কালী কালী মহাকালী...... কালরাত্রি দেবী চণ্ডিকা
কতিপয় ডাকাতের কাহিনী।
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
কোথাও ল্যাটা মাছা পোড়া নরবলি দিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘোড়া ছুটিয়ে সেই সময় শুরু হত ডাকাতি। রঘু ডাকাত থেকে বিশু ডাকাতদের এমনই বহু ইতিহাস জমা হয়ে রয়েছে বাংলার আনাচ কানাচে জুড়ে। কালীপুজোর সঙ্গে এই বাংলার ডাকাতদের ইতিহাসের যোগ অবিচ্ছেদ্য। রক্ত চক্ষু মাতৃশক্তির আরাধনায় প্রাণ নিবেদন করলেই লুঠতরাজে সাফল্য আসবে, এমন প্রবাদ সুবিখ্যাত ছিল প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের নানা পর্বে। যে ইতিহাস এখনও উঁকি দেয় বাংলার বেশ কয়েকটি নামী কালীপুজো ঘিরে। হুগলি -বর্ধমান এলাকার ডাকাত কালীর ইতিহাসের ইতিবৃত্ত একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
হুগলির গগন ডাকাতের কাহিনি
এই কাহিনি হুগলির সিঙ্গুরের ডাকাত কালীর। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা ঘিরে বিভিন্ন কাাহিনি প্রচলিত। শোনা যায়,স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরোধিতা করতে বহু জমিদার বাড়িতেই পালন করা হত লেঠেল। এদিকে, ততক্ষণে এলাকায় ত্রাস হয়ে উঠেছে গন ডাকাত। একসময়ে এই এলাকা দিয়ে হুগলিতে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে দেখতে যাচ্ছিলেন শ্রী সারদামা। সেই সময় তাঁর পথ আটকায় গগন ডাকাত। পথ রুদ্ধ হতেই সারদামাকে কালীরূপে দেখতে পায় গগন। এমন অলৌকিক ঘটনায় ভীত গগন ডাকাত এলাকায় প্রতিষ্ঠা করে ডাকাত কালীর মন্দির। কথিত রয়েছে এই কালী মন্দিরে রঘু ডাকাতও বিভিন্ন সময়ে এসে ঘন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কালীমন্দিরে এককালে প্রচলিত ছিল নরবলী।
ল্যাটা মাছ পোড়া দিয়ে ডাকাতি করতে যেতেন রঘু ডাকাত! শোনা যায়, চন্দননগরের অনতি দূরে হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় এক সময়ের ত্রাস ছিল রঘু ডাকাত। নীলকর সাহেবদের হত্যা করে তাদের গাছে ঝুলিয়েও অনেক সময় পালিয়ে যেত এই ডাকাতদল। সেই সময় বাসুদেবপুরের এক কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে রঘু ডাকাত। কথিত রয়েছে, সপ্তমগ্রাম বন্দরে কোনও জাহাজ এসে দাঁড়ালেই তা লুঠ করতে রঘু ডাকাতের দল। আর লুঠতরাজের সাফল্যের জন্যই বাঁশবেড়িয়ার ত্রিবেণীর কাছে রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর ডাকাত কালী। ।যেখানে প্রতিদিন ল্যাটা মাছের পোড়া মাকে অর্পণ করে ডাকাতিতে বের হত রঘু ডাকাত।
রামপ্রসাদকে বলি দিতে যাওয়ার উদ্যোগ ও রঘু ডাকাতের পুজো কথিত রয়েছে, বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেবপুরের এই কালী মন্দিরে একবার এসেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ। সেই সময় রঘু ডাকাতের দল তাঁকে ধরে বলি দিতে উদ্যত হয়। হাড়িকাঠে রামপ্রসাদকে রাখতেই তিনি শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে ওঠেন। এরপরই আচমকা অলৌকিকভাবে নিরস্ত্র হয়ে যায় ডাকাত দল। তারপর থেকে বাঁশবেড়িয়ার ডাকাতে কালীর মাহাত্য ছড়িয়ে পড়ে।
কেলেগড়ের কালী ও ডাকাতি শোনা যায়, জিরাটের কালীগড়ের কালী সম্পর্কেও রয়েছে ডাকাতিকে কেন্দ্র করে এক অজানা কাহিনি। বহু বছর আগে নাকি, এই এলাকার জমিদার কালী পুজোর পর বেড়িয়ে পড়তেন ডাকাতিতে। যদিও তা অস্বীকার করেন পরিবারের সদস্যরা। উল্লেখ্য, কালীগড় থেকে এই এলাকার পুজোর নাম কেলেগড়। সেই ডাকাতের নামও কেলে ডাকাত হিসাবেই পরিচিত ছিল। রাতের অন্ধকারে জমিদার কালিচাঁদকে এখানে সকলে কেলে ডাকাত বলেই চিনত। সেই জমিদারের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে আজএ পুজো হয় কেলের গড়ে।
বর্ধমানের আউশ গ্রামেরপুজো এই কাহিনি বর্ধমানের আউশগ্রাম কেন্দ্রিক বননগ্রামের। এককালে ডাকাতদলের অত্যাচারে জমিদাররা ত্রস্ত ছিলেন। সেই সময় মেটেপাড়ার ডাকাতরা এলাকায় চরম লুঠপাট চালাত। একবার ডাকাতদের আক্রমণের চেষ্টায় সমবেত হয় বননগ্রামের আশপাশের জমিদাররা। হামলা হয় মেটেপাড়ার ডাকাতদের ওপর। সেই সময় শোনা যায়, মা কালী রক্ষা করেছিলেন মেটেপাড়ার ডাকাতদের। সেই সময় থেকেই মেটেপাড়ার ডাকাত কালীর পুজোর প্রচলন আরও জোরদার হয়।
ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদের কালীপুজো শোনা যায়, এককালে প্রহ্লাদ ডাকাত এলাকার কেতুগ্রামের রামসীতা মন্দিরের স্বর্ণালঙ্কার ডাকাতি করতে যায়। সেই সময় পথে এক মহিলাকে ডাকাতদলের একজন আক্রমণ করে। আর মহিলা-স্পর্শের অপরাধে সেই সদস্যকে ডাকাতদলের নেতা প্রহ্লাদ সর্দার এক কোপে ছিন্ন করে দেয় । এরপরই ডাকাত সর্দারের সন্দেহ হয়। ওই মহিলাকে প্রহ্লাদ জিজ্ঞাসা করে তিনি কে? জবাবে মহিলা অলৌকিকভাবে কালীমূর্তি ধারণ করেন। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠিত বামা কালীর মন্দির। পূর্ববর্ধমানের পাণ্ডুক গ্রামে রয়েছে এই বামা কালীরমন্দির।
রচনাকাল : ১৬/১১/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।