নোংরা ঘটনা ঘটাতে পারে! কি ভেবেছ? এই ভাবে আমাদের বাড়িতে তোমার বোনকে গছিয়ে দেবে? এইসব মেয়েরা এইরকমই। কার না কার সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করে এখন অনিমেষের উপর দোষ চাপাচ্ছে।”
চিত্কার করে বললাম-“লজ্জা তো আপনাদের হওয়া উচিত। একটা গরীব মেয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে তার নারীত্বের অপমান করছেন! আপনারা ভদ্রবেশী শয়তান, অতি নীচ মনোবৃত্তি আপনাদের। ঠিক আছে আমিও এত সহজে আপনাদের ছাড়ব না, দরকারে থানা-পুলিশ করব। দেখি তখন আপনারা কি বলেন।”-বেরিয়ে এলাম আমি।
কপালের রগ দুটো ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। চারপাশটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতে আমি জগাদার কাছে এলাম।
সব কিছু শোনার পর জগাদা আমায় বলল-“ দেখ মলয়, আমার চোখ রাঙানিতে অনিমেষ হয়তো শম্পাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে- কিন্তু যেখানে মনের মিল নেই, যেখানে বিশ্বাসের মূল্য নেই, পারস্পরিক বোঝাপড়া নেই, সেখানে এই বাহ্যিক বিয়ের বন্ধনে শম্পা কি সুখী হতে পারবে? সংসারে যদি দুটি নারী-পুরুষের মধ্যে আত্মার মিলনই না ঘটে, কি সার্থকতা এই বন্ধনে? বরং তুই মাথা ঠান্ডা করে এখন বাড়ি যা, শম্পার মুখোমুখি হয়ে ওর মতামত নে, ও নিজে কি ভাবছে, কি চায় সেটা আগে বোঝ তারপর আমায় জানা। যদি এতকিছুর পরেও শম্পা অনিমেষকে বিয়ে করতে চায় তাহলে আমায় বলিস। তারপরে অনিমেষকে এই বিয়েতে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।”
আমি বাড়ি ফিরে এলাম। ঠিকই তো বলছে জগাদা। দুটি নারী-পুরুষের অন্তরের ছোট ছোট প্রাপ্তিগুলোই তো প্রকৃত পাওয়া। জোর করে পাবার মধ্যে আছে শুধু সহানুভূতি আর করুণা। না-না! এই প্রাপ্তিতে সুখ নেই, আছে শুধু দৈহিক চাহিদা মেটাবার প্রয়াস।
এদিকে জগনের এর নতুন করে বহুদিন আগের ফেলে আসা স্মৃতি মনে পড়ে। কতই বা বয়স তখন শম্পার?- তের কি চোদ্দ। ফ্রক পরে, বেণী ঝুলিয়ে বস্তির সামনের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেত। মুখে মধ্যে ছিল অপার সরলতা। সে নিজে তখন সবেমাত্র কলেজে ঢুকেছে। আসা-যাওয়ার পথে দেখা হত মাঝে-মাঝে। চোখা-চোখি, সামান্য মধুর হাসি, ব্যাস ওই পর্যন্ত তার বেশি কিছু নয়। মলয়ের বাবা তখনও বেঁচে। একদিনের ঘটনা মনে পড়ে, যেদিন শম্পার সাথে প্রথম আলাপ হয়। জীবনে প্রথম ভালোবাসার অনুভুতি। শম্পার সাহচর্য পাবার জন্য মনটা ছটফট করত। শম্পার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মিশে যেত। যৌবনের প্রেম উদ্বেল করে তুলেছিল কিন্তু কখনই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নি। তারপর হঠাত্ স্বপ্নগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর পর নিজেদের সংসারটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল। মা, বোনের দায়িত্ব তখন নিজের ঘাড়ে। আর্থিক অনটনে কলেজ ছেড়ে দিতে হল। শান্ত-সরল ছেলেটা সংসারের ঘানি টানতে টানতে নিজের অজান্তেই কি ভাবে যেন হারিয়ে গেল! আজ তার পরিচয় ওয়াগান-ব্রেকার! নিজের মনেই হেসে ওঠে জগন।
বাড়িতে ঢুকেই মা আর বোনকে সকাল থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা বললাম। জগাদার কথাও বাদ দিলাম না। হঠাত্ দেখি জগাদার নাম শুনে শম্পার চোখটা ছলছল করে উঠল। তাহলে আজও কি বোনের মনের গভীরে কোন এক কোণে জগাদার জন্য সুক্ষ্ণ অনুভূতি রয়ে গেছে? এতদিন পর তার আত্মপ্রকাশ ঘটলো? না! আমি আর কোন কিছু চিন্তা করতে পারছি না। কেমন যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। রাত তখন বারোটা। আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা শম্পা আর রুমাকে নিয়ে, হঠাত্ দেখি শম্পা আমার ঘরেতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। দু-হাত দিয়ে ওকে বিছানায় তুলে নিলাম। সস্নেহে ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম-
“শম্পা”-কোন সাড়া নেই।
আবার ডাকলাম-“কিছু বলবি আমাকে?”
এবার ও শম্পা নিরুত্তর।
“শম্পা আমি তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব তুই কি সত্যি উত্তর দিবি?”
“বলো।”
“তুই কি এখনও জগাদাকে মন থেকে ভালোবাসিস?”
শিশুর মত কাঁদতে-কাঁদতে শম্পা আমায় জড়িয়ে ধরে।
“থাক! আর আমায় তোকে মুখ ফুটে কিছু বলার দরকার নেই। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। তুই কিছু চিন্তা করিস না, আমি নিজে জগাদার সাথে কথা বলব। তুই ও কি যেতে চাস আমার সাথে?”
নীরবে সম্মতি জানায় শম্পা।
পরের দিন, সন্ধ্যাবেলায় আমি জগাদার বাড়িতে গেলাম।
“আয় ঘরে আয়। শম্পার সাথে কথা হয়েছে?”
“হ্যাঁ, কথা বলেছি।”
“কি বলল শম্পা?”
“ও অনিমেষদাকে ভুলে যেতে চায়।”
আমরা দুজনেই চুপচাপ।
কি করে কথাটা পারবো বুঝে উঠতে পারছি না। জগাদা আমার কথাটা কি ভাবে নেবে জানি না। তবুও-
“জগাদা একটা অনুরোধ করব তোমাকে?”
“আবার ভণিতা? যা বলবি সোজাসুজি বল।”
“তুমি কি পার না আমার বোনের ভার নিতে?”
জগাদা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকায়।
“কি বলছিস কি তুই? ভাবনা চিন্তা করে কথাটা বলছিস তো? তোর বোনের মত আছে এতে?”
“হ্যাঁ, ওর মত নিয়েই কথাটা তোমায় বলছি।”
জগাদা কিছুক্ষন চুপচাপ, তারপর বলে- “তুই তো জানিস আমার কাজ-কারবার। তোর তো অজানা নেই কিছু। অন্ধকার জগতের মানুষ আমি। আমাদের পদে-পদে বিপদ। আর যদি ভাবি দল ছেড়ে বেরিয়ে আসব তাও সহজ নয়, কারণ আমার দলের কাছে কি জবাব দেব আমি? নিজের স্বার্থের জন্য দল ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছি আমি? তাই এই কাজ ছাড়তে গেলে আমার বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। শম্পা কি পারবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে?”
“তুমি তো জান ওর শরীরের অবস্থা। যা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা তোমাকে দু-এক মাসের মধ্যেই নিতে হবে।”
“আমায় ভাবার একটু সময় দে, আর পারলে শম্পাকে আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে বলিস। ওর সাথে মুখোমুখি বসতে চাই।”
“ ও আমার সাথেই এসেছে জগাদা। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জায় আসতে পারছে না। আমি বরং চলি, তুমি নিজের মত করে ওর সাথে বোঝাপড়া করে নিও।”
জগন বিস্ময়ে দরজার দিকে তাকাল। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে শম্পা। চোখের মধ্যে একরাশ শূন্যতা। এক অস্পষ্ট আছন্নতার বাঁধনে কেমন যেন স্থির হয়ে আছে। কি একটা যেন ওকে দু:খী ও নি:সঙ্গ করে তুলেছে।
“তুমি ভিতরে আসবে না?”
ধীর পায়ে শম্পা ঘরে প্রবেশ করে। শম্পা অপলক দৃষ্টিতে জগনকে দেখছিল। জগনের মুখের কোথাও কোন ক্রোধ নেই, বিরক্তি নেই, অসন্তোষ নেই, আছে শুধু প্রসন্নতা। জগন স্নেহভরে শম্পার মাথায় হাত রাখে। শম্পা কান্নায় ভেঙে পড়ে বালিশে মুখ ঢাকে। রাত গভীর হয়- বাইরের জানালা দিয়ে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ঘরে প্রবেশ করে।
শম্পা জীবনে এত শান্তি পায় নি কখনো। আবেগে কেঁপে কেঁপে ওঠে তার দেহমন। মনে হয় চাইলেই সে তার মনের মানুষটাকে স্পর্শ করতে পারে। হৃত্পিন্ডের স্পন্দন দ্রুত হয়। বাইরের কোথাও ঘড়িতে দশটার ঘণ্টা বাজে। জগন শম্পার দেহে কান পেতে ভবিষ্যতের স্পন্দন অনুভব করে। আবেশে শম্পার চোখ বুজে আসে।
মেঘ সরে গিয়ে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। থেমে থাকা ঘড়িটা আবার চলতে শুরু করেছে। বহুদিন পর প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাড়িটা। আগামী শ্রাবণ মাসে একই দিনে শম্পা আর রুমার বিয়ে। দুটি নারীর হৃদয়েই পাখা মেলেছে। যৌবন যেমন বস্ত্রের শাসনে বাধা থাকতে চায় না, তাদের আবেগপূর্ণ উচ্ছ্বাস ও সেইরূপ হৃদয়ের আবরণে ঢাকা থাকতে চাইছে না। বহুদিন পর তাদের হৃদয়ের সূক্ষ্ণ অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
বিয়ের নিমন্ত্রণ উপলক্ষ্যে আমি এখন খুব ব্যস্ত। দু-বাড়ির কাজই আমায় একা হাতে সামলাতে হচ্ছে। সেদিন আমি বিয়ের কার্ড নিয়ে ছাবারিয়ার অফিসে গেলাম। ছাবরিয়া বলে-“ইয়ে তো খুশি কা বাত আছে। হম জরুর আউঙ্গা।”
এরপর একদিন ছাবরিয়া আমাকে নিয়ে রুমাদের বাড়িতে আসে। রুমাকে ডেকে একটা দামী গহনার বাক্স হাতে তুলে দেয়। রুমা এত দামী উপহার দেখে অবাক হয়ে যায়। বিয়ের আর দু-একদিন বাকি। আমি, রুমা দুজনে মিলে বিয়ের কয়েকটা জিনিস কেনাকাটা করছি। খুশিতে উপছে পড়ছে রুমা। আমার হাত ধরে বাচ্চাদের মত ছেলেমানুষী করছে। অন্যদিকে জগনের মনটা খুব চঞ্চল। কি একটা অজানা আশঙ্কা মনটাকে গ্রাস করেছে। জগন কাউকে কিছু বলতে পারে না।
গভীর রাত। বিয়ের ঠিক আগেরদিন। জগন তার দলবল নিয়ে কসবার রেল লাইনের সাইটে বসে আছে। সবার হাতে উদ্যত পিস্তল, ব্যাগের মধ্যে হাত-বোমা। আজই শেষ অপারেশন। এরপর প্রত্যেকেই নিজের নিজের ভাগ নিয়ে এই অন্ধকার জগত্ থেকে সরে দাঁড়াবে, সেরকমই কথা আছে। আজ ওয়াগানে প্রচুর অ্যালুমিনিয়ামের পাত আসার কথা আছে। কসবার সাইটে মাল খালাস করার আগেই অপারেশন খতম করতে হবে। অপারেশন ঠিকঠাক হলে প্রচুর দাঁও মারা যাবে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। জগনের এর মনে রুমার ছবি ভেসে ওঠে। ওই তো গুডস ট্রেনটা এগিয়ে আসছে। জগনের বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে বুকটা। জগনরা পজিশন নেয়। ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভিয়ে দেয় জগন।
অন্যদিকে অন্ধকারে আরও যেন কারা এগিয়ে আসছে, জগন দেখতে পেল না। ওর দৃষ্টি এখন ওয়াগানটার উপর নিবদ্ধ। সহসা গুলির শব্দ। অন্য কেউ সাইটে ঢুকে পড়েছে। জগন গুলি চালাতে চালাতে একটা পরিত্যক্ত শেডের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। দূরে আবার একটা আলোর ঝলকানি, বোধহয় কেউ বোমা ছুঁড়েছে। চারিদিক চুপচাপ। এ যেন বিপদ আসার ঠিক আগের মুহূর্ত। জগন দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজেদের দলের মধ্যেই নিশ্চয় কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জগন হামাগুড়ি দিয়ে হাতে উদ্যত পিস্তল নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়। সারা শরীর দিয়ে হিম-শীতল স্রোত নেমে আসছে। ভয়টা তার নিজের জন্য নয়, ভয়টা শম্পার ভবিষ্যত চিন্তা করে। সহসা সামনের মাটি ফুঁড়ে ফন্টে উপস্থিত হয়। হাতে উদ্যত পিস্তল, মুখে ক্রূর হাসি। জগন আশেপাশে নিজের দলের কাউকে দেখতে পায় না। জগন বুঝতে পারে ওর দলের ছেলেরা ফন্টের দলে ভিড়েছে আর আজকের খবরটা ওদের মারফতই ফন্টের কানে গেছে। জগন আচমকা মাথা নিচু করে পিস্তল বার করে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র বাঘের ন্যায় ফন্টের দল জগনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফন্টে সজোরে জগনের বুকে লাথি চালায়। যন্ত্রণায় কুঁচকে ওঠে জগন। এরই মধ্যে কোনক্রমে জগন উঠে দাঁড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করে। আচমকা একটা গুলি জগনের বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জগন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। জগনের দৃষ্টিটা ক্রমশ: যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে শম্পার নিষ্পাপ মুখখানি। মিলিয়ে যাচ্ছে মনের গভীরে সাজানো সব স্বপ্নগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে......।
ভোর হয়েছে, আমাদের বাড়িতে বেজে উঠেছে সানাইয়ের সুর। হঠাত্ দেখি ওই ভোরেই উদভ্রান্তের মত ছুটে আসছে রুমার মা, হাতে একটা খোলা চিঠি। কথা বলার মত অবস্থায় নেই। আমি দ্রুত নেমে এসে চিঠিটা পড়লাম। পৃথিবীটা দুলে উঠল আমার কাছে। একটু একটু করে চেতনা লোপ পাচ্ছে আমার। কিন্তু চেতনা লোপ পাবার আগেই আমি লাফিয়ে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলাম। আমাকে যে ভাবেই হোক ছাবারিয়ার অফিসে পৌঁছোতেই হবে। এত ভোরে রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, তাতে কি! আমি দৌড়তে শুরু করলাম। ওই শয়তানটা কে আমি ছাড়ব না কোনভাবেই। মাথায় রক্ত চড়ে গেছে, কোন হুঁশ নেই আমার। আমি যখন ছাবারিয়ার অফিসে পৌঁছলাম তখন রোদ উঠে গেছে। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি অফিসে ঢুকেই ছাবারিয়ার উপর বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
“শালা, শুয়োরের বাচ্চা! তুই ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটাকে শেষ করেছিস। তোর পাপের স্পর্শে ফুলের মত পবিত্র মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে। শালা, শয়তান......।”
আমার শরীরে আজ খ্যাপা ষাঁড় ভর করেছে। দুই হাত দিয়ে ঘুঁষি চালালাম ছাবারিয়াকে লক্ষ্য করে। আচমকা পিছন থেকে কে যেন আমার কোমরে লাথি চালাল। আমি ভুলে গেলাম যন্ত্রণার কথা। আজ আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে না জিতে ফিরব না। মনের মধ্যে ভেসে উঠছে অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত রুমার অসহায় আর্তনাদ। আমি সমানে চালাতে লাগলাম ঘুঁষি-লাথি। এবার কয়েকজন মিলে রড দিয়ে আমায় মারতে লাগল। ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি বোধহয় হাতটা ভেঙে গেছে। তাই দেখে ছাবারিয়া নেকড়ের মত দাঁত বার করে হাসতে লাগল। আমি ফন্টেকে দেখতে পাচ্ছি, তার সাথে ওর দলের ছেলেরাও আছে। কিন্তু কেন জানিনা আমি কোনও যন্ত্রণা অনুভব করছি না। বেহুঁশের মত উঠে পড়ে ফন্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার রুমাই যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আমার বেঁচে থেকে কি লাভ? এই ফাঁকে আমি ফন্টের অন্যমনস্কতার সুযোগে ওর হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে ছাবারিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি চালালাম। ওই তো ছাবারিয়া মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝেটা। চিত্কার করে উঠলাম আমি-
“পেরেছি পেরেছি রুমা তোমার কথামত শয়তানটাকে আমি শাস্তি দিতে পেরেছি! প্রতিশোধ নিয়েছি আমি! আহ:! বড় তৃপ্তি-।”
হঠাত্ ফন্টে ছুরিটা আমূল গুঁজে দিল আমার বুকে। লুটিয়ে পড়লাম আমি। কোনও যন্ত্রণা হচ্ছে না। ওই তো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রুমা। রুমা আমায় হাত নেড়ে ডাকছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে কি? উঠে রুমার হাত ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, পারলাম না-
রুমার মুখটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। রুমার হাতটা কেন জানিনা ক্রমশ: দূরে সরে যাচ্ছে, দূরে আরও দূরে .....।
---*---
রচনাকাল : ৩১/১২/২০২০
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।