অঘ্রানে ধানের খেতে..... সোনা ধানের হাসি
বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (দ্বিতীয় পর্ব)
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
নবান্ন বাংলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। এই নবান্ন শব্দটির মধ্য দিয়েই বোঝা যায় এক সময় সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা ছিল বাংলা।আর সেজন্যই হয়তো নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। তবে গোটা বাংলার থেকে ভিন্ন রীতিতে নবান্ন উৎসব পালন করে উত্তরবঙ্গের প্রাচীন রাজবংশী সমাজ।উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে এই উৎসব কে বলা হয় নতুন খাওয়া বা নতুন খই উৎসব।কেউ বা বলে অগনলক্ষ্মী। অঘ্রান মাসের পয়লা তারিখে রাজবংশী মহিলারা সকাল সকাল ঘরদোর পরিষ্কার করে লেপে মুছে শুদ্ধাচারে জমিতে যান ধানের গুচ্ছকে বরণ করে আনার জন্য।চাইলন কুলায় ধূপ,ধুনা,গোছা(প্রদীপ),গুয়া পান (পান সুপারি),ফুল,জল,নিমচ পাত সাজিয়ে একটি কলার ম্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয় জমিতে পূজো দিতে।সেখানে পাকা ধানের একটি গুচ্ছকে নিমচ পাত(কলার পাতার উপরের দিক টা)দিয়ে মুড়িয়ে তাতে সিদুঁর লাগানো গুয়া পান ফুল,জল নৈবেদ্য দিয়ে পূজা দেওয়া হয়।সেই গুচ্ছটিকেই আবার তুলে নিয়ে কলার ম্যান্ডতে ভরে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসেন বাড়ির গৃহকর্ত্রী।বাড়ির ঠাকুরমারিতে মাটি খুঁড়ে সেই ধানের গুচ্ছ লাগানো হয়।আর দুধ,দই,চিড়া,ফলমুল দিয়ে পূজা করে গৃহকর্ত্রী কাচি দিয়ে সেই ধানের গুচ্ছ কেটে নিয়ে ঘরে তোলেন।এই রীতিকে বলে “ধানের শিষ “নেওয়া। উত্তরবঙ্গে মূলত হেউতি ধানের শিষ নেওয়ার প্রচলন ছিলো।
এরপর অধিকারী ঠাকুর বা ব্রাহ্মণ ঠাকুরকে দিয়ে করানো হয় পার্বণ শ্রাদ্ধ। বাড়ির কর্তা নতুন ধানের চিড়া, আতপ চাল, দই দুধ,ফলমূল নিবেদন করেন তার পূর্বপুরুষ কে। সবার আগে নতুন ধানের খাদ্য সামগ্রী পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যেই গতান করে দেওয়া হয়। নয়া খাওয়ার দিন বাড়িতে দিনের বেলায় প্রসাদ,দই চিড়া এসবই খাওয়া হয়। সন্ধ্যার সময় নতুন চালের ভাত রান্না করা হয়। ভাতের সাথে থাকে ঠাকুরি কলাই বা মাষকলাই এর ডাল, সরিষা শাকভাজা, মাছ বা মাংস আরো নানান রকম তরি-তরকারি।
রান্না হয়ে যাওয়ার পর একটি চেলার উপর কতগুলি কলার ঢোনা রেখে তাতে নতুন ধানের ভাত, সবজি,জল সাজিয়ে বাড়ির বাইরে জমিতে নিয়ে যায় গৃহকর্তা ।সেখানে সেই ঢোনার খাবারগুলি মাটিতে রেখে শেয়াল কুকুরের উদ্দেশ্যে ফুল, জল দিয়ে ভক্তি নিবেদন করে খাবার গুলি রেখে আসা হয়।পশুপাখিদের উদ্দেশ্যে এই যে খাবার ঢোনা নিবেদন করার রীতি একে বলে মাহাবারিকের পূজা। মাহাবারিকের উদ্দেশ্যে নিবেদনের পর বাড়ি এসে সবাই মিলে একত্রে নতুন ধানের অন্ন গ্রহণ করে।
নতুন খাওয়া উৎসবে রাজবংশী সমাজে এক অদ্ভুত শ্রদ্ধার পরিমন্ডল দেখা যায় যা সম্পূর্ণভাবে মৌলিক।বিশ্ব চরাচরে পূর্বপুরুষের যে আত্মা বিলীন হয়ে গেছে তাঁকে সবার আগে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে প্রথম নতুন খাদ্য নিবেদন করা হয় ।সেই সাথে দেখা যায় মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজন্তুর যে সহাবস্থান তার দিকে লক্ষ্য রেখে ভালোবাসার সাথে তাদের উদ্দেশ্যেও নিবেদন করা হয় মাহাবারিকের ঢোনা যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসাকেই পরিস্ফুট করে। এই নয়া খাওয়া উৎসবের মধ্য দিয়ে রাজবংশী সমাজের জীবাত্মা পরমাত্মার প্রতি শ্রদ্ধার এক অনন্য দিক ফুটে ওঠে আমাদের সামনে।
রচনাকাল : ১৮/১১/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।