~ নিষ্কৃতি ~
রূপক ঘোষ
দক্ষিণ ২৪ পরগণার অন্তর্গত বারুইপুরের জমিদার নরেন মুখার্জী কে চেনে না এমন লোক ওই তল্লাটে একজনও নেই। বহুকাল আগে বারুইপুরের প্রায় সমস্ত জায়গা নরেন মুখার্জীর পিতা নবীন মুখার্জীর হস্তগত হয়েছিল। যদিও এখন সেই রাম ও নেই আর সেই অযোধ্যা ও নেই। বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমাতে জমিদারির অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে। তবে এখনও যা সম্পত্তি আছে সেটাও নিছক কম নয়। বারুইপুরের বিশাল জমিদার বাড়ি এখনও দাস-দাসী, নায়েব, মোক্তারে গমগম করছে।
নরেনবাবুর প্রথমা স্ত্রী শান্তিবালা দেবীর অকাল মৃত্যু হলে তিনি দ্বিতীয়বার পাণিগ্রহণ করেন। মল্লিকা হল প্রথমা স্ত্রীর একমাত্র কন্যা। পরিণত যৌবনা, বয়স আনুমানিক পঁচিশ, অতীব ফর্সা, মুখের উপর প্রসাধনের নৈপুণ্য তাকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। মল্লিকা যথেষ্ট আধুনিকা এবং শিক্ষিতা, কাজেই পাত্রী হিসাবে মল্লিকার যথেষ্ট কদর আছে। দ্বিতীয়া স্ত্রী প্রভাবতী দেবীর চরিত্র ছোটবেলা থেকেই দৃঢ়ভাবে গঠিত হয়েছিল। চেহারা ও মুখে আভিজাত্যের ছাপ পরিষ্ফুট। এই প্রভাবতী দেবীর একমাত্র কন্যা-যুথিকা। বয়সে মল্লিকার চাইতে বছর তিনেকের ছোট। দিদির মত দেখতে অত সুন্দরী না হলেও মুখে একটা শ্রী আছে। দোহারা চেহারা, শ্যামাঙ্গী, চোখ দুটি কাজল নয়না তবে দিদির মত আধুনিকা নয় বরং ধীর-স্থির ও রক্ষণশীলা; কোথায় যেন একটার মমতার ছোঁয়া আছে। যুথিকা এই বছরই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে থেকে এম.বি.বি.এস. করেছে। নরেনবাবু তার এই ছোট মেয়েকে চিরদিনই অত্যন্ত স্নেহ করেন।
নরেনবাবুর বয়স এখন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। রাশভারী লোক, সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করেন। নরেনবাবু এখন বড় মেয়ের বিবাহ দেবার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজছেন। বাড়িতে রোজ দু-চারজন অভিজাত বংশের পুরুষ মানুষের আগমন হয়। এদের মধ্যে রায়বাহাদুরের ছেলে শুভ্র মুখার্জীকে নরেনবাবুর খুব পছন্দ। ভাল বংশ, ছেলে এফ.আর.সি.এস. করতে বিলেত যাবে শীঘ্রই। মল্লিকার ও শুভ্রকে খুব পছন্দ। শুভ্রর ইচ্ছা বিলেত থেকে ফিরে এসে সে মল্লিকাকে বিবাহ করবে। উভয় বাড়িতেই তাতে আপত্তি নেই। সেদিন বাড়ির অন্যান্য অতিথিরা চলে গেলে শুভ্র গলা খাটো করে মল্লিকাকে বলে-“চল না-বাগানে খানিকক্ষণ বসা যাক।”
মল্লিকা একটু আলগা হাসি হেসে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বাগানে আসে। অভাবনীয় ব্যাপার কিছুই নয়, তবু ঘটনাটা যুথিকার চোখ এড়ায় না। সময় বয়ে যায়- গল্প শেষ হতেই চায় না। যাবার সময় শুভ্র মল্লিকাকে নিজের কলকাতার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। পরের দিন মল্লিকা যথাসময়ে শুভ্রর বাড়িতে উপস্থিত হয়। তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা। শুভ্র দরজা খুলে দেয়। দরজার সামনে মল্লিকা দাঁড়িয়ে আছে। খোঁপা খুলে গিয়ে কাঁধের উপর এলিয়ে পড়েছে। দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে আচমকা হোঁচট খেয়ে মল্লিকা নিজেকে সামলাবার জন্য শুভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে। বাড়িতে শুভ্র ছাড়া আর কেউ নেই। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। জানলার কাঁচের মধ্য দিয়ে বিদ্যুত্ ছিটকে আসছে। মল্লিকা সভয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্র মল্লিকাকে আদর করে বুকের কাছে টেনে নেয়। অনেকক্ষণ শুভ্রের বাহুবেষ্টনে থাকার পর মল্লিকা বলে-
“ছাড় আমার খুব ভয় করছে।”
“ভয় কিসের আমি তো পাশেই আছি। চল, বৃষ্টিতে ভিজি।”
কিছুক্ষন দুজনে ভেজার পর শুভ্র ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর ভিজে জামাকাপড়ে দুজনে দুজনের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রের চোখে পড়ল মল্লিকার সিক্তবাস। উন্নত বুক দুটি যেন নারীত্বের গৌরবে যৌবনশ্রী ফিরে পেয়েছে।ওদিকে শুভ্র ভিজে জামা খুলে ফেলতেই শুভ্রের নগ্ন বুকের উপর মল্লিকার দৃষ্টি পড়ে। সুঠাম, বলিষ্ঠ চেহারা, বুকের মাঝে ঘন লোম। মল্লিকা সর্বাঙ্গ দিয়ে শুভ্রের দেহের সরসতা কে আপন করে নিতে চাইল। গভীর রাত, শুভ্র ও মল্লিকা একই বিছানায় পাশাপাশি-দুজনের ঠোঁট দুটো কাছাকাছি। মল্লিকার বুকের ভিতরটা অসহ্য স্পন্দনে ছিঁড়ে যাচ্ছে। মল্লিকার একটা হাত শুভ্রের বুকের উপর। শুভ্র ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে মল্লিকাকে নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে। অন্ধকারে মল্লিকা সম্পুর্ণরূপে শুভ্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তৃপ্তিতে মল্লিকার চোখ বুজে আসে।
শুভ্র এখন বিদেশে। এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই মল্লিকা নিজের দেহের ভিতর মাতৃত্বের স্পন্দন অনুভব করে যেটা যুথিকারও চোখ এড়ায় না। যুথিকা মনে মনে দিদির ভবিষ্যত চিন্তা করে ভয় পায়। একদিন যুথিকা দিদির মুখোমুখি হয়।
“দিদি তুই কি শুভ্রকে তোর পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিস?”
মল্লিকা নিরুত্তর। বাধ্য হয়ে যুথিকা শুভ্রকে দিদির একান্ত গোপন কথার উল্লেখ করে পত্র লেখে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শুভ্রের পত্র আসে। শুভ্র লিখেছে- এই রকম পরিস্থিতিতে তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। যদি তোমার দিদি এই সন্তানকে অস্বীকার করে বিয়ে করতে চায় তবেই বিবাহ সম্ভব। নতুবা মল্লিকা অন্য কাউকে বিবাহ করতে পারে, এতে তার আপত্তি নেই। তাদের বংশের সুনাম নষ্ট করে তারপক্ষে বিবাহ বহির্ভূত এই সন্তানের স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। এই প্রচণ্ড আঘাতে যুথিকার মনটা ভেঙে যায়। সাশ্রু নয়নে যুথিকা মল্লিকাকে শুভ্রের পত্রটা দেখায়। মল্লিকা সব জেনে কান্নায় ভেঙে পড়ে। যুথিকা মল্লিকাকে সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা খুঁজে পায় না। ক্রমশ: মল্লিকার দেহে মাতৃত্বের চিহ্ন ফুটে উঠছে। অগত্যা মল্লিকা নিরুপায় হয়ে যুথিকার ঘরে প্রবেশ করে।
“তুই যে ভাবেই হোক শুভ্রের কথামত এই পাপ বিদেয় কর। আমি কোনভাবেই শুভ্রকে হারাতে চাই না।”
ছি: দিদি ছি:! এ কি বলছিস তুই? জীবনের প্রথম মাতৃত্বকে তুই অস্বীকার করতে চাইছিস? এত মাতৃত্বের অবমাননা। যে সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে চায় তারতো কোন দোষ নেই। কি পাপ করেছে ওই ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুটা? দোষ যদি থাকে তা তোদের দুজনের। না দিদি না, এ পাপ কাজ আমি তোকে কিছুতেই করতে দিতে পারি না।”
মল্লিকা উগ্রমূর্তি ধারণ করে-“আমার কাছে এই অবাঞ্ছিত সন্তানের কোন মূল্য নেই। আমি এই পাপ রাখতে চাই না-না-না......।
যুথিকা মল্লিকার এই নিষ্ঠুর আচরণে নির্বাক হয়ে যায়। কোন উপায় না দেখে অগত্যা যুথিকা বাবার ঘরে প্রবেশ করে।
“বাবা”।
“কি রে মা, কিছু বলবি?”
নরেন বাবু মনে মনে তার এই ছোট কন্যাকে বড় মেয়ের তুলনায় বেশি স্নেহ করেন।
“ তোর চোখ-মুখ এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? নিশ্চয় মারাত্মক কিছু ঘটেছে, তাই এই অসময়ে আমার ঘরে এসেছিস? বল কি বলতে এসেছিস?”
যুথিকা আনুপূর্বিক ঘটনার বিবরণ দেয়। সব শুনে নরেনবাবু স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। একি শুনছেন তিনি? পরিবারের মান-সম্মান এইভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দিল মল্লিকা? কান্নায় ভেঙে পড়েন নরেনবাবু। তারপর সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নরেনবাবু।
যুথিকাকে বলে-“মা আমি চাই আমার বংশের প্রথম সন্তান যে ভাবেই হোক পৃথিবীর আলো দেখুক। আমি জানিনা তা কি ভাবে সম্ভব! কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হবে।”
“বাবা, তুমি ভেঙে পড় না। আমি যে ভাবেই হোক তোমার ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করব। তবে তোমায়ও এক্ষেত্রে কথা দিতে হবে যে আমি যা সিদ্ধান্ত নেব তাতে তোমায় সম্মতি দিতে হবে, তা যতই কঠিন হোক না কেন।”
“দেব মা দেব, অবশ্যই দেব। আমি যে তোকে ছোটবেলা থেকেই ভরসা করে এসেছি। তুই শুধু বল কি করতে হবে আমাকে।”
“ বাবা আমি দিদিকে সন্তান নষ্ট করতে দেব না। যে ভাবেই হোক রাজি করিয়ে আমাদের বংশের প্রথম সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবই।”
কিন্তু কি ভাবে এটা সম্ভব হবে মা? সবাই তো জানতে পারবে এই কলঙ্কের কথা। আমি সমাজে মুখ দেখাব কি ভাবে?”
বাবা একটাই উপায় আছে। এই বাড়ির ও সমাজের সবাই জানবে আমি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছি। কিন্তু আসলে তা নয়, আমি দিদির সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই ওকে নিয়ে অন্য কোথাও রেখে মানুষ করব। কেউ কোনও সন্দেহ করবে না। পরবর্তীকালে সবাইকে জানাবে যে আমি বিদেশে বিয়ে করেছি। এই সন্তান আমারই। সত্যি কথাটা শুধু তুমি আর মা জানবে। তুমি শুধু মনকে শক্ত কর।”
“তা হয় না মা। আমি আমার বংশের স্বার্থের জন্য তোমার জীবনটা এইভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না, কিছুতেই না, এ অসম্ভব!”
“বাবা তুমি কেন ভাবছ আমর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে? দিদির সন্তানকেই আমি নিজের সন্তান ভেবে মানুষের মত মানুষ করব, তুমি দেখে নিও। এটাই হবে আমার কাছে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। তুমি আর অমত কর না।”
নরেনবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে।
“বাবা এখন তবে আমি আসি?”
“হ্যাঁ, মা তুমি এস। জীবন যুদ্ধে তুমি অবশ্যই জয়ী হবে। তুমি জানবে তোমার মা-বাবার আশীর্বাদ সবসময় তোমার সাথে থাকবে। আর টাকা পয়সা, বা অন্য যা কিছু তোমার দরকার সব তুমি পাবে।”
“ না বাবা, টাকা-পয়সা, বা অন্য কোনও সাহায্য আমার লাগবে না। তোমার মেয়ের উপর তুমি ভরসা করতে পার। আমি ডাক্তারী করে ঠিক আমার সন্তানকে মানুষ করব। যদি কোনদিন কিছু প্রয়োজন হয় আমি নিজেই চাইব।”
অনেক কষ্ট করে যুথিকা মল্লিকাকে রাজি করিয়ে গোপনে কলকাতায় একটা বড় নার্সিং হোমে এনে সব ব্যবস্থা করে। এক বছরের বেশি অতিক্রান্ত। বিদেশ থেকে ফেরার পর মল্লিকার শুভ্রর সাথে বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে ছোট্ট সোনাকে বুকে জড়িয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে পাড়ি দেয় যুথিকা।পুরুলিয়ার এক অখ্যাত লাল মাটির দেশে যুথিকা বাসা বাঁধে। সভ্য সমাজের লোকালয় থেকে অনেক দূরে মানুষ করছে ছোট্ট সোনাকে। নাম রেখেছে- ‘অচেনা’। যুথিকার এখন শুধু পরিচয় অচেনার মা। নিজের সমগ্র সত্তা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে অচেনাকে। যুথিকা মা-বাবা কে পত্র লিখে নিয়মিত অচেনার একটু-একটু করে বেড়ে ওঠার কাহিনী জানায়। নরেনবাবুর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে।
অচেনার এখন পাঁচ বছর বয়স। মল্লিকার মতই গায়ের রঙ পেয়েছে। মাথায় কোঁকড়ানো ঘন চুল, চোখের দৃষ্টিতে বুদ্ধির প্রখরতা। সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে অচেনা। মাঝে মধ্যেই নরেনবাবু আর তার স্ত্রী লুকিয়ে ছোট্ট দাদুকে দেখতে আসে। অচেনার সাথে খেলায় মেতে ওঠে, আর প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে ফিরে যান। যুথিকার এখন পুরো সময় কাটে অচেনাকে নিয়ে, আর গ্রামের অভাবী, অসহায় মানুষগুলোকে প্রাথমিক শিক্ষা ও চিকিত্সার সহায়তা দিয়ে। গ্রামের অসহায় মানুষের কাছে যুথিকা ঈশ্বরের দূত।
একদিন অচেনা স্কুল থেকে এসে মাকে জিজ্ঞাসা করে- “মা আমার তুমি আছো, দাদু- দিদা আছে, তাহলে আমার অন্য বন্ধুদের মত বাবা নেই কেন?”
একটা অজানা ভয় আর শঙ্কা যুথিকাকে গ্রাস করে।
“ তোমার বাবা কাজের সূত্রে অনেক দূরে থাকেন। এখন তুমি অনেক ছোট তাই তোমায় সব বলিনি। তুমি বড় হও সব জানতে পারবে।”
খুশি হয়ে চলে যায় অচেনা।
মল্লিকার বিবাহের পঁচিশ বছর কেটে গেছে ওদের কোনও সন্তান হয়নি। অচেনা ডাক্তারী পড়ার জন্য কলকাতাতে থাকে। কলকাতা থেকে ডাক্তারী পাস করে অচেনা যেদিন ফিরে এল সেদিন আনন্দে যুথিকার চোখ থেকে জল নেমেছে। আজ তার আশা পূরণ হয়েছে। অচেনা এখন কলকাতার এন.আর.এস.মেডিক্যাল কলেজের মস্ত বড় সার্জন। একডাকে পেডিয়াট্রিক সার্জন ডক্টর অচেনা মুখার্জী কে সবাই চেনে। যুথিকা তার নিজের মনকে শক্ত করে। আর নয়, এখনই সময় হয়েছে অচেনাকে সব কিছু খুলে বলার। যুথিকা অচেনাকে কাছে ডাকে।
“ আজ তোমার ছোটবেলার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। তোমার ছোটবেলার সব কিছু জানার পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। কিছুই লুকাবো না তোমার কাছে।”
মাযের মুখ দেখে অচেনা কেমন যেন একটা গভীর আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। মায়ের এমন অস্বাভাবিক আচরণ আগে কখনও দেখে নি অচেনা। কি একটা অজানা আতঙ্ক অচেনাকে গ্রাস করে।
যুথিকা অচেনাকে তার জন্ম-বৃত্তান্তের পুরো কাহিনী শোনায়। কোন পরিস্থিতিতে কেনই বা যুথিকা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে, কেনই বা কুমারী হয়েও সধবার বেশে এই অখ্যাত গ্রামে পড়ে আছে সব।যুথিকা আর মিথ্যার বোঝা বয়ে বেড়াতে চায় না।
যুথিকা বলে-“ তুমি বুদ্ধিমান, তোমাকে এই নিষ্ঠুর সত্যি মেনে নিতেই হবে। যদি মনে কর আমি কোন অন্যায় করেছি তাহলে মা বলে ডাকতে অস্বীকার করতে পার, আমি কোন অভিযোগ করব না। জানব এই আত্মত্যাগের কোন মূল্য নেই সমাজের কাছে, চাইলে তুমি চলে যেতে পার তোমার মাযের কাছে।”
অচেনা অপলক দৃষ্টিতে যুথিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর মা বলে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত আদর করতে থাকে যুথিকাকে। মা-ছেলের এই স্বর্গীয় মিলনের সাক্ষী থাকে শুধু এই সুন্দর পৃথিবী। ইতিমধ্যে নরেনবাবু মারা গেছেন। মরার আগে নিরপরাধ এই মেয়েটিকে একবার শেষবারের মত চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভগবান সেই সুযোগ দেন নি। তবে মৃত্যুর আগেই নরেনবাবু বাড়ির সবাইকে সব সত্যি ঘটনা জানিয়ে গেছেন আর উইল করে গেছেন নিজের হাতে, যাতে এই বিশাল সম্পত্তির অর্ধেক পাবে যুথিকা আর বাকি অর্ধেক পাবে অচেনা। এত কিছু ঘটে গেছে যুথিকা তার বিন্দু-বিসর্গ জানতে পারেনি। এদিকে যুথিকার বুক থেকে একটা ভারী পাষাণ নেমে গেছে। অচেনা তাকে মা বলে মেনে নিয়েছে, এর থেকে বড় পাওনা আর কি হতে পারে? এইভাবেই হাসি-খুশিতে মা-ছেলের দিন কেটে যাচ্ছিল- হঠাত্ একদিন দুপুরবেলায় মল্লিকা আর শুভ্র এসে হাজির। যুথিকা তো ওদের দেখে অবাক! যুথিকা ভেবে পায় না তার ঠিকানা মল্লিকা কি ভাবে জানতে পারল। যাইহোক, যুথিকা ওদের আমন্ত্রন জানায়।
মল্লিকা যুথিকাকে বলে- “আমি বসতে আসিনি। শুনেছিস বোধহয় বাবা মৃত্যুকালে উইল করে অচেনাকে অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে গেছে। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি, তাই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
যুথিকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পৃথিবীটা অকস্মাত্ দুলে ওঠে। যুথিকা জ্ঞান হারায়। ঠিক সেই মূহুর্তে অচেনা ওদের মাঝে উপস্থিত হয়। আড়াল থেকে এতক্ষণ সব কথা শুনেছে সে। অচেনাকে দেখেই মল্লিকা ঝাঁপিয়ে ছেলেকে আদর করতে উদ্যত হয়।
“আমি তোর হারিয়ে যাওয়া মা আর উনি তোর বাবা। ছোটবেলায় একটা সামান্য ভুলের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম তোকে। যুথিকা লুকিয়ে কাউকে না জানিয়ে তোকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কত খুঁজেছি তোকে পাই নি।”
এই মিথ্যাচারে অচেনার সারা দেহ রাগে রি-রি করে ওঠে।
অচেনা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে-“ শুধু জন্মদাত্রী হলেই মা হওয়া যায় না। আমার কাছে তোমরা মৃত। ছি!ছি! শুধু সম্পত্তির লোভে আজ তোমরা আমাকে সন্তান বলে স্বীকার করতে এসেছ? চলে যাও এখান থেকে- আর কোনদিন যেন তোমাদের মুখ না দেখি।” ক্রূর হাসি হেসে মল্লিকা চলে যায়। জ্ঞান ফিরলে অচেনার কাছ থেকে সব কথা শুনে যুথিকা মনে মনে প্রমাদ গোনে। যুথিকা বুঝতে পারে মল্লিকা এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। মল্লিকা ঠিক আইনের আশ্রয় নিয়ে অচেনাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ওর কাছ থেকে। যুথিকা ভাবতে পারে না, শুধু দু-চোখ দিয়ে জল নেমে আসে।
কিছুদিনের মধ্যেই কোর্টে মামলা শুরু হয়। অভিযোগ গুরুতর- মেয়ের কাছ থেকে ছেলে চুরি। ইতিমধ্যে যুথিকা লক্ষ্য করে অচেনা ও কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। যুথিকাকে দেখে যেন চিনতেই পারছে না। কোর্টে হেসে হেসে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, যেন কত দিনের পরিচিত। যুথিকা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর অচেনা যুথিকাকে জানায় সে বাবা-মায়ের সাথে সিমলা বেড়াতে যাচ্ছে। যুথিকা কোনও উত্তর দিতে পারে না। মনে মনে ভাবে এই শাস্তিই বোধহয় তার প্রাপ্য ছিল। তবে তাই হোক, সে আর নিজে কেস লড়বে না। নিয়ে যাক মল্লিকা তার সন্তানকে! অচেনা যদি তার মাকে ফিরে পেয়ে সুখী হয়, তার চেয়ে আনন্দের কি থাকতে পারে? যুথিকা অচেনাকে হাসিমুখে বিদায় দেয়।
এক সপ্তাহ পর সংবাদপত্রের একটা ছোট্ট খবরে যুথিকার দৃষ্টি পড়ে শিউরে ওঠে। খবরে প্রকাশ- সিমলা বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ের খাদে পড়ে এক বাঙালি পরিবারের দুজনের মর্মান্তিক মৃত্যু। ক্যাপসন এ মল্লিকা ও শুভ্রের ছবি। সংবাদে আরও প্রকাশ এই দুর্ঘটনায় তাদের একমাত্র পুত্র সামান্য আহত হয়ে সিদ্ধি বিনায়ক হাসপাতালে ভর্তি। যুথিকা ভয়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে। সারা পৃথিবীটা তার কাছে অন্ধকার হয়ে যায়। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যুথিকা পাগলের মত হাসপাতালে ছুটে যায়। তারপর অচেনাকে দেখতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে। দুদিন পর অচেনা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। যুথিকা হাসপাতাল থেকে ছেলেকে আনতে গিয়ে দেখে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে আছে মা আর নায়েবমশাই। যুথিকা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। নায়েবমশাই যুথিকা ও অচেনাকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে।
বলে-“মা তোমার কোন চিন্তা নেই, আমরা তোমাদের সব ঘটনা জানি। তোমার বাবা মৃত্যুর আগে পরিবারের সকলকে সব জানিয়ে গেছেন।”
গভীর রাত, জমিদার বাড়ির সকলেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে শুধু ঘুম নেই যুথিকার চোখে। সপ্তাহখানেক আগে ঘটে যাওয়া অচেনার অদ্ভুত আচরণের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না যুথিকা। তার কাছে জীবনটাই যেন উলট-পালট হয়ে গেছে। কি হবে আর এই পৃথিবীতে থেকে। ছেলেই যদি পর হয়ে যায় তাহলে তার আর বেঁচে থেকে লাভ কি? ঠিক সেই মূহুর্তে যুথিকার ঘরে অচেনা প্রবেশ করে। যুথিকা চমকে উঠে বসে!
“তুমি এখনও ঘুমাওনি মা?”
সেই মধুর মা-ডাক! যুথিকার সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আচমকা অচেনা তার মাকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত চুম্বন করতে থাকে। বলে-“মা তোমায় আমি একটা কঠিন সত্য জানাতে এসেছি, যেটা এই পৃথিবীতে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ কোনদিন জানবে না। জানিনা সব শোনার পর তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে কিনা? যদি ক্ষমা করতে না পার আমি নিজেই কোর্র্টে আত্মসমর্পন করব।”
একটা অজানা আতঙ্ক ও শঙ্কা যুথিকাকে গ্রাস করে। যুথিকার হৃদস্পন্দন বেড়ে চলে।
এদিকে অচেনা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে দিয়ে বলে চলে-
“আমি নিজের হাতে চিরদিনের জন্য মা-বাবাকে নিষ্কৃতি দিয়েছি। ঠেলে ফেলে দিয়েছি পাহাড় থেকে। আর কেউ কোনদিন তোমার কাছ থেকে আমায় কেড়ে নিতে পারবে না।”
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে অচেনা। যুথিকার কাছে প্রতিটি ঘটনা এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। ছেলের মাথায় হাত দিয়ে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করে যুথিকা।
“মা তুমি কি আমার এই অপরাধ ক্ষমা করতে পারবে?”
যুথিকা দৃঢ়ভাবে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ঘড়িতে তখন দুটোর ঘন্টা বাজছে।
----*----
রচনাকাল : ২০/১২/২০২০
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।