ভাইফোঁটা নয় যমদ্বিতীয়া (পৌরাণিক গল্প) চতুর্থ পর্ব
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখক : লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
দেশ : India , শহর : New Delhi

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , সেপ্টেম্বর
প্রকাশিত ৯৩৫ টি লেখনী ৭১ টি দেশ ব্যাপী ২৩৬৬৬৯ জন পড়েছেন।
ভাইফোঁটা নয় যমদ্বিতীয়া (পৌরাণিক গল্প) চতুর্থ পর্ব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


যম এবং যমী- ভ্রাতা ও ভগ্নী৷ ঋগ্বেদ বলছে, তাঁরাই পৃথিবীর প্রথম মরণশীল মানব-মানবী৷ যৌবনের উদ্গমে ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন যমী৷ কিন্তু যমের কাছে তা ছিল পাপ, অনাচার৷

 ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা৷/ যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/ আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা৷’ কিন্তু ‘যমুনা’ দেয় ‘যম’-কে ফোঁটা! এই যম ও যমুনা কে? নরকের অধিপতি যম৷ শ্রীঅরবিন্দ তাঁর ‘সাবিত্রী’ মহাকাব্যে যমকে এক অতি সাধারণ দাম্ভিক চরিত্ররূপে এঁকেছেন৷ পিতা বাজশ্রবস-ঋষি বিশ্বজিত্‍ যজ্ঞ করছেন৷ এই যজ্ঞে নিজের সর্বস্ব আহুতি দিতে হয়৷ কিন্তু ঋষির মন থেকে কামনা যায়নি, তাই তিনি সব দিতে পারলেন না৷ দক্ষিণারূপে দিলেন সেই সব ইন্দ্রিয়সামর্থ্যহীন গাভীদের যারা শেষ বারের মতো জলপান ও তৃণভক্ষণ করেছে এবং যাদের থেকে নিংড়ে নেওয়া হয়েছে দুধের শেষ বিন্দুটুকু৷ পুত্র নচিকেতা আত্মবলিদানে চাইলেন পিতার এই ত্রুটি পূরণ করতে৷ পর পর তিনবার তিনি বললেন: ‘তত, কস্মৈ মাং দাস্যসীতি’- হে তাত, আমায় কাকে দান করবেন? ক্রুদ্ধ পিতা বললেন: ‘মৃত্যবে ত্বা দাদমীতি’- তোমায় মৃত্যুকে দান করলাম৷ তার পর নকিচেতা মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে গেলেন৷ এবং শেষে তাঁর কাছ থেকে দেবতাদেরও দুর্লভ আত্মজ্ঞান লাভ করে ফিরেছিলেন৷ এখানে দেখছি শুধু নরকের যন্ত্রণা নয়, তিনি স্বর্গের অনন্তকালীন স্বাদুময় জীবনও দিতে পারেন অধিকারীকে৷


যমের একটা পরিচয় পাওয়া গেল বটে, কিন্তু যমুনা যে কি না যমের ভগিনীরূপে তার কপালে ফোঁটা দিচ্ছে সে কে? ঋগ্বেদ তার ১০ম মণ্ডলের ১০ম সূক্তে জানিয়েছেন, এরা সূর্যের ঔরসে বিশ্বকর্মা ত্বষ্টার কন্যা সরন্যূর গর্ভে জাত যমজ সন্তান- ভ্রাতাভগ্নি৷ এরা যম ও যমী৷ যমীই যমুনা৷ এরাই এই মর্ত্য পৃথিবীর প্রথম মরণশীল মানব-মানবী৷ বড়ো হয়ে উঠেছে এক সঙ্গে, সখ্যে স্নেহে ও মিত্রতায়, বিস্তীর্ণ সমুদ্রমধ্যবর্তী একটি দ্বীপোদ্যানে৷ ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে উদ্যম হয়েছে যৌবন৷ যম বরাবর গম্ভীর ও ধীর৷ যমী লাস্য ও লাবণ্যে উজ্জ্বল এক আদিম নারী৷ কামার্তা যমী দ্বীপবর্তী নির্জন স্থানে ভ্রাতা যমের কাছে সহবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করছে৷ আর তার এই প্রার্থনায় সে কোনও দোষ দেখছে না, কারণ মাতৃগর্ভে যমজ সন্তান হিসেবে তারা তো পরস্পরের সঙ্গে একত্রবাস তথা সহবাসই করেছে৷ এবং এটাই বিধাতার ইচ্ছা যে তারা শারীরিক ভাবে মিলিত হয়ে সন্তানের জন্ম দিক৷ যম সংযত ভাবে উত্তর দিল, ভগিনী তুমি আমার সহোদরা, অতএব, অগম্যা৷ তা ছাড়া সর্বত্রগামী দেবতারা আমাদের উপর নজর রাখছেন৷ যমী বলল, যদিচ কেবল মনুষ্যের পক্ষে এই প্রকার সংসর্গ নিষিদ্ধ, তথাপি দেবতারা এরূপ সম্পর্ক ইচ্ছাপূর্বক করে থাকেন৷ অতএব, আমার যেরূপ তোমার সঙ্গে সঙ্গত হতে ইচ্ছে করছে, তুমিও তদ্রূপ ইচ্ছা কর৷ রজ্জু যেমন ঘোটককে বেষ্টন করে, কিংবা লতা যেমন বৃক্ষকে বেষ্টন করে তুমি আমাকে আলিঙ্গন কর এবং পুত্রজন্মদাতা পতির ন্যায় আমার শরীরে প্রবেশ কর- নি তে মনো মনসি ধায্যস্মে জন্যুঃ পতিস্তম্ব মা বিবিশ্যাঃ (ঋগ্বেদসংহিতা ১০ম মণ্ডল ১০ম সূক্ত/৩)৷ আমি কামার্তা৷ প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর৷ আর তুমি থাকতে নাথবতী হয়েও আমি কেন অনাথবত্‍ এই যৌবন অতিবাহিত করব? এসো, একসঙ্গে শয়ন করি এবং সঙ্গত হই৷ যম বলল, ভগিনীতে যে ব্যক্তি উপগত হয় সে পাপী৷ এই ভাবে যম যমীকে প্রত্যাখ্যান করল এবং কামাভিলাষে প্রায়-মূর্ছিতা যমী যমকে নিতান্ত এক দুর্বল পুরুষ বলে তিরস্কার করে বলল: এ তোমার কী প্রকার মন, কী প্রকার অন্তঃকরণ বুঝতে পারছি না... ঋগ্বেদে কামসর্প-দ্রংষ্ট্র ইভের মতো যমীও এখানে প্ররোচক৷


কিন্তু আদমের মতো যম এখানে প্রলুব্ধ হয়নি, সে কারণে পরবর্তীকালে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে সে ন্যায়াধীশ, পাশ্চাত্য-পুরাণের নরকাধিপতি প্লুটোর মতো স্বেচ্ছাচারী নয়৷ আর সেই জন্য প্রাচ্য যমকে দেখেছে সংযমের মহান প্রতীকরূপে৷ মুনি পতঞ্জলিও তাঁর যোগদর্শনে ‘যম’-কে গ্রহণ করেছেন তাঁর অষ্টাঙ্গযোগের দ্বার-স্বরূপ৷ যমই যোগের প্রথম পাদ৷

মূল কাঠামোয় অপরিবর্তিত থেকেও তাদের সম্পর্ক সেখানে অযৌন নিষ্কাম ও মধুর৷ এ যমীই যমুনা ও যামিনীতে রূপান্তরিত৷ একদিন যমী বাড়ি ফিরে দেখল যম একটি গাছে নিচে যেন বা নিস্পন্দ ঘুমিয়ে আছে৷ শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে না তার৷ যমী বুঝতে পারেনি যে যম স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছে৷ সে আর জাগবে না৷ নিঃসঙ্গ ভ্রাতা-অন্ত-প্রাণ যমী তার শোক সংবরণ করতে পারল না৷ তার কান্না আর থামে না এবং অবিরত অশ্রুধারাই যমুনা-প্রবাহ, যার ক্রম-স্ফীতি এই পৃথিবীকে প্লাবিত করে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে৷ পৃথিবীতে রাত্রি না থাকার ফলে দিবা-রাত্রির পরিবর্তন ছিল না, ফলে সময় বা সময়জ্ঞানও ছিল না৷ তাই দেবতারা রাত্রি সৃষ্টি করলেন৷ রাত্রির পর যখন সূর্যোদয় হল এবং এই ভাবে ক্রমাগত চক্রাকারে আবর্তিত হতে লাগল, তার সময়জ্ঞান হল, অতীতের জ্ঞান হল৷ যমী বুঝল, যম আজ নয়, বহুকাল আগেই মারা গেছে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে প্রবেশ করেছে৷ সময় শোককে প্রশমিত এবং সহনীয় করে তুলল৷ এই রাত্রি বা যামিনীই যমী৷ তাদের এই ভালোবাসা ও বিচ্ছেদ তাদের অমর করে রেখেছে৷

রচনাকাল : ২২/১১/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 3  France : 1  India : 67  Romania : 1  Russian Federat : 1  Sweden : 72  Ukraine : 5  United States : 82  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 1  China : 3  France : 1  
India : 67  Romania : 1  Russian Federat : 1  Sweden : 72  
Ukraine : 5  United States : 82  
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভাইফোঁটা নয় যমদ্বিতীয়া (পৌরাণিক গল্প) চতুর্থ পর্ব by Lakshman Bhandary is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৬৩২১২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী