ভ্রান্তি বিলাস
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : মোঃ তোফায়েল হোসেন
দেশ : Bangladesh , শহর : Moulvibazar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , আগষ্ট
প্রকাশিত ২৮ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ১৪৪৭৫ জন পড়েছেন।
ভ্রান্তি  বিলাস
মোঃ তোফায়েল হোসেন

পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের নগরী নরওয়ের হ্যামারফ্যাস্ট এর এক কনভিনিয়েন্স স্টোরের পাশেই ছিলাম একটা সময়। বেরিং সাগরের অপরূপ মাতাল স্পর্শ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল সেই সময়টা। তবুও বাউণ্ডুলে জীবন স্থিতি পায়নি, বরং ওখানে কুঁড়িয়েছিল আরও কিছু যন্ত্রণা।
 
প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেই কনভিনিয়েন্স স্টোরে যেতাম। অফ-ডে তে রোদন আর মায়াও আসতো। এ যোগলের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। শুধু বাংলাতে কথা বলায় আমি তাদের পরিচয় জেনে গেলাম- এরা বাঙ্গালি। তবে কেন জানি নিজের পরিচয় তাদের কাছে দিলাম না! একজন বিদেশী হিসেবেই রইলাম। 

কনভিনিয়েন্স স্টোরের এক কোণে বসার ব্যবস্থা ছিল। ওখানে বসে তারা ফাস্ট ফুড খেত আর প্রেমালাপ জমাতো। আমিও বসতাম আশেপাশে। চারপাশে শুধু বিদেশী, তাই তারা র্নিদ্বিধায় বাংলায় তাদের প্রেম প্রেম খেলা চালিয়ে যেত। তাদের কথাগুলো আমাকে মুগ্ধ করতো। পৃথিবীর সব সুখ যেন এরা বহন করে চলছিল। এত প্রেম, এত বিশ্বাস, এত মুগ্ধতা আমি আর দেখিনি। তবে আমার কাছে কেন জানি এটা মনে হতো- ভালোবাসা বিনিময়ে মায়া রোদনের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে।
 
হঠাৎ একদিন গণ্ডগোল বাঁধলো। বরাবরের মতো সেদিন রোদন আগেই এসেছিল। মিনিট দশেক পরে এলো মায়া; অনেকটা বিচলিত ও অগ্নিমুর্তি হয়ে। সরাসরি রোদনের সামনে দাড়ালো। লোকজন কিছু ‍বুঝে উঠার আগেই ঠাস ঠাস করে দু’টি চড় বসিয়ে দিল রোদনের গালে। স্টোরে জনাদশেক লোক ছিল। সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল মায়া আর রোদনের দিকে। পিন পতন নিরবতা নেমে এলো ঘরময়।
 
“তোমাকে কি আমি নিষেধ করিনি? কেন বারবার নিষেধ করার পরও আমাকে ই-মেইল করো, এসএমএস করো। তোমাকে তো আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি- তোমার সাথে আমার যা ছিল তা হলো অবসর যাপন; এটা ভালোবাসা নয়। ‍ভুলে যাও সব।” 

হ্যাঁ; আমার স্পষ্ট মনে আছে, মায়া এভাবেই বলেছিল রোদনকে। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল চৌঁকাঠ পেরিয়ে। আর রোদন যেমন ছিল তেমন রইল অনুভূতিহীনদের মতো।
 
সেখানে কেউ মায়ার কথাগুলো না বুঝলেও আমি বুঝেছিলাম। রোদনের কষ্ট আমাকে ছুঁয়ে গেল। তাই নিজের সিট ছেড়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম। আলতো করে একটা হাত রাখলাম টেবিলে রাখা রোদনের হাতের উপর। বললাম- “ভুলে যাও। এটাকে একটা দুর্ঘটনা ভাবো। সত্য মিথ্যা জানি না তবে আমার মন বলছে- ওই মেয়েকে নিয়ে তুমি কোনদিনও সুখী হতে না।”
 
রোদন অশ্রুসজল চোখ তুলে আমার ওপর ঝাপসা দৃষ্টি দিল। সে হয়তো ভাবেনি এ রকম অবস্থায় একজন বাঙ্গালি তাকে সান্ত্বনা দিতে আসবে। 

লোকজনের উৎসুক দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের ওপর। অসস্তিতে ভোগছে রোদন। আমি তাকে হাত ধরে দাড় করালাম। বেরিয়ে এলাম বাহিরে।
 
পাশেই গ্যাস স্টেশন। একপাশে একটা ফুলের বাগান। বাগানের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। রোদন জানালো- আজ তিন বছর তাদের সম্পর্কের। কিন্তু হঠাৎ করেই গত অফ-ডে’র পরেরদিন থেকেই মায়া পরিবর্তন হয়ে গেল। কোন কারণ ছাড়াই মায়া তাকে ত্যাগ করতে চাইল। কৈফিয়ত চাইলে সে কোন কৈফিয়ত দিতে পারল না। এরপর একসময় সে এখানে আসার জন্য বললো। তারপর এখানে এসে সে আমাকে কি কৈফিয়ত দিয়ে গেল তা তো শুধু আপনি নয় আরও কয়েক জোড়া চোখে দেখলো।
 
আমার যতটা সাধ্য ছিল তার সবটা দিয়ে রোদনকে সান্ত্বনা দিলাম। তারপর বিদায় নিয়ে চলে এলাম নিজের কক্ষপথে। 

পরদিন সন্ধ্যায় সেই কনভিনিয়েন্স স্টোর থেকে একটা ছেলে আসলো আমার রুমে। ছেলেটি আমার ঠিকানা খুব ভালো করেই চিনত। সে জানালো- গত দিনের চড় খাওয়া সেই যুবক বিকেলে তাদের স্টোরে এসেছিল। তাকে কিছু ডলার দিয়ে অনুরোধ করে এই খামটা আমার কাছে পৌঁছে দেওয়ার।
 
ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে খামটা খুললাম। একটা চিঠি আর মুখ বন্ধ করা আরেকটা খাম। সেই খামের ওপর মায়ার নাম ঠিকানা লিখা। চিঠিটা পড়লাম। রোদন খুব আবেগ নিয়ে আমাকে তার ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে চেয়েছে। তারপর অনুরোধ করেছে মুখ বন্ধ খামটা মায়ার কাছে পৌঁছে দিতে।
 
এখনই মায়ার ঠিকানায় যাব সিদ্ধান্ত নিলাম। রেডি হয়ে বেরিয়ে এলাম বাহিরে। কনভিনিয়েন্স স্টোরের পাশের গলির মুখে মানুষের ভিড় দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। ভিড়ের কেন্দ্রে পড়ে আছে রোদনের প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহ। তা দেখে আমি যেন শূন্যে ভাসতে লাগলাম। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।
 
পুলিশ এলো। কনভিনিয়েন্স স্টোরের বধৈলতে গত সন্ধ্যার ঘটনা এবং আমার কাছে রোদনের দেওয়া খামের কথাও প্রকাশ হলো। পুলিশের মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। যা জানি জানালাম। রোদনের পাঠানো চিঠি আর মুখ বন্ধ করা খামটাও তুলে দিলাম পুলিশের হাতে।
 
পুলিশ মায়াকে খুঁজে পেল না। তবে সেই মুখ বন্ধ খাম খুলতেই প্রকাশ হলো- রোদন আত্নহত্যা করেছে। সে মায়াকে লিখেছিল তার স্বপ্নের কথাগুলো। লিখেছিল তার ভালোবাসার কেন্দ্রে যে মায়া ছিল সেই মায়াকে সে স্বাধীন করে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে।
 
হ্যামারফ্যাস্টে আরও চার মাস ছিলাম। মাঝে মাঝে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে মায়ার খোঁজ নিতাম। কিন্তু মায়া তখনো ধরা পড়েনি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
 
বছরখানেক পরে হাডসন উপসাগরের তীরে ম্যাপল পাতার দেশ কানাডার চুরচিলি বন্দরে অবসর কাটাচ্ছিলাম। টাকা পয়সারও বেশ টানাটানি চলছিল তখন। এমন সময় একদিন এক ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় হলো। কথাবার্তার ফাঁকে উনি জানালেন- বেশ কয়েক দিন ধরে আমার মতো কাউকে খুঁজছেন তিনি। লোভ দেখানো স্বরে এটাও জানালেন- এ কাজের জন্য বেশ কিছু কানাডিয়ান ডলারও বরাদ্দ আছে।
 
আমি কাজটা কি জানতে চাইলে বললেন- উনার পঞ্চাঁশ উর্ধ্ব বয়সের বড়লোক ব্যবসায়ি স্বামীর একটা ব্যবসা আছে কালগেরির কাছাকাছি। প্রায়ই ভদ্রলোককে ওখানে যেতে হয়। কিন্তু বেশ কিছু দিন যাবত উনার চাল-চলনে কিছু অসামাঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে। ওখানে গেলে ভদ্রলোক ফিরতে বড্ড দেরি করেন। জিজ্ঞাস করলে সদুত্তর পাওয়া যায় না। তাই আমি যদি ভদ্রলোকের পিছু পিছু ওখানে গিয়ে বিষয়টা একটু পর্যবেক্ষণ করে প্রমাণসহ জানাই তবে বরাদ্দকৃত ডলার আমার হয়ে যাবে।
 
ভদ্রমহিলার কথা শুনে মনে মনে না হেসে পারলাম না। নিচক একটা সন্দেহ ছাড়া আর কিছু নয় এটা। তবে এতে তো আমার কোন ক্ষতি হচ্ছে না। বরং কিছু কামাই হবে এ কথা ভেবে সম্মতি দিলাম। উনি অর্ধেক ডলার পরিশোধ করে উনার যোগাযোগের ঠিকানা, উনার স্বামীর একটা ছবি এবং ভদ্রলোককে কোথায় পাওয়া যাবে তা বলে; কাজ শেষে বাকি ডলার পরিশোধের আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিলেন।
 
ভদ্রলোকের পিছু পিছুই কালগেরিতে গিয়ে পৌঁছিলাম। ভাগ্য আর বুদ্ধির সংমিশ্রণ ঘটলো ওখানে। চেষ্টা করে এমন একটা হোটেলে উঠতে সক্ষম হলাম যা ছিল ভদ্রলোকের হোটেলটার একদম পাশাপাশি। শুধু রাস্তার এপাশ ওপাশ।
 
ভদ্রলোকের রুম পাঁচতলায় আর আমার রুমটা ছয়তলায়। এমন একটা অ্যাঙ্গেল বেচে নিলাম যাতে জানালার পর্দা সরালেই ভদ্রলোকের রুমের ভেতরটা দেখা যায়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। জানালার পর্দাগুলো টানা থাকতো সব সময়।
 
দ্বিতীয় দিন ঘটল ঘটনাটা। একটা মেয়েকে ঐ হোটেলের দিকে হেটে যেতে দেখলাম, যার শারীরিক কাঠামোটা আমার খুব পরিচিত মনে হলো। তবে র্দূভাগ্য তার মুখটা দেখতে পেলাম না। এরপর আরও কয়েকবার পিছন থেকে দেখেছি তার কাঠামোটা, তবে প্রথমবারের মতো এতটা আগ্রহী হয়নি মন।
 
ভদ্রলোক তার ব্যবসার জন্য নিয়মিত দৌড় ঝাঁপ করে যাচ্ছেন আর আমি একজন স্পাইয়ের মতো তার ছায়ায় হেটে বেড়াচ্ছি তার অজান্তে। কোন অসংগতি ধরা পড়ল না। তবে সেই অর্ধেক ডলারের জন্য এই স্বাভাবিক কাজ কর্মের ছবি তুলে রাখতে কোন ভুল করলাম না।
 
পঞ্চম দিন সন্ধ্যায় আবারও দেখলাম সেই মেয়েটাকে একটা কার্ণিশওয়ালা হেট মাথায় দিয়ে হেটে যাচ্ছে ঐ হোটেলটার দিকে। মুখটা অন্ধকারে ঢাকা থাকায় এবারও তাকে চিনতে পারলাম না। হেটে গিয়ে ঢুকে পড়ল হোটেলে। 

পৃথিবীতে একজনের মতো আরেকজনের শরীর এরকম অনেক আছে। তাই মনটা আগ্রহী হলেও তেমন সাড়া দিল না। হয়তো সে ওখানকার স্টাফ। আর নিজেও মনে করতে পারছি না আসলে মেয়েটাকে কার মতো লাগছে। তাই ভুলে গেলাম তার কথা।
 
রাত দশটা নাগাদ টয়লেটে ঢুকলাম একটু ফ্রেস হতে। রাস্তায় কিসের একটা আওয়াজ হলো হঠাৎ করে। গাড়ির চাকা ব্রাস্ট হয়েছে হয়তো। কিন্তু কি ভেবে যেন টয়লেটের ছোট জানালা দিয়ে বাহিরে দৃষ্টি দিলাম। সাথে সাথে একটা জিনিস ধরা পড়ল দৃষ্টিতে। আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি ঐ ভদ্রলোকের টয়লেটের ভিতরটা। এটা একটা নির্মাণ ত্রুটি। তবে যাই হোক, আমার দৃষ্টি আটকে গেল টয়লেটটার ভেতরে।
 
দেখলাম সেই মায়া আর ঐ পঞ্চাঁশ উর্ধ্ব লোকটা আদিম খেলায় মেতে আছে শাওয়ারের নিচে। দৃশ্যটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল সেই হেটে যাওয়া মেয়েটার কথা। ও তো মায়া ছিল। 

রোদনের রক্তাক্ত দেহটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে খুব কষ্ট হলো। ক্যামেরার লেন্স যতটা সম্ভব সঠিক রেখে কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর চুপ করে নেমে এলাম নিচে। হাটা দিলাম ঐ হোটেলটার দিকে।
 
অনেক কষ্টে কিছু তথ্য বের করতে পারলাম। মায়া ওখানকার কোন স্টাফ নয়। ঐ ব্যবসায়ি লোকটা এলেই নাকি মেয়েটা আসে। তারা নাকি ব্যবসায়িক পার্টনার। ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম নাকি এখানেই করে তারা।
 
আমি মায়ার মুখোমুখি হতে চাইলাম। কিন্তু নিজেকে নিয়ে অনেক সংশয় ছিল। রোদন নামের সেই যুবকের মায়াবী মুখটা আমাকে দিশেহারা করে দিল। রোদনের আত্মা যেন আমার ওপর ভর করলো। ইচ্ছে হলো মায়াকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে। তাই অনেক ভেবে সিদ্ধান্তে এলাম- মায়ার ছায়ায় আমি দাড়াব না।
 
নিজের রুমে ফিরে এসে সেই ভদ্রমহিলাকে কিছু ছবিসহ একটা ই-মেইল করলাম। আর ফোনে জানিয়ে দিলাম- আমার বাকি ডলারগুলো নিয়ে তিনি যেন কালই এখানে চলে আসেন।
***
রচনাকাল : ১৭/৯/২০২০
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 10  Canada : 2  China : 9  Europe : 1  France : 5  Germany : 2  Hungary : 11  India : 165  Ireland : 4  Japan : 1  
Romania : 1  Russian Federat : 15  Saudi Arabia : 7  Sweden : 13  Ukraine : 6  United States : 163  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 10  Canada : 2  China : 9  Europe : 1  
France : 5  Germany : 2  Hungary : 11  India : 165  
Ireland : 4  Japan : 1  Romania : 1  Russian Federat : 15  
Saudi Arabia : 7  Sweden : 13  Ukraine : 6  United States : 163  
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভ্রান্তি বিলাস by Md. Tofayel Hossen is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৫২৪
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী