সুপ্ত প্রেম
রূপক ঘোষ
গ্রীনপার্ক
মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে আমি আসানসোল থেকে একা একা এসে যাদবপুর বিদ্যাপীঠে ভর্তি হলাম। আমার চিরদিনই ইচ্ছা ছিল কলকাতায় থেকে পড়াশুনা করার। আমার বাবা-মা আসানসোলেই থাকেন। প্রথম যেদিন আমাদের স্কুল খুলল,সেদিন আমাদের ক্লাসে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ জন ছাত্র-ছাত্রী। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাথে পরিচয় করছে- কে কোথা থেকে এসেছে, মাধ্যমিকে কে কত মার্কস পেয়েছে এইসব মামুলি কথা-বার্তা আর কি! আমি আসানসোল টাউনের মধ্যে মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ মার্কস পেয়েছিলাম। দু-একদিনের মধ্যেই আমাদের ক্লাসের একটি ছেলের সাথে আমার বেশি ভাব হল- নাম সমীর চক্রবর্তী। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি খেলাধুলাতেও চৌকস। তবে ধনী পরিবারের ছেলে তাই বোধহয় কিছুটা উগ্র স্বভাবের। বাবা হাইকোর্টের বিচারপতি। গড়িয়াহাটে বিশাল বাড়ি। গরমের ছুটিতে সমীর আমায় ওদের বাড়ি নিয়ে গেল। সমীরের মা আমায় অনেক যত্ন করলেন, বাড়িতে কে কে আছে সেসব জিজ্ঞান্সা করলেন।
আমি বললাম-“আমার নাম কল্লোল দত্ত। বাবা কোলিয়ারীতে চাকরি করেন আর মা গৃহবধূ। আমার আর কোনও ভাই-বোন নেই।”
দিনে দিনে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ক্রমশ: গাঢ় হল। গরমের ছুটির পর যেদিন আমাদের প্রথম স্কুল খুলল, সেদিন আমাদের ক্লাসে একজন নতুন মেয়ের আগমন হল। আমাদের ক্লাস টিচার সুশীলবাবু মেয়েটির সাথে ক্লাসের সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেয়েটির নাম শিপ্রা বসু।
আমি চিত্রার্পিতের ন্যায় মেয়েটি কে লক্ষ্য করলাম। চুম্বকের ন্যায় মেয়েটির যৌবনোচ্ছল দেহের একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। ফর্সা, লম্বা, একরাশ ঘন চুল কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত। চোখের দৃষ্টি স্বভাবতই গর্বিত। এক কথায় রূপের সীমা নেই। আমি সহসা মাথা নিচু করে নিলাম কারণ এইসব মেয়ে বুদ্ধি আর সংযম কে অতি সহজেই বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। কয়েকদিন পর সমীরের থেকে জানতে পারলাম মেয়েটির আদি বাড়ি বেনারস। বাবার বদলির চাকরি তাই আপাতত: যাদবপুরে একটা বিশাল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। বাবা দক্ষিণ পূর্ব রেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। বাড়িতে থাকার মধ্যে মা, মেয়ে আর আছে দুজন সর্বক্ষনের কাজের লোক ও ড্রাইভার রতন সিং। আমি প্রথম থেকেই শিপ্রাকে এড়িয়ে চলতাম। বড়লোকের দুলালী; গাড়িতে করে যাতায়াত করে তাই বোধহয় চালচলনই আলাদা। যদিও সমীরের সাথে শিপ্রার ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বেড়েই চলেছিল।
এইভাবেই চলছিল- কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাদের ক্লাসে একটা অবাক করা ঘটনা ঘটল। ঘটনার সূত্রপাত পদার্থবিদ্যার একটা জটিল অঙ্ক কষা নিয়ে। পদার্থবিদ্যার শিক্ষক বিজনবাবু ক্লাসে অঙ্কটা কষতে গিয়ে কি ভাবে জানি আটকে গেলেন, সমাধান হচ্ছে না কিছুতেই। বিজনবাবু রাশভারী মানুষ; আমরা সবাই চুপ। ক্লাসে পিন পড়লে বোধহয় শব্দ শোনা যাবে। হঠাত্ ওনার চোখ পড়ল আমার উপর। ছাত্র হিসাবে ক্লাসে আমার একটু হলেও সুনাম আছে।
উনি ডাকলেন-“কল্লোল দেখতো অঙ্কটা কষতে পার কিনা।”
আমি দুরু-দুরু বক্ষে ব্ল্যাক-বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম। কি ভাবে অসাধ্য সাধন হল আমি নিজেই জানি না! আমি অল্প সময়ের মধ্যেই ওই জটিল অঙ্কটার সমাধান করে দিলাম। বিজনবাবু আমায় জড়িয়ে ধরে অনেক আশীর্বাদ করলেন। সারা ক্লাসে ধন্য-ধন্য পড়ে গেল। এই প্রথম দেখলাম শিপ্রা আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন আমি কোন ভিন গ্রহের প্রাণী ভুল করে ক্লাসে ঢুকে পড়েছি। এরপর থেকে শিপ্রা আমায় দেখে হাসত, কথা বলার চেষ্টা করত। মিথ্যা বলব না, আমার তখন যে বয়স, সেই বয়সে সব মেয়েকেই ভাল লাগে; শিপ্রাও তার ব্যতিক্রম নয়। সত্যি বলতে কি শিপ্রাকে আমার ভাল লেগেছিল। তবে এই ভালোলাগাটা ভালোবাসা কিনা তা ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু এটা নির্ভেজাল সত্য যে, আমার মনে কোন পাপবোধ ছিল না। উপরন্তু মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠতা করার সময় ও কায়দা-কানুন কোনটাই আমার জানা ছিল না। তদুপরি সে ছিল সমীরের ভালোবাসার পাত্রী।
একদিন ক্লাসের ফাঁকে শিপ্রা আমায় ডেকে বলল-“কল্লোল তুমি আমায় একটু সাহায্য করবে?”
আমি তো হতভম্ব! শিপ্রার মত দেমাকী মেয়ে আমায় অনুরোধ করছে? আমি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
আমি হতবাক হয়ে বললাম-“বল আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি নিশ্চয় চেষ্টা করব।”
“তুমি কি সপ্তাহে একদিন করে পদার্থবিদ্যা আর অঙ্কটা আমায় দেখিয়ে দেবে? আমি তোমার যাতায়াতের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেব আর তুমি যে পারিশ্রমিক চাইবে তাই পাবে।”
আমার পৌরুষত্বে কোথায় যেন একটা আঘাত লাগল।
আমি গম্ভীর ভাবে বললাম-“তোমার গাড়ি এবং পারিশ্রমিক কোনটারই আমার প্রযোজন নেই। অতি সাধারণ ঘরের ছেলে আমি। বাসে-ট্রেনে করে যাবার অভ্যাস আমার আছে। সোনারপুর মেস থেকে ট্রেনে করে যাদবপুর আসতে আমার অসুবিধা হবে না, তাই গাড়ির প্রয়োজন নেই আর কোনও বন্ধুকে সামান্য সাহায্য করার জন্য পারিশ্রমিকের দরকার হয় না।”
আমার কাছ থেকে এরূপ উত্তর পাবে শিপ্রা বোধহয় আশা করে নি। তাই হঠাত্ শিপ্রার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা অমাবস্যার মত কালো মেঘে ঢেকে গেল। মনে মনে আমি লজ্জিত হলাম। এইভাবে আঘাত করাটা কখনই আমার উচিত হয় নি। এমনও তো হতে পারে যে, আমার অসুবিধার কথা ভেবেই ও কথাটা বলেছিল, অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তাই তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা এড়াবার জন্য আমি বললাম-“তুমি কি বুঝতে পারছ কেন আমি তোমার গাড়ি চড়ব না? আসলে তোমার ওই সিং সাহেব কে আমার না পসন্দ। যদি তুমি থাকতে তাহলে সাগ্রহে যেতাম- বলেই হো-হো করে হেসে উঠলাম।”
দেখলাম শিপ্রার মুখটা আবার সূর্যর্মুখী ফুলের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আমি পড়াতে শুরু করলাম। ক্রমশ: শিপ্রার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। শিপ্রা যেন আমার উপর ক্রমশ: নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আমাকে নিজের প্রকৃত বন্ধু বলে ভাবতে পারছে। কেন জানি না, আমার মনেও শিপ্রার জন্য একটা আলাদা অনুভুতি তৈরি হল। এটা গভীর ভালোবাসা না নিছক বন্ধুত্ব বলতে পারব না। তবে এটা ঠিক শিপ্রার অনুপস্থিতি আমার মন কে নাড়া দিত।
কোথা থেকে যে জীবনের বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। এখন সেই অর্থে শিপ্রা কিংবা সমীরের সাথে আমার আর সরাসরি যোগাযোগ নেই। যেটুকু যোগাযোগ তা কেবল ফোনেই সীমাবদ্ধ। এখন আমার বয়স প্রায় সাতাশ বছর, মালদাতে একটা সরকারী কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। সমীর ব্যাঙ্ক অফ বরোদার ম্যানেজার, এই মুহুর্তে পোস্টিং হাওড়াতে। শিপ্রা কলকাতায় ব্যাম্বু ভিলাতে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। আমি মালদাতে কলেজের কাছেই একটা দোতলা বাড়ির নিচের তলায় ভাড়া থাকি। দুটি শোবার ঘর, একটা স্টাডি রুম,ছোট একফালি বারান্দা, রান্নাঘর আর বাথরুম। আমি একটা ঘরে থাকি আর একটা ঘরে থাকে বংশী ও বংশীর স্ত্রী নয়না।এর দুজনেই আমার কাজের লোক। বংশী আমার যাবতীয় ফাইফরমাস খাটে, নয়না রান্না-বান্না করে। আমার কাজ বলতে শুধুমাত্র কলেজে যাওয়া আর বাড়িতে গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো। নয়নাকে আমি আমার বোনের মতই স্নেহ করি। ভারী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, কম কথা বলে, অনেক কথা জিজ্ঞেস করলে তবে একটা কথার উত্তর দেয়। কিন্তু সংসারের প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি। কোনও কিছু অনিয়ম হবার জো নেই।
গভীর রাত কিছুতেই ঘুম আসছে না। নিদ্রাদেবী যেন আমায় ত্যাগ করেছে। মনের গভীরে উঁকি দিছে পুরানো দিনের সুখ-দু:খের ছোট-ছোট স্মৃতি। না! আজ আর আমার ঘুম আসবে না। উঠে পড়ে বারান্দায় পায়চারী করছি আর চিন্তা করছি যদি শিপ্রাকে আমার জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পেতাম তাহলে বোধহয় আমার জীবনের বৃত্তটা সম্পুর্ণ হতো। ছি:ছি:! একি চিন্তা করছি আমি? নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে উঠলাম। পরের দিন কলেজে যেতে ইচ্ছা করছিল না। গতকালের ঘটনার পর মনটা বড় অবসন্ন হয়ে আছে। অদ্ভুত একটা শূন্যতা গ্রাস করেছে আমাকে। তখন পড়ন্ত বিকেল-বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে, অলসভাবে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি, কিছুই ভাল লাগছে না- হঠাত্ বাইরের দরজায় করাঘাতের শব্দ। এই বাদল বেলায় কে এল আবার, আজ তো কারোর পড়তে আসার কথা নয়?
নয়নাকে বললাম-“ নয়না দেখ তো , কে এল এই বাদল বেলায়? দরজাটা খুলে দাও।”
নয়না তাড়াতাড়ি এসে দরজাটা খুলে দিল।
“দাদাবাবু একজন ভদ্রমহিলা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, ভিজে স্নান।”
আমি তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এলাম। একি! এ কি করে সম্ভব? বাইরে দাঁড়িয়ে আছে শিপ্রা। উচ্ছ্বাসহীন মুখ, চোখের দৃষ্টিতে একরাশ শূণ্যতা, কি যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে মনের উপর দিয়ে।
আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম-“শিপ্রা তুমি? কি হয়েছে তোমার? কোথা থেকে আসছো?”
শিপ্রা উত্তর দেয়-“আগে আমায় ঘরে ঢুকতে দাও তারপর যত খুশি জেরা কর।”
আমি সম্বিত ফিরে পেলাম, বললাম-“ছি:ছি:! সত্যিই আমি লজ্জিত, ঘরে এস তুমি তো একেবারে ভিজে স্নান হয়ে গেছ। তুমি তাড়াতাড়ি ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে ফেল নতুবা তোমার যা ঠান্ডার ধাত তাতে বুকে সর্দি বসে যাবে। কিন্তু তোমায় আমি কি পরতে দিই বলত?”
“অযথা তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমি তোমাকে কয়েকটা কথা জানিয়েই চলে যাব। বাড়িতে আমি কাউকে বলে আসি নি, সবাই চিন্তা করবে।”
আমি ধমক দিয়ে বললাম-“পাগলামি ছাড়ো।”
আমি নয়নাকে ডাকলাম।
নয়না দৌড়ে এল –“বলুন দাদাবাবু।”
“দিদিমনিকে তোমার একটা পরিষ্কার শাড়ি দাও তো। দিদিমনি একেবারে ভিজে গেছে।”
“আমি জানি দাদাবাবু। আপনার বলার আগেই আমি বার করে রেখেছি।”
“চলুন দিদিমনি। আমার ঘরে এসে ভিজে জামা-কাপড়গুলো ছেড়ে ফেলুন। আমি ভিজে কাপড়গুলো ধুয়ে মেলে দিচ্ছি।”
“না-না,ব্যস্ত হতে হবে না। আমি অসময়ে এসে তোমাদের অসুবিধায় ফেললাম।”
আমি গম্ভীর ভাবে বললাম-“যাও নয়নার ঘরে যাও, অবুঝের মত কথা বল না।”
শিপ্রা কেমন যেন বাধ্য মেয়ের মত নয়নার সাথে চলে গেল। শাড়ি ছেড়ে শিপ্রা যখন আমার ঘরে এল, তখন অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে।
আমি স্নেহের স্বরে বললাম-“এই গরিবের ঘরে তোমাকে কোথায় বসতে দেব জানি না। যদি তুমি কিছু মনে না কর, তবে অধমের এই খাটেই বসতে পার।”
শিপ্রা কেঁদে ফেলল। আমি তাড়াতাড়ি শিপ্রার হাত দুটো ধরে ফেললাম। জীবনে এই প্রথম আমি শিপ্রাকে স্পর্শ করলাম। দেহের মধ্যে একটা মধুর অনুভূতির সৃষ্টি হল।
আমি বললাম-“কেঁদ না শিপ্রা, শান্ত হও। আমি তোমার সব কথা শুনবো, তবে আজ তুমি বাড়ি ফিরতে পারবে না-প্রথমত: বৃষ্টি এখনও ধরে নি, দ্বিতীয়ত এত রাতে আমি তোমায় একা একা ছাড়তে পারি না। বন্ধু হিসাবে আমার ও একটা দায়িত্ব আছে। তুমি চিন্তা কর না আমি এক্ষুনি মাসিমাকে ফোন করে সব জানিয়ে দিছি।”
শিপ্রা খাটে বসে।
“এখন বল কি খাবে চা না কফি?কফিই করতে বলি নয়নাকে কি বল? এই ঠান্ডাতে তোমার কফি ভাল লাগবে।”
আমি ডাকলাম-“নয়না দু কাপ কফি আর খানকতক বেগুনি ভেজে নিয়ে এসো, আর শোন রাতে দিদিমনিকে তোমার হাতের গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজা করে খাইয়ো।”
শিপ্রা অধোবধনে বসেই রইল। কোথাও যেন মনের মধ্যে একটা চাপা সঙ্কোচ। আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম।
“আচ্ছা শিপ্রা একটা ব্যাপার আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, যদি তোমার কোন বিপদ হয়েই থাকে, তবে আগে সমীরকে না জানিয়ে এত দূরে ছুটে এলে কেন?”
শিপ্রা তবুও নিরুত্তর। এদিকে বাইরে বৃষ্টি একটু ধরেছে। যদিও হাওয়ার দাপট বেড়েই চলেছে। মেঘের গর্জন কিছুটা প্রশমিত হলেও বিদ্যুতের ঝিলিক মাঝে-মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
এতক্ষণ পর শিপ্রা আমার দিকে মুখ তুলে চাইল। সেই চোখ, সেই সৌকুমার্য, শুধু চোখের সেই গর্বিত ভাবটা যেন উধাও হয়ে গেছে।
শিপ্রা শান্তভাবে বলল-“আমি স্বার্থপরের মত তোমার কাছে ছুটে এসেছি বড় আশা নিয়ে। আমি জানি তুমিই পারবে আমায় বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। আমি জানি তুমি আমায় ফেরাবে না।”
আমি শিপ্রাকে বাধা দিয়ে বললাম-
“যদি তুমি আমাকে প্রকৃত বন্ধু মনে কর, তবে নি:সঙ্কোচে তোমার বিপদের কারণটা জানাতে পার। আমি কথা দিছি যে তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব।”
“কি ভাবে ঘটনাটা শুরু করব আমি নিজেই জানি না। এই ঘটনা আমাদের মত সব মেয়েদের কাছেই লজ্জার এবং চরম অপমানের.... তবু বলতে হবে। তুমি বোধহয় শুনে থাকবে যে সমীর হাওড়ার যে ব্যাঙ্কে কাজ করে সেখানে গত পাঁচ-ছয় মাস হল একটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে সমীরের পি.এ.হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছে- নাম মারিয়া গোমেজ। আমি দু-একদিন সমীরের ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম তখনই আমি মেয়েটিকে সমীরের চেম্বারে দেখেছি। বয়স অন্তত: বাইশ-তেইশ হবে। ফর্সা অথচ ঠিক সুন্দরী বলা চলে না। সারা শরীরে একটা যৌবনসুলভ উগ্রতা আছে। চোখে আছে চটুলতা। বেশ-বাস পড়ার ভঙ্গিতে দেহকে উন্মোচন করার প্রয়াস যথেষ্ট। অবশ্য সমীরেরও এই ব্যাপারে যথেষ্ট ইন্ধন আছে। শুনেছি ছুটির পর মাঝে-মধ্যেই নিজের গাড়িতে করে মেয়েটিকে নিয়ে বিভিন্ন হোটেল, পার্টি বা লং ড্রাইভে যাচ্ছে। সারা অফিসে দুজনের নামে বিশ্রী কানাঘুষো চলছে, শুধু ম্যানেজার বলেই সামনা-সামনি মুখ খুলতে সাহস পায় না। আমি নিজেই কয়েকদিন আগে সমীরের কাছে মারিয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম; বলেছিলাম- মেয়েটি কেমন যেন গায়ে পড়া স্বভাবের, চালচলন ও সুবিধার নয়, তুমি ওর থেকে সাবধানে থাকবে আর ওকে প্রশয় দেবে না। শুনে সমীর হো-হো করে হেসে উঠে বলেছিল কেন তোমার কি আমাকে হারাবার ভয় হচ্ছে? তুমি তো জান অফিসে আমাকে কত কাজের চাপ নিতে হয়, সেই চাপ ও নি:সঙ্গতা কাটাবার জন্য যদি মারিয়ার সাথে একটু-আধটু সময় কাটাই তাতে তোমার তো আপত্তি থাকার কথা নয় ডার্লিং। আমি তো মারিয়াকে বিয়ে করতে যাচ্ছি না। এই সামান্য ঘটনাতে তুমি যদি এত ভয় পাও তবে সারাজীবন আমায় নিয়ে চলবে কি ভাবে? আমি নিজেও অবশ্য আগে এইরকম একটু-আধটু কানাঘুষো শুনেছিলাম তখন এতটা গুরুত্ব দিইনি, ভাবতেই পারিনি সমীরের এতটা চারিত্রিক অধ:পতন ঘটেছে।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শিপ্রা একটু দম নিল। দেখলাম এই ঠান্ডাতেও শিপ্রার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, ফর্সা মুখবয়ব লাল হয়ে গেছে।
আমি বললাম-“এখন আমায় তুমি কি করতে বল?”
শিপ্রা আমার হাত দুটো ধরে অঝোরে কেঁদে ফেলল।
বলল-“সমীর তোমার বহুদিনের বন্ধু, তোমার কথা ও রাখবেই। তুমি যে ভাবেই হোক মারিয়ার হাত থেকে সমীরকে উদ্ধার কর।”
আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে, মনের অতল গভীর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসছে। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সারা মন। লুকানো পাহাড় প্রমাণ স্ব্প্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে......
মনে মনে বললাম- শিপ্রা তোমার সামনে বসে থাকা মানুষটাকে তুমি বুঝতেই পারলে না কোনদিন। তুমি জানতেও পারলে না এই মানুষটা তোমার কত আপনার কত কাছের! যাক আজ এ কথা বলে আমি তোমায় বিব্রত করব না। আমি নীরবে দূর থেকেই তোমায় আজীবন ভালবেসে যাব। সেই ভালবাসাই হবে আমার পরম প্রাপ্তি।
শিপ্রার চিবুক স্পর্শ করে বললাম-“চোখের জল মুছে ফেল। দুর্বলরাই চোখের জল ফেলে। আমি কথা দিছি যেমন ভাবেই হোক আমি তোমার সমীরকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব।”
খাওয়া শেষ হলে আমি শিপ্রাকে আমার খাটে শুতে বলে বারান্দায় আমার বিছানা করতে উদ্যত হলাম।
শিপ্রা দেখেই বলে ওঠে-“না এই খাটেই আমাদের দুজনের একটা রাত কেটে যাবে। এই বর্ষায় তুমি কিছুতেই বারান্দায় একা শুতে পারবে না।”
“তা হয় না শিপ্রা, একঘরে দুটি পরিণত নারী-পুরুষ থাকাটা দৃষ্টিকটু। তাছাড়া পাশের ঘরেই বংশী-নয়না আছে, তারা কি ভাববে বলত?”
-“না ওরা কিছু ভাববে না, দুজনেই তোমায় দেবতা জ্ঞানে বিশ্বাস করে আর আমার কথা যদি বল তবে বলতে পারি আমিও তোমায় মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। আর তর্ক কর না, অনেক রাত হয়েছে, শোবে চল।”
আমি আর শিপ্রা একই ঘরে একই খাটে শুয়ে আছি। নীলাভ বাতির আলোয় ঘরটা স্বপ্নের মায়াজাল বিস্তার করেছে। কত কাছে আমরা- আবার কত দূরে..........
পরের দিন সকালবেলায় সামান্য জলখাবার খেয়ে শিপ্রাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বংশীকে বললাম সাবধানে থেকো ফিরতে আমার দু-একদিন দেরি হতে পারে। নয়না গতকালই আমার কাছ থেকে শিপ্রার এখানে আসার উদ্দেশ্যেটা জানতে পেরেছিল, তাই আজ ভোরবেলায় নয়না আমাকে সাবধান করে বলল-“ দাদাবাবু আপনি এই ভয়ঙ্কর সর্বনাশের খেলায় নামবেন না। আমি জানি আপনি দিদিমনিকে প্রাণের অধিক ভালবাসেন। আমিও তো একজন মেয়ে, তাই বলছি মারিয়ার মত মেয়েরা সহজে হারতে চায় না। আমি গতকাল আপনার চোখে আগুন দেখেছি, আপনার মত শান্ত মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করেছি ক্রোধের আভাস। আমি আপনার বোনের মত, তাই মিনতি করছি আপনি দিদিমনির ব্যাপারে নিজেকে জড়াবেন না।”
আমি নয়নার কথার উত্তর না দিয়ে উঠে পড়লাম। কলকাতায় শিপ্রাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি হাওড়ার একটা ট্যাক্সি ধরলাম। মাথার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। পৃথিবীটা কে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। ভাবতে ভাবতে কখন যে সমীরদের ব্যাঙ্কের কাছে চলে এসেছি নিজেও জানি না। সম্বিত ফিরলো ড্রাইভারের ডাকে। ট্যাক্সি থেকে নেমে ঠিক কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছিলাম না। হটাত্ দেখি সমীর তার নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর ঠিক তার পিছনেই সেই মেয়েটি। শিপ্রা মেয়েটির সম্পর্কে যা যা বলেছিল তা সত্যিই ঠিক। মেয়েটির হাঁটা-চলার মধ্যে একটা মাদকতা আছে। যৌবন যেন দেহটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। চোখে বিদ্যুত্ খেলছে, ঠোঁটের কোণে একটা চাপা হাসি। পরনে ছোট আঁটো-সাঁটো পোশাক যেটা নিতম্বের উপর চেপে বসে আছে, বুকে স্পষ্ট বিভাজিকা দেখা যাচ্ছে, পায়ে হাই-হিল জুতো। এইরকম মেয়েকে দেখলে চিত্ত-চাঞ্চল্য হওয়া স্বাভাবিক।
আমি দূর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওদের অনুসরণ করলাম। কিছুটা গিয়েই ওরা একটা নামী হোটেলে ঢুকল। আমি বাইরে ট্যাক্সি নিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। টানা দু ঘণ্টা পর ওরা হোটেল থেকে বার হয়ে পার্কস্ট্রীটের একটা ছোট গলির মুখে এসে থামল। গাড়ি থেকে মেয়েটিকে নামিয়ে দিয়ে সমীর আবার চলে গেল। আমিও ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে মারিয়ার পিছু নিলাম। এটা একটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহল্লা। লোকজনের হাঁটা-চলা, চালচলন যেন অন্যরকম। সন্ধ্যা হয়েছে, একটা-দুটো করে রাস্তার বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। আলো-আঁধারিতে যে দু-একজন কে দেখা যাচ্ছে তাদের হাঁটা-চলা দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে তাদের অধিকাংশই সুস্থ নয়। এইখানে আমার মত লোককে দেখে তাই অনেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, যেন আমি ভুল করে এই পাড়াতে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু আমার এইসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই, তাই একপ্রকার মরিয়া হয়ে মনের জোরকে সম্বল করেই আমি মেয়েটি কে ডেকে উঠলাম। মেয়েটি ক্ষণিকের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই আরো জোরে হাঁটতে লাগল। বাধ্য হয়ে আমি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির হাতটা চেপে ধরলাম। মেয়েটি চকিতে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। মেয়েটির চোখের কোণে বিদ্যুতের ঝিলিক, ঠোঁটে চাপা হাসি।
“Hello” handsome!
Who are you?
What do you want?”
মুখ থেকে তীব্র মদের গন্ধ ভেসে আসছে। সারা শরীরটা প্রচণ্ড ঘেন্নায় আমার রি-রি করে উঠল। তবুও আমি স্থিরভাবে মারিয়ার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলাম-“বোধহয় আমি মিস মারিয়ার সাথেই কথা বলছি।”
মেয়েটি চকিতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। মেয়েটির মদের নেশা ছুটে গেছে। অসম্ভব বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে চাইল।
আমি বললাম-“চল মারিয়া তোমার বাড়ি যাওয়া যাক, তোমার সাথে আমার বেশ কিছু জরুরী কথা আছে।”
প্রথমে যেতে অস্বীকার করলেও আমার কথার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যে মারিয়ার মত সপ্রতিভ মেয়েও তত্ক্ষনাত্ কোনও উত্তর দিতে পারল না।
দু-এক মিনিট হতভম্ব হয়ে থাকার পর বলল-“চলুন।”
আমি ঘরের চারপাশটা ভাল করে পর্যবেক্ষন করলাম। অপরিসর ঘর, ঘরে পর্যাপ্ত আলো নেই, ঘরে আসবাবপত্র বলতেও সেরকম কিছু নেই। থাকার মধ্যে শুধু একটা ছোট খাট, একটা ছোট ভাঙা টেবিল, একটা লোহার আলমারী আর দুটো সস্তার প্লাস্টিকের চেয়ার। টেবিলে মদের একটা অর্ধ-খালি বোতল পড়ে রয়েছে। ঘরের মধ্যেই একটা সাধারণ পর্দা দিয়ে আড়াল করা ছোট জায়গা, সেখানেই গুটিকয়েক রান্নার টুকিটাকি সরঞ্জাম। আর একপাশের দড়িতে কয়েকটা জামা-কাপড় ঝুলছে। ঠিক করে বলতে গেলে সারা ঘরে দারিদ্রতার ছাপ সুপষ্ট। এদিকে মারিয়ার তখনও ঠিক করে ঘোর কাটে নি, তবু তার মধ্যে বলে ওঠে-
“Sit down please.
What can I do for you?”
আমি ভণিতা না করেই বললাম-“আমি কল্লোল দত্ত। তোমার বিশেষ বন্ধু সমীর চক্রবর্তী আমার ও বিশেষ বন্ধু। আশা করি এই নামটা কোনও না কোনও ভাবে নিশ্চয় শুনে থাকবে।”
এইবার আমার আগমণের উদ্দেশ্যটা বোধহয় মারিয়ার কাছে স্পষ্ট হল।
একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল-“তাহলে তো আপনি আমার বিশেষ অতিথি। সেক্ষেত্রে আপনার মনোরঞ্জনের দায়িত্বটা ও আমার। বলুন কি পান করবেন? স্কচ না হুইস্কি? নাকি অন্য কিছু চেখে দেখার অভ্যাস ও একটু-আধটু আছে?” বলেই ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি হেনে খিল খিল করে হেসে আমার গায়ে ঢলে পড়ল।
আমার মুখের সামনে মারিয়ার প্রস্ফুটিত উন্নত বুক, আমার বুকের উপর মারিয়ার মসলিনের মত ঘন চুল, চোখে মদিরতা। আমি অনেক কষ্টে নিজের রাগকে সংযত করে মারিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
“তোমার লজ্জা করে না! একজন অপরিচিত পুরুষের কাছে এইভাবে নিজেকে বিকিয়ে দিতে?”
মারিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে।
আমি বললাম-“সমীরকে তুমি কতটুকু চেন? কি জানো তুমি সমীর সম্পর্কে? তুমি কি জানো সমীর এর আগেও বহু মেয়ের সাথে এই ভাবে মিশেছে? কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ না সমীর তোমাদের মত মেয়েদের নিয়ে শুধু ফুর্তি করবে আর পুরোনো হয়ে গেলেই বাসি ফুলের মত ছুঁড়ে ফেলে দেবে।”
এই বলে অধিক উত্তেজনায় আমি হাঁফাতে লাগলাম। বুঝতে পারছি সমীরের নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে গিয়ে আমার মুখ-চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, কপালের রগগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বিদ্যা-বুদ্ধি সব যেন আমার লোপ পাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছি আমি ক্রমশ......তবুও আমায় চেষ্টা করে যেতেই হবে, হারলে আমায় চলবে না। যে ভাবেই হোক সমীরকে মারিয়ার হাত থেকে উদ্ধার করে শিপ্রার কাছে ফিরিয়ে দিতেই হবে। এর জন্য যা যা করতে হয় আমি করব।
মারিয়া ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় নিল। তারপর আমার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানল। কি তীক্ষ্ণ সেই চাহনি! যেন আমার বক্ষস্থল বিদীর্ণ করে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত করতে চাইছে। কিন্তু আমায় বুঝতে দিলে চলবে না-
তাই অস্ফুট স্বরে বললাম-“যদি তুমি বাঁচতে চাও, নিজের ভাল চাও, তাহলে সমীরের কাছ থেকে পালিয়ে যাও। এখনও সময় আছে, নতুবা সমীরের ঘৃণ্য স্পর্শে তুমি শেষ হয়ে যাবে। তোমার অন্তরের আত্মার মৃত্যু ঘটবে।”
অনেকক্ষণ কি যেন চিন্তা করল মারিয়া।
তারপর শান্তভাবে বলল-“আমি এখন বুঝতে পারছি আপনি এখানে কেন এসেছেন। আপনি অন্তর থেকে শিপ্রার ভাল চান তাই না? অবাক হবেন না কল্লোলবাবু। আমি ওদের সব কথাই জানি। আপনিও অন্তর থেকে শিপ্রার ভাল চান তাইতো? তাই আপনি চাইছেন আমি যেন সমীরকে ছেড়ে দিই, ওরা যেন বিয়ে করে পরস্পর সুখী হয়, আর এর জন্য আপনি আপনার বন্ধুর নামে মিথ্যা কলঙ্ক দিতেও দ্বিধা করছেন না। সত্যিই চমত্কার!”
লজ্জায় আমি মুখ তুলে তাকাতে পারছি না। কি উত্তর দেব আমি মারিয়াকে? হটাত্ মারিয়া আবার স্বমূর্তি ধারণ করল।
অট্টহাস্য করে বলল-“বলতে পারেন সমীরকে ছেড়ে দিলে আমার কি লাভ? এই যে আমি সমীরের কাছ থেকে এত টাকা, গহনা, শাড়ি পাচ্ছি, এরপর কে দেবে আমাকে এই সুবিধা? কে দেবে আমার আমোদ আহ্লাদের সুযোগ আর নিরাপত্তা? আপনি দেবেন? তাহলে আমার সমীরকে ছেড়ে দিয়ে আপনার বাহুলগ্না হতে কোন আপত্তি নেই।”
বলেই মারিয়া আবার আমার গায়ে ঢলে পড়ল। আমি বুঝতে পারছি আমার সব চল-চাতুরী ওই একরত্তি মেয়েটির কাছে ধরা পড়ে গেছে। আর উপায় নেই; যা বলার স্পষ্টভাবে বলতে হবে।
আমি বললাম-“যদি তুমি সমীরের কাছ থেকে দূরে সরে যাও, আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে আমার বাড়িতে আশ্রয় দেব। সমীরের মত টাকা-পয়সা, গহনা হয়ত তোমায় দিতে পারব না, কিন্তু জীবনে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার আমি তা দেব এবং মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দেব।”
“আমি আপনার বাড়িতে কি পরিচয়ে থাকব বাবুজী? রক্ষিতার পরিচয়ে?”
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আমি মারিয়ার চিবুক স্পর্শ করে বললাম-“মারিয়া তুমি যে পরিচয়ের কথা বলছ সেগুলো ছাড়াও আর অনেক পরিচয় নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাক যায়। বোনের অনুভুতি পেয়েছ কখনো? তুমি যদি চাও তাহলে এই দাদা তোমাকে সাদরে বোনের সম্মান দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাবে। তুমি যে জীবন কাটাচ্ছ সেটা ক্ষণস্থায়ী, বয়সের সাথে সাথে তুমি ক্রমশ: একা হয়ে পড়বে। আর যদি বল বিয়ে সেটাও জীবনের সব চাহিদা নয়। আমিও একসময় স্বপ্ন দেখেছিলাম বিয়ে করার কিন্তু এখন আর দেখি না। শুনে তোমার অদ্ভুত লাগবে, আমি যাকে ভালবাসি তাকে কোনদিন কাছে পাব না জেনেও তাকে আজও ভালোবাসি। ঠিক মরীচিকার মত- দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না।”
কেন জানি না মনে হল মারিয়া আমাকে বিশ্বাস করল।
অস্ফুট কন্ঠে বলল-“যদি তুমি আমাকে সত্যিই বোনের মর্যাদা দিতে পার তাহলে আমার মত খারাপ মেয়েকে তোমার চরণ স্পর্শ করার অনুমতি দাও দাদা।”
এই প্রথম মারিয়া আমায় তুমি বলে সম্বোধন করল। আমি হাত বাড়িয়ে মারিয়াকে বুকে টেনে নিলাম। মারিয়া নতজানু হয়ে আমায় প্রণাম করল আর চোখ থেকে নেমে এল অশ্রুধারা।
অবাক বিস্ময়ে আমি মারিয়াকে লক্ষ্য করছি- একটু একটু করে আমার চোখের সামনে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে একজন নারীর মিথ্যা আভরণ। ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে তার মমতাময়ী স্ব্কীয় সত্তা। এ যেন রামের স্পর্শে অহল্যার শাপ মুক্তি। হে পরমেশ্বর! তাহলে বাইরে থেকে আমরা যা দেখি তা কি সব সময় সত্যি নয়? এর বাইরেও কি লুকিয়ে থাকে নির্মম সত্য? যা বাইরে থেকে খালি চোখে দেখা যায় না? হটাত্ করে আমার চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। হাত দিয়ে দেখি আমার অজান্তেই কি ভাবে যেন চোখ থেকে নেমে এসেছে আনন্দাশ্রু।
পরের দিনই আমি মারিয়াকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। বংশী ও নয়নাকে ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিলাম। শুধু বললাম এই ঘটনার বিন্দু-বিসর্গ যেন শিপ্রা ও সমীর জানতে না পারে।
আমি মারিয়াকে বললাম-“আজ থেকে তুমি আমার আদরের বোন। এই সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ও ভার আজ থেকে তোমার।”
মারিয়া এখন আমার সর্বক্ষণের সাথী। তার আনন্দের সীমা নেই। কথায় কথায় আমার উপর অভিমান করে, কড়া হাতে আমায় শাসন করে। এত সুখ এর আগে আমি কোনদিন পাই নি। এই ঘটনার মাসখানেক পর শিপ্রা ও সমীর আমার বাড়িতে সশরীরে উপস্থিত হল বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। আমি আগেভাগেই মারিয়াকে আমার এক ছাত্রীর বাড়ি রেখে এসেছিলাম যাতে সমীরের মুখোমুখী হতে না হয়। আজ শিপ্রার মুখ আলোয় উদ্ভাসিত, সারা শরীরে হিল্লোলের ছোঁয়া, মুখে অনাবিল আনন্দ, চোখে আবার সেই গর্বের ছোঁয়া। সমীরের অজান্তে শিপ্রা আমার হাত ধরে বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল,বিয়েতে যাবার জন্য আমায় বারবার অনুরোধ করল। বংশী ও নয়নাকে অনেক করে যাবার জন্য বলল। আমি ওদের দুজনের বিয়েতেই গিয়েছিলাম। এখন আবার মালদাতে ফিরে এসে কলেজে যোগ দিয়েছি। কি ভাবে জানি না মারিয়া আমার আত্মত্যাগের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পেরে গেছে। মনে মনে মারিয়া তাই খুব কষ্ট পায়। মারিয়া আর নয়না অনেকবার নানা ভাবে আমাকে নতুন করে ঘর বাঁধার জন্য অনুরোধ করেছে, আমি রাজি হই নি।
ইতিমধ্যে আমি মারিয়ার বিয়ে দিয়েছি। পাত্র আমারই প্রাক্তন ছাত্র, খুব ভাল ছেলে, পরিবারে মা-বাবা কেউ নেই। এখন আমারই কলেজের লেকচারার। মারিয়ার সম্পর্কে সব জেনেই সে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিছুদিন হল মারিয়ার ছেলে হয়েছে- নাম রেখেছে কল্লোল। বোধহয় আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ এই নামকরণ। এখন আমার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। মনের গহীনে যে চাপা দু:খ ছিল তা বহুদিন হল উধাও হয়ে গেছে। আমার স্বপ্নগুলো এখন মারিয়া আর তার ছেলেকে কেন্দ্র করে নতুন করে গড়ে উঠেছে। এখন আমি খুব সুখে আছি তার একটাই কারণ মারিয়া ও শিপ্রা দুজনেই বিয়ের পর খুব সুখে আছে।
রচনাকাল : ১৩/১২/২০২০
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।