চাওয়া-পাওয়া
রূপক ঘোষ
গ্রীনপার্ক
প্রশান্তের পিতা রাধরমণবাবু তখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। বালিগঞ্জে দোতলা বাড়ি। বাড়ির চারিদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আনুমানিক চার কাঠা জমির উপর বাড়িটা। বাড়ির সামনে বাহারি মরসুমী ফুলের বাগান। পাঁচিলের কোল ঘেঁষে পাম ও সুপারি গাছগুলো মাথা উঁচু করে যেন গৃহস্বামীর স্বচ্ছলাবস্থার জানান দিচ্ছে। বাড়ির ঠিক পিছনেই বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে সবজি বাগান। কি নেই সেখানে! পালংশাক থেকে শুরু করে লংকা,টমাটো,কপি কতকিছু হয়ে আছে।
রাধরমণ রায়ের পরিবারে থাকার মধ্যে আছে স্ত্রী ললিতা দেবী আর একমাত্র পুত্র প্রশান্ত। ললিতাদেবীর বয়স প্রায় ছত্রিশ বছর। গায়ের রঙ ফর্সা,লম্বা চেহারা, ঘন একরাশ চুল। সর্বোপরি সারা মুখে ছড়িয়ে আছে একরাশ লাবণ্য। প্রশান্ত দশম শ্রেণীর ছাত্র এবং অত্যন্ত মেধাবী। কোনোদিনই ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয় নি। মাথায় একরাশ ঘন চুল, দোহারা চেহারা, মুখে এক অদ্ভুত সারল্য। প্রশান্তের চোখে ছিল এক অসীম গভীরতা। এ হেন প্রশান্তের প্রেমে আমি যে পড়ব তাতে আর সন্দেহ কি?
আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। পরিবারে আমার বাবা শ্রী বিনয় চক্রবর্তী ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারে আর থাকার মধ্যে আমরা তিনজন- মা, আমি আর আমার বোন রমা। রমা ভারী মিষ্টি মেয়ে। রোগা-পাতলা চেহারা, ফর্সা, টিকালো নাক আর একরাশ ঘন কোঁকড়ানো চুল। রমা ছিল অসম্ভব চঞ্চল। রমার বয়স তখন তের। সুশীলা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। আমার বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে দশটা-পাঁচটার চাকরি করে কোনরকমে আমাদের ভরণ পোষণ চালান। আমার মা ছিলেন মৃদুভাষী এবং শান্ত স্বভাবের। তিনি অতি কষ্টে-সৃষ্টে সংসারটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের বাড়ি থেকে প্রশান্তদের বাড়ি হাঁটা পথে দশ মিনিট। আমরা থাকতাম ভাড়া বাড়িতে। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে অবস্থার পার্থক্য থাকলেও দুই পরিবারের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রশান্ত প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়ি আসত। আমার মা প্রশান্তকে কোনদিন নারকেল-মুড়ি,কোনদিন চানাচুর–মুড়ি আবার কোনদিন হাতে তৈরি নাড়ু-মুড়ি খেতে দিত। ও যে কি তৃপ্তি সহকারে খেত না দেখলে বোঝাই যাবে না। প্রশান্ত ছিল আমার বোনের খেলার সাথী। কিন্তু হলে হবে কি – প্রতিদিনই কিছু না কিছু বিষয়ে দুজনের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকত। কখন প্রশান্ত অকারণে রমার চুল ধরে টান দিত আবার কখন বা রমার প্লেট থেকে নাড়ু তুলে নিজের মুখে পুরে নিত। রমাও তখন প্রশান্তকে কিল-চড় কষিয়ে দিত কিংবা অভিমানে ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে বসে থাকত। প্রশান্তকেই আবার অনেক সাধ্যি-সাধনা করে রমার সাথে ভাব করে নিতে হত। আসলে প্রশান্ত আর রমার মধ্যে ওদের অজান্তেই একটা ভালোবাসার জগৎ গড়ে উঠেছিল। যে জগতে কোন পাপবোধ ছিল না। এ ভালোবাসা ছিল গঙ্গার জলের মতই পবিত্র এবং ফুলের মতই সুন্দর। এইভাবেই আমাদের দিনগুলো আনন্দে কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ প্রশান্তের বাবার হার্ট-অ্যাটাক হয়ে গেল। ধরাধরি করে ওনাকে কোলকাতার বড় হাসপাতালে ভর্তি করে ওপেন হার্ট সার্জারি করা হল। আপ্রাণ চেষ্টা করা হোল সুস্থ করে তোলার। কিন্তু কিছুই হল না- সকলকে কাঁদিয়ে, পরিবারকে ভাসিয়ে দিয়ে অকালেই চলে গেলেন রাধরমণবাবু।
এই আকস্মিক আঘাতে প্রশান্তের মা একেবারে পাথর হয়ে গেলেন। সঞ্চিত টাকা কমতে কমতে এক সময় আর্থিক অনটন শুরু হল। ইতিমধ্যে প্রশান্তের মা ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। প্রশান্ত তখন প্রায় পাগলের মত, দিশেহারা অবস্থা। অভাবের তাড়নায় একসময় বাড়ি বিক্রি করে প্রশান্তরা গ্রামে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠল। ইতিমধ্যে প্রায় বছর খানেক কেটে গেছে, আমাদের বাড়িতেও প্রশান্তের আসা প্রায় কমে গেছে। রমা এখন চুপচাপ, গম্ভীর। স্কুলেতে আমার সাথে প্রশান্তের দেখা হলেও কেন জানি না এড়িয়ে যেত। আজ প্রায় দু বছর হতে চলল প্রশান্ত আর আমাদের বাড়ি আসে নি, কোনরকম যোগাযোগও করে নি।
এরপর হঠাৎ একদিন প্রশান্ত আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। উষ্কখুষ্ক চেহারা, কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব- চোখের কোলে কালি, মুখে বিষাদের ছায়া। আমি দেখেই চমকে উঠলাম। বললাম-“একি চেহারা হয়েছে তোর?”
প্রশান্ত মলিন হেসে বলল –“না বাবলুদা ও কিছু নয়। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।”
“কথা পরে হবে- আগে শান্ত হয়ে বোস, রমা তোকে দেখলে খুব খুশী হবে।”
কিন্তু প্রশান্ত কিছুতেই বসতে চাইছিল না। বাধ্য হয়ে আমি ওর আসার কারণ জানতে চাইলাম। এরপর প্রশান্ত যা বলল তার সারমর্ম হল –এই মূহুর্তে ওর পক্ষে লেখা-পড়া চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব কারণ সংসার চালানো এবং মায়ের চিকিত্সার খরচ চালানোর জন্য যে ভাবেই হোক উপার্জন করতেই হবে। তাই যদি সম্ভব হয়, আমি যেন আমার বাবাকে বলে ওর জন্য একটা ছোটখাটো কাজের ব্যবস্থা করে দিই। আমি হতবাক হয়ে প্রশান্তের মুখের পানে তাকিয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে একটা অসহ্য যন্ত্রণা ঠেলে ঠেলে উঠছে, কিন্তু কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে।
তবুও অনেক কষ্ট করে বললাম-“তোর কোনমতেই পড়াশুনা বন্ধ করা চলবে না। যে ভাবেই হোক কষ্টেসৃষ্টে পড়াশুনা চালিয়ে যেতেই হবে। তোরমত ব্রিলিয়াণ্ট ছেলের ভবিত্ষ্যত এইভাবে তলিয়ে যেতে পারে না।”
“না বাবলুদা, এখন আর তা কোনমতেই সম্ভব নয়; উপার্জন না করতে পারলে মা বিনা চিকিত্সায় মারা যাবে।”
”ঠিক আছে ও সব চিন্তা পারে করা যাবে। এখন তুই আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম কর।”
আমি তাড়াতাড়ি মা আর রমাকে ডাকলাম- বললাম তোমরা দেখে যাও আমাদের বাড়িতে আজ কে এসেছে। দুজনেই দৌড়ে এসে প্রশান্তকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মা তো প্রশান্তকে জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন আর রমা কেমন যেন পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল আর চোখ থেকে বৃষ্টির মত ঝরে পড়ল অশ্রুধারা।
রমা ছুটে পালিয়ে যেতে যেতে বলল –“হে ভগবান তুমি এত নিষ্ঠুর? এত নির্মম? এত বড় শাস্তি তুমি ওকে কেন দিলে?”
ঠিক সেই মূহুর্তে বাবা প্রবেশ করলে আমি বাবাকে প্রশান্তের সব বিপদের কথা খুলে বললাম। বাবা প্রশান্তকে স্নেহভরে ডাকলেন।
তারপর বললেন-“আচ্ছা প্রশান্ত তুমি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাওতো- যদি এই একই ঘটনা আমাদের পরিবারে ঘটত আর বাবলু ঠিক একই ভাবে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে দাঁড়াতো তোমরা কি করতে?”
প্রশান্ত নির্বাক- কোন উত্তর দিতে পারে না।
বাবা বললেন-“আজ থেকে তোমাদের সব দায়িত্ব আমার। এখন খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম কর আর শান্তভাবে বাড়ি ফিরে মনকে সংযত করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার অঙ্গীকার কর। ভুলে যাও সব অতীত- মনে কর তোমার জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি। ভবিত্ষ্যতের দিকে তাকাও, এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখ, তবেই পাবে জীবনের সার্থকতা।”
প্রশান্ত সম্মোহিতের ন্যায় পথে নামে – শপথ নেয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলার। তাকে মায়ের জন্য আর রমার জন্য এই যুদ্ধে জিততেই হবে।
সময় এগিয়ে চলে- আজ প্রশান্ত মুম্বাই আই.আই.টির একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার। নিজের কর্মদক্ষতা আর প্রচেষ্টার জোরে মুম্বাইতে এক বিশাল টেক্সটাইল কোম্পানীর মালিক। বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তারিত হয়েছে কোম্পানীর বিভিন্ন শাখা। সব রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দু হাজার কর্মচারী কাজ করে। মুম্বাইয়ে প্রশান্তের রয়েছে দুটি সুবিশাল ফ্ল্যাট আর কয়েকটি বিলাসবহুল দামী গাড়ি। প্রশান্তের মা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এই সব ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানে না রমা কারণ প্রশান্ত আমায় বারণ করেছিল এইমুহুর্তে কোনকিছু না জানাতে। আমি নিজে একটা প্রাইভেট কোম্পানীর অডিটর। সর্বসাকুল্যে মাইনে চল্লিশ হাজার টাকা।
রমা এখন চব্বিশ বছরে পা দিয়েছে। সারা শরীরে যৌবনের ছাপ সুপষ্ট। মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত কোমলতা, চোখের দৃষ্টিতে গভীরতার ছাপ। কিন্তু খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে মুখের উপর একটা বিষন্নতার আভাস পাওয়া যায়। রমা এই বছরই এম.এস.সি.তে প্রথম শ্রেণী পেয়ে পাস করে হন্যে হয়ে চাকরির চেষ্টা করছে। বাবা এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাই আমিও রমার বিয়ের জন্য খুব চিন্তিত; যে ভাবেই হোক একটা উপযুক্ত পাত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। ইতিমধ্যে প্রশান্ত অনেকবার আমাকে মুম্বাই যেতে বলেছে। প্লেনের টিকিটও পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি সময় করে উঠতে পারিনি। এছাড়া আরও যেতে চাইনি কারণ যদি রমা জানতে পারে। অভিমানে প্রশান্ত এখন আর খুব একটা যোগাযোগ রাখে না। এখন প্রশান্তের খবর ও খুব একটা পাই না। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে একটু তন্দ্রামত এসেছিল জানি না। রমার চিত্কারে ঘুম ভেঙে গেল। রমার চোখে-মুখে যুদ্ধ জয়ের চিহ্ন।
আমি বললাম-“এত উচ্ছাস কেন?”
রমা বলল-“দাদা মুম্বাই এর একটা কোম্পানী আমাকে ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছে- ভালো মাইনে।"
”আমি বললাম- “সে না হয় বুঝলাম কিন্তু পোস্টিং কোথায় হবে?”
“পোস্টিং কোথায় হবে জানায় নি, তবে শুনেছি কলকাতাতে ওদের অফিস আছে।”
“ইন্টারভিউ কবে?”
“১৪ই আগস্ট মুম্বাইতে।”
“সে কি? আজই তো ১২ই আগস্ট তাহলে যাবি কি করে?”
“দাদা তোমায় বলা হয় নি, কোম্পানী আমার যাতায়াতের এয়ার ফেয়ার আর ওখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।”
“তা না হয় হল, বিদেশ-বিভুঁই, তুই এক যাবি কি ভাবে?”
“তুমি কিছু চিন্তা কর না, আমি ঠিক চলে যাব। তুমি বরং মা-বাবাকে চিন্তা করতে বারণ কর।”
“ আচ্ছা রমা, মুম্বাইতে তো প্রশান্ত থাকে ওকে খবর দিলে হয় না, ও একটা ব্যবস্থা ঠিক করে দিত।”
“প্রশান্ত মুম্বাইতে থাকে এ কথা তো আমায় কখন বল নি। তা যাক, এখন প্রশান্তকে জানিয়ে বিরক্ত করার দরকার নেই।”
এই বলে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনের গভীরে কেন জানি না একটা শিহরণ খেলে গেল।
রমা মুম্বাই এয়ারপোর্ট পৌঁছে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। এই প্রথম সে বাড়ির বাইরে পা রেখেছে। কাজেই রাস্তা-ঘাট সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই। কি ভাবে সে বান্দ্রা ওয়েস্ট গিয়ে অফিস পৌঁছবে এই চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এখন মনে হল দাদার কথা শুনে প্রশান্তকে খবর দিলেই বোধহয় ঠিক হত। সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে রমা কখন কি ভাবে যে বিমান বন্দরের বাইরে বেরিয়ে এল নিজেও ঠিক ঠাওর করতে পারল না। এখন কি ভাবে সে কোন বাস ধরে ঠিক সময়ে গন্তব্যস্থল পৌঁছবে এটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েই চমকে গেল। দেখল তারই নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে একজন সুন্দর যুবক বাইরে প্রতীক্ষা করছে। রমার হঠাৎ মনে পড়ল কল লেটারে এইরকম একটা ব্যবস্থার কথা লেখা ছিল বটে! সে নিজেই ঠিক ভাবে গুরুত্ব দেয় নি। দোষটা তার নিজেরই। যাই হোক রমার বিস্ময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। রমা অবচেতন ভাবে যুবকটির দিকে এগিয়ে গেল। রমা কাছে আসতেই ওই সুদর্শন যুবাটি রমা কে নমস্কার করলে রমাও প্রতি নমস্কার করে। এরপর যুবকটি রমাকে একটি দামী গাড়ির দিকে আসার অনুরোধ করে। রমার বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটে নি। তারমত একজন মামুলি চাকুরীপ্রাথীর জন্য এত ব্যবস্থা! না, রমা আর ভাবতে পারে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে-
বেশ কিছুক্ষন যাবার পর রমা সসঙ্কোচে যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করে-“ কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? আজ কতজন পরীক্ষার্থী বলতে পারবেন?”
যুবকটি নিন্মস্বরে উত্তর দেয়- “ঠিক জানি না ম্যাডাম, এটা কোম্পানীর গোপন ব্যাপার।”
রমা আর কথা বাড়ায় না।
অবশেষে কোম্পানীর ফটকে এসে গাড়ি থামে। রমা ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে। সুদৃশ্য মার্বেল দিয়ে অফিসটা মোড়া। গেটের একদম উপরে মার্বেলের উপর পিতল নির্মিত অক্ষরে লেখা আছে- ‘আর.সি.টেক্সটাইলস ইনডাস্ট্রিজ’। ভিতরে ঢুকতেই দারোয়ান সেলাম ঠোকে। যুবকটি তাকে গেস্ট রুমে যাবার জন্য অনুরোধ করে। বলে- ম্যাডাম আপনি এতটা পথ জার্নি করে এসেছেন, তাই আগে কিছুটা বিশ্রাম করুন তারপর যথাসময়ে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হবে। কোম্পানীর ভিতরে সাজানো পার্ক, সামনেই সুদৃশ্য ফোয়ারা, নুড়ি দিয়ে বাঁধানো পথ সরাসরি পার্কের কাছে চলে গেছে। রমাকে গেস্ট রুমে বসিয়ে যুবকটি অন্তর্হিত হয়। গেস্ট রুমে বিশাল বিশাল সোফা, দেওয়ালে দামী দামী পেন্টিং, জানালাতে ভারী ভারী দামী পর্দা, পাশেই বোধহয় লাইব্রেরী। কিছুটা দূরে অফিস ক্লাব। ক্লাবের মধ্যে টেবল-টেনিস, ক্যারাম বোর্ড দেখা যাচ্ছে। রমার চোখের পাতা পড়ছিল না।
কিছুক্ষন পরেই যুবকটি আবার প্রবেশ করে- এক হাতে সুদৃশ্য ট্রে অপর হাতে বোন চায়নার প্লেট। ট্রেয়ের মধ্যে এক গ্লাস ফলের রস আর প্লেটে সলটেড কাজু, ভুজিয়া, দামী বিস্কুট আর সন্দেশ। এইসব দেখে রমার মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না। খাবার কথা সে ভুলেই গেল। কিছুক্ষন পর কোট-প্যান্ট পরিহিত এক সুবেশী ভদ্রলোক তাকে ইন্টারভিউর জন্য আমন্ত্রণ জানাল। মন্ত্রমুগ্ধের মত রমা চলছে ঐ ভদ্রলোকের পিছু-পিছু। বড়-বড় স্বয়ংক্রিয় কাঁচের দরজা, সামনে আসলেই খুলে যাচ্ছে। রমার দৃষ্টি যায় কাঁচ দিয়ে ঘেরা পাশের ঘরগুলোতে, যেখানে তারই বয়সী বেশ কিছু ছেলে মেয়ে বড় বড় মেসিনে কি সব কাজ করছে।
অত:পর রমা দুরু-দুরু বক্ষে ইন্টারভিউ কক্ষে প্রবেশ করে। এই ঘরটিও দামী কাঁচ দিয়ে ঘেরা। ঘরের মধ্যে আধুনিক আসবাবপত্র, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল ঘরে কোন লোক নেই। ভয়ে রমার হাত-পা ক্রমশ: অবশ হয়ে আসছে। মনে মনে ভাবে এ কোথায় এসে পড়ল সে? মাথার মধ্যে একরাশ দুশ্চিন্তা জড়ো হল। দাদার কথাই ঠিক। এইভাবে একা-একা আসা একদম উচিত হয় নি। অকস্মাৎ পাশের ঘর থেকে মাইক্রোফোনে একটা গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এল।
“গুড আফ্টারনুন- আশা করি এখানে আস্তে কোন অসুবিধা হয় নি।”
রমা উত্তর দেবে কি! ভয়ে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঢক-ঢক করে সামনের টেবিলে রাখা এক গ্লাস জল পান করে একটু যেন মনের জোর পেল। করুণ কন্ঠে বলল “না”।
“বেশ তাহলে আমাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করা যাক। প্রথমেই বলে নিই বয়েসে আমার থেকে আপনি ছোট, তাই তুমি বলে সম্বোধন করলে কোন আপত্তি আছে কি?”
“না।”
“বেশ তোমার নাম?”
“রমা চক্রবর্তী।”
“কোন কলেজ থেকে এম.এস.সি. করেছ?”
“প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে।”
“টেক্সটাইল সম্বন্ধে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে?”
“না।”
“পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোন হবি?”
“গল্পের বই পড়তে ভালবাসি।”
“তোমাকে এখানে যে কাজের জন্য নিয়োগ করা হবে সেই কাজের ধরণ কি তুমি জান?”
“না।”
“এই কোম্পানীর যিনি মালিক তার দেখভাল করতে হবে।”
রমার বুক চিরে একটাই কথা বেরিয়ে আসে –“এর অর্থ?”
ঘরের ওপাশে থাক মানুষটি স্মিত হেসে বলে-“ব্যাপারটা তুমি যা ভাবছ তা নয়, আমি বলতে চেয়েছি তোমায় কোম্পানীর মালিককে প্রতি পদে-পদে সাহায্য করতে হবে, তার চিন্তা-ভাবনার শরিক হতে হবে- পারবে না?”
রমা বলল- “শিখিয়ে দিলে অবশ্যই পারব।”
“বেশ, পরের প্রশ্ন- ধর যদি তুমি নির্বাচিত হও, তাহলে এই মুম্বাইতে তোমায় থাকতে হবে। তুমি রাজি আছো তো?”
“আমায় ভাবার একটু সময় দিতে হবে স্যার।”
“ঠিক আছে, তুমি পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলে আমায় আজই জানাবে।”
রমা সম্মতি দিল।
“আমার শেষ প্রশ্ন- তুমি কি কোনদিন কাউকে ভালোবেসেছ?”
রমার সারা শরীরে প্রশান্তের কথা চিন্তা করে একটা শিহরণ খেলে যায়। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে বলে-“আমার জানা নেই।”
“মিথ্যা বলার চেষ্টা কর না। আধুনিকা মেয়ে তুমি! কাউকে ভালোবাসোনি এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?”
রমা উত্তর দেয়-“বিশ্বাস করা বা না করা আপনার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি মিথ্যা বলিনি। ছোটবেলাতে একজনকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতাম। আজও তাকে ভালোবাসি। সে ছিল আমার বন্ধু, আমার বড় আপনার। সে ছাড়া আমার জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই। সে আলো আমি তার ছায়া। কিন্তু জীবনের ঠিক সময়ে আমি আমার মনের কথা তাকে বলতে পারি নি। সেও আমায় কোনদিন ভালোবেসেছিল কিনা জানার সুযোগ হয় নি, আর ভবিষ্যতেও জানতে পারব কিনা বলতে পারব না। কাজেই আপনি যে অর্থে ভালোবাসার কথা বলছেন সেই অর্থে যৌবনে কোনও কিছু ঘটেনি।”
“তিনি এখন কোথায়?”
“ এতদিন জানতাম না। এখানে আসার আগে দাদার কাছ থেকে জানতে পারি সে মুম্বাইতে থাকে। কিন্তু আমি তার ঠিকানা জানিনা।”
“আমি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে পারি শুনবে?”
“শোনার মত হলে অবশ্যই শুনবো- আপনি বলুন ”
“তুমি যখন জানোই না সে তোমায় আদৌ ভালোবাসে কিনা- সেক্ষেত্রে আমায় গ্রহণ করতে তোমার কোনও আপত্তি আছে? আমায় গ্রহণ করলে এই বিশাল সাম্রাজ্যের মালকিন হবে তুমি।”
রমা সোফা থেকে বিদ্যুত্গতিতে ছিটকে ওঠে। সুতীব্র চিত্কারে বলে- “ছি:ছি:! মেয়েদের এইরকম অসম্মান এবং এরূপ অপমানজনক কথা বলতে আপনার রুচিতে বাধলো না? এই ছিল আপনার মনে? ইন্টারভিউর নাম করে আমাদের মত সাধারণ গরীব মেয়েদের ডেকে এই জাতীয় প্রস্তাব করতে রুচিতে বাধে না? আপনি হলেন শিক্ষিত ভদ্রবেশী কাপুরুষ, মেয়েদের মুখোমুখি হবার সত্সাহস আপনার নেই, তাই এই গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন। আপনাদের মত শিক্ষিত ধনী মানুষদের আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি। বিশ্বাস করুন- সত্যি বলছি, ঘৃণা করি। আচ্ছা ধন্যবাদ।”
-রমা বেরতে উদ্যত হয়।
পাশের ঘর থেকে মানুষটি হাসতে-হাসতে আবার বলে ওঠে- “ওই লোকটির প্রতি তোমার এত ভালোবাসা! তুমি তো জানই না ওই মানুষটি তোমায় ভালোবাসে কিনা? এমনও তো হতে পারে সে জীবনে অন্য কোন মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে সংসার করছে। আর আমি সরাসরি তোমায় ভালবাসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি তাকে তুমি প্রত্যাখান করছ?”
রমা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে- “আমি আপনাকে চোখে দেখিনি। কোনদিন দেখতেও চাই না। হতে পারে আপনার অর্থ আছে, সমাজে প্রতিপত্তি আছে, তবুও জানবেন আমি আপনাকে স্রেফ করুণা করি। আমদের মত মেয়েরা জীবনে একবারই ভালোবাসে আর আমৃত্যু তাকে নিয়েই বাঁচতে চায়; হতে পারে সে হয়ত আমায় ভালোবাসে না। তবু জানবেন আমি তাকেই এখনও মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। আজীবন কুমারী থাকব তবুও অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে পারব না। আপনার হাজার প্রলোভন আমার অন্তর থেকে শত চেষ্টা করেও তাকে মুছে ফেলতে পারবে না। যাক! আপনি আমার কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন না। আপনারা অর্থের মাপকাঠিতে ভালোবাসা কিনতে চান। আমার কাছে আপনি নি:স্ব, এক কানা-কড়িও দাম নেই আপনার। আচ্ছা নমস্কার। আমি এখন উঠি। আমায় কোলকাতা ফিরতে হবে। কথা দিছি, বাড়ি গিয়ে যে ভাবেই হোক আমি আপনার দেওয়া যাতায়াতের ভাড়া পাঠিয়ে দেব।”
“আমায় অস্বীকার করে তুমি কলকাতা ফিরে যাবে ভেবেছ? আমি এত কষ্ট করে তোমায় ফাঁদে ফেলে এখানে নিয়ে এসেছি ফিরে যাবার জন্য? এখানে আমি তোমাকে জোর করে আজীবন বন্দী করে রাখব, দেখি তুমি কি করতে পার।”- বলেই অট্টহাস্য করে ওঠে। রমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে। এ হাসি যেন তার বহু দিনের চেনা। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? না-না এ হতে পারে না এটা মনের ভুল! ঠিক সেই মূহুর্তে পাশের ঘর থেকে মানুষটি বেরিয়ে এল- দুজনে মুখোমুখি।
“ কেমন আছো রমা? এতদিন পরে আমায় চিনতে পারছ?”
রমার মুখটা কাগজের ন্যায় সাদা হয়ে গেছে, মনে হয় কে যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। রমা নির্বাক! রমার চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে, রমা যেন ক্রমশ মনের অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে বার হয়ে আসছে। না- আর সহ্য করতে পারল না, রমা ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ে।
বেশ কিছুক্ষন পর যখন রমার জ্ঞান ফিরল তখন দেখল তার মাথাটা প্রশান্তের কোলে। প্রশান্ত তার চুলের মধ্যে পরম স্নেহে বিলি কেটে দিছে। চারিদিকে উত্সুক মুখ। লজ্জায় রমা উঠে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু দুর্বল শরীর তাই আবার প্রশান্তের কোলে ঢলে পড়ল। শান্তি! কি পরম শান্তি! আবেশে রমার দু-চোখ বুজে আসে। চোখ থেকে নেমে আসে আনন্দাশ্রু।
“রমা”
“কি”
“তুমি খুব ভয় পেয়েছিলে না?”
“হ্যাঁ, তা পেয়েছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছিলাম।”
“এখন আর কষ্ট নেই তো?”
“না নেই, সরো উঠতে দাও, তোমার অফিসের সকলে আমায় দেখছে, আমার লজ্জা করছে।”
“লজ্জা পাবার কিছু নেই; ওরা এই কোম্পানীর মালকিন কে দেখছে। আজকের নাটকের ওরাও কুশীলব। তোমায় যে ছেলেটি আনতে গিয়েছিল তার নাম রথীন, আমাদের কোম্পানীর ম্যানেজার। আর এই পুরো আইডিয়াটা ওরই মস্তিষ্কপ্রসূত।”
এবার রমার কাছে সব ঘটনা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন বুঝতে পারে কেন সকলে এখানে আসার পর থেকে তাকে এত সম্মান করছিল, কেনই বা সকলে ওর পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। সত্যিই! কি বোকা আমি; মনে মনে ভাবে।
“তুমি কিন্তু এখনও খুব বোকা আর সাধসিধেই রয়ে গেলে। আমি ভেবেছিলাম আসার সময় বাইরে কোম্পানীর নাম দেখে কিছু একটা আন্দাজ করবে।”
“কেন বলত? কি অনুমান করব?”
“কেন- আর.সি.টেক্সটাইল ইনডাস্ট্রিজ।”
এবার রমার কাছে নামের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে- রমা চক্রবর্তী টেক্সটাইল ইনডাস্ট্রিজ।
রমা এবার লজ্জা পেয়ে প্রশান্তের বুকে মুখ লুকায়।
“চল, আমার বাড়ি চল; বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।”
“সবাই বলতে? রমা অবাক হয়।”
“সবাই বলতে আমার মা, তোমার মা-বাবা আর তোমার প্রাণের অধিক দাদা"।
“ওরা এখানে কেন এল?"
“ এখনও বুঝতে পারলে না? তোমাদের বাড়ির সকলকেই আমি আমার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম। ওনাদের আমাদের বিয়েতে কোন অমত নেই। তাই তোমার সাথে সাথে ওনারাও এখানে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। এখন বাড়ির সকলেই শুধু তোমার সম্মতির অপেক্ষায় আছে।”
“দুষ্টু কোথাকার! মেয়েদের মনের কথা কি কেউ এইভাবে জানে? এখন তো তুমি আমার মনের কথা সবই চুরি করে জেনে নিয়েছ।”
প্রশান্ত হেসে ওঠে-
“জানো, আমার খুব লজ্জা করছে- না জেনে তোমায় কত ছোট-বড় কথা বলেছি বলত?”
প্রশান্ত হেসে বলে- “এইজন্যই তো তোমার শাস্তি পাওনা আছে।”
“কি শাস্তি?”
“চাকরির শর্ত অনুযায়ী চিরদিনের জন্য তোমায় এখানে আমার দেখভাল ও সেবা করতে হবে।”
“যাও দুষ্টু কোথাকার!”
চারহাত এক হয়ে গেছে। অন্ধকার ঘরে দুটি নারী-পুরুষ পাশাপাশি শুয়ে আছে। এটা তাদের জীবনের এক পরম মুহূর্ত। মুখে কোন কথা নেই- আছে শুধু অনুভুতি, যার প্রকাশ শুধু অন্তরেই।
-----*-----
রচনাকাল : ১৩/১২/২০২০
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।