ভাইফোঁটা নয় যমদ্বিতীয়া (পৌরাণিক গল্প) তৃতীয় পর্ব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ঋগ্বেদ-এর ১০ম মণ্ডলে যম-যমী সংবাদে ভ্রাতার প্রতি ভগ্নীর যৌনাকাঙ্ক্ষার কথা খোলাখুলি ব্যক্ত করা হয়েছিল। যম যমীর প্রস্তাবে অসম্মত হলে যমী তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন, ভগ্নী অতৃপ্ত অবস্থায় থাকলে ভ্রাতারই কর্তব্য তাঁকে শান্ত করা।
কোনটা ‘নৈতিক’, কোনটা ‘অনৈতিক’?
প্রাচীন ইতিহাসের গবেষকরা সে যুগের মানুষের মর্যাালিটি নিয়ে মাঝেমাঝেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁদের চিন্তাটা মূলত এই নিয়ে যে, ‘একাল’-এর নৈতিকতার সঙ্গে কোনওভাবেই খাপ খায় না মহাকাব্যের নৈতিকতা। অথচ, ভারত্র মতো দেশে রামায়ণ ও মহাভারত-কে আদশর্শ গ্রন্থ হিসেবে তুলে ধরার বিভিন্ন প্রয়াস বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়। এর মধ্য হয়তো রাজনৈতিক রফুচক্কর রয়েছে, কোনও বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির ক্ষমতায়নের ভাঁজভুঁজ রয়েছে। সব মিলিয়ে এমন কিছু ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে, যা এ কালে খোলাখুলি আলোচনা হলে সমস্যা দেখা দিতেই পারে।
প্রাচীন গ্রিক ইতিহাস নিয়েও একই বিড়ম্বনা দেখা দেয় খ্রিস্টীয় ইউরোপে। ১৯ শতকের ইতিহাসবিদরা মহাকাব্যিক গ্রিক সমাজকে ‘অনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। একইভাবে, ভারতের মাহাকাব্যের যুগের নৈতিকতা, বিশেষ করে যৌননৈতিকতা নিয়েও বিড়ম্বনায় ভোগেন আজকের ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনীতির প্রবক্তারা। তথাকথিত যুক্তিবাদীরা বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে তাঁদের আক্রমণ করেন। তাঁরা দেখান, ‘আদর্শ’ হিসেবে বর্ণিত টেক্সটগুলিতে এমন কিছু ব্যাপার রয়েছে, যা আজকে ঘটলে শিউরে উঠতে হত।
দেখা যাক তেমন কয়েকটি ‘মহাভারতীয়’ অনৈতিকতাকে।
• মহাভারত-এর ‘আদিপর্ব’-এর ৬৩ অধ্যায়ে ঋষি পরাশর ও মৎস্যগন্ধার মিলন ছিল প্রকাশ্য। আবার, আদিপর্বের-ই ১০৪ তম অধ্যায়ে উত্থতের পুত্র দীর্ঘতমা জনৈকা নারীর সঙ্গে জনসমক্ষেই রমণ করেছিলেন।
• পৌরাণিক যুগে কি ভারতে অজাচার প্রচলিত ছিল? প্রাচীন মিশরের মতো মাতৃগমন বা ভগ্নীগমন কি যথেচ্ছ ছিল? ‘হরিবংশ’ থেকে জানা যাচ্ছে, বশিষ্ঠের কন্যা শতরূপা পিতাকেই স্বামী হিসেবে জানতেন এবং উপগত হতেন। একই গ্রন্থে প্রজাপতি দক্ষ তাঁর কন্যাকে তাঁর পিতার সঙ্গে উপগত হতে বলেছিলেন।
• মহাভারত-এর আদিপর্বে খোলাখুলিই বলা হয়েছিল, যদি কোনও অবিবাহিতা নারী তাঁর কামক্ষুধা চরিতার্থ করতে চান, তবে তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। পরে উলুপী অর্জুনকে এই কথাই মনে করিয়ে দেন যে, কামার্তা নারীর কাম চরিতার্থ করা পুরুষের ‘ধর্ম’।
• ঋগ্বেদ-এর ১০ম মণ্ডলে যম-যমী সংবাদে ভ্রাতার প্রতি ভগ্নীর যৌনাকাঙ্ক্ষার কথা খোলাখুলি ব্যক্ত করা হয়েছিল। যম যমীর প্রস্তাবে অসম্মত হলে যমী তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন, ভগ্নী অতৃপ্ত অবস্থায় থাকলে ভ্রাতারই কর্তব্য তাঁকে শান্ত করা।
• মহাভারত-এই উল্লিখিত রয়েছে, কর্ণের রাজ্য অঙ্গে নারী ও শিশু কেনা-বেচা হত।
এই তথ্যগুলি থেকে যদি কেউ প্রত্যক্ষভাবে ধর্মকে আক্রমণ করতে চান, করতেই পারেন। তবে তা করার আগে এটা মনে রাখা প্রয়োজন, এই নৈতিকতার ইতিহাস মোটামুটি সারা পৃথিবীতেই কমন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘যৌনতার ইতিহাস’-এ প্রাচীন গ্রিকদের উভকামিতা নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একটা জরুরি ইঙ্গিত রেখেছিলেন, সেটা এই— প্রাচীনকে বুঝতে গেলে একটা চিন্তার ব্যায়াম প্রয়োজন। সেই কাল ও পরিসরের উপযুক্ত মহিমার সাপেক্ষে তাকে দেখতে না পারলে তাকে ‘অনৈতিক’ বলে মনে হবেই।
কূটকচালি বলছে, ভাইফোঁটাকে দেখা যেতে পারে সূর্য-সংক্রান্ত উৎসবের প্রেক্ষিতেও। এই যে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া, সে আদতে সূর্যের রূপক। অবাঙালিরা যে রোলির তিলক আঁকেন, তার লাল রঙেও নিহিত রয়েছে সূর্যের তেজ। ধান-দূর্বা বা চালের অনুষঙ্গেও ফিরে আসছে সূর্যের দেওয়া জীবনের আশ্বাস। সূর্যকিরণে পরিপুষ্ট হয় শস্য, সেই শস্যে জীবনধারণ করে মানুষ। এভাবেই যম বা মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা! কেন না, যে ঋতুতে এই উৎসব, সেই হেমন্তের পরেই আসবে প্রবল শীত। তখন তাপমাত্রা কম্পাঙ্কের নিচে নামবে, শৈত্যে মৃত্যু হবে কিছু মানুষের। সেই শৈত্য থেকে এভাবেই প্রিয়জনকে দূরে রাখা!
তাছাড়া, এই কার্তিকের মাপা সময়েই সূর্যের দক্ষিণায়ন ঘটে। উত্তর দিকের অয়নান্তরেখা বা কর্কটক্রান্তিরেখা থেকে এই সময়ে সূর্য ক্রমশ দক্ষিণে সরে যায়। একুশে জুন থেকে বাইশে ডিসেম্বর পর্যন্ত সূর্যের এই দক্ষিণায়নের মেয়াদ। লক্ষ্যণীয় বিষয়, পুরাণ বলছে, যম দক্ষিণ দিকের লোকপাল বা অধিপতি। এভাবেই সূর্যের দক্ষিণায়ন এবং সেই সময়ের উৎসবের সঙ্গে জুড়ে গেলেন যম। পাশাপাশি চোখ রাখতে হবে আরও একটা বিষয়ের দিকে। এই সময়ে দিন ছোট হয়, বাড়তে থাকে রাত্রির কাল। ঋগ্বেদে যমকে দিন আর যমীকে রাত্রি বলা হয়েছে না? দিন ছোট হয়ে যাওয়ার রূপকে কি ঋগ্বেদে এভাবেই যমের মৃত্যুর কথা বলা হল? তার সঙ্গে শীতের প্রসঙ্গ এনে, আরও কাহিনি জুড়ে কালক্রমে একটা ভাই-বোনের গল্প কি তৈরি করল লোকাচার?
রচনাকাল : ২২/১১/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।