মুম্বাই এক স্বপ্নের শহর যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন অনেকেই দেখে , এক মায়া নগরী যেখানে দিন শুরু হয় ব্যস্ততার সাথে এবং সারাদিন শহর ছুটে চলে অবিরাম ভাবে নিজের নিজের গন্তব্যের উদ্দ্যেশে। আমার নিজের স্বপ্ন ছিলো একবার মুম্বাই যাওয়ার , শহরটাকে দেখার , আর তাই বেরিয়ে পরলাম । আমার মামাতো দাদার বাড়ি মুম্বাইয়ে , সেইখানে গিয়েই উঠলাম। দাদা অনেকবারই আসতে বলেছিলো আগে কিন্তু কাজের চাপে আর সময়ের অভাবে মনের মধ্যে ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি , শেষমেশ এইবার হলো ।
২৫শে ফেব্রুয়ারী গিয়ে পৌঁছলাম কোলকাতা বিমানবন্দর থেকে বিকেলের ফ্লাইটে গো এয়ারে মুম্বাই , ফ্লাইটে সময় লাগে ২ঘণ্টা ৪০ মিনিট , ফ্লাইট আমি আগেও অনেকবার চরেছি , বরাবর ভালোই লাগে আর এবারো মন্দ লাগলো না । মুম্বাই এয়ারপোর্ট সত্যি মুগ্ধ করার মতো , কোলকাতা বিমানবন্দর থেকে অনেকটা বড়ো আর রাতের আকাশে যখন রাতের মুম্বাই শহরটাকে দেখছিলাম মনের মধ্যে তখন এক অজানা আনন্দ ভিড় করেছিলো , যে শহরটার এতো গল্প শুনেছি , আসার জন্য এতো স্বপ্ন দেখেছি সেই শহর আমার চোখের সামনে , রাতের আলোয় চিকচিক করছে , যেনো কেউ মণিমানিক্যে সাজিয়ে তুলেছে পুরো শহরকে ।
দাদার বাড়ি আন্ধেরি ইস্ট এরিয়ায় , এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ওখানকার বিখ্যাত অটো রিকশো করে পৌঁছে গেলাম আন্ধেরি , সময় লাগলো মিনিট পঁচিশ । দাদারা থাকে কমপ্লেক্সে , পৌঁছতেই দাদা আমায় দেখে খুব খুশি হলো , আর হবেই না বা কেনো , কতোবার আসতে বলেছে আর আমি শেষমেশ এলাম । খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম আর বিছানাতে গা এলাতেই ঘুম , আসলে খুব টায়ার্ড ছিলাম তাই।
ভোর হলো , এক নতুন সকাল তবে অন্যদিনের থেকে অনেক আলাদা , কারণ আমি তো তখন এক নতুন শহরে , নতুন মানুষজন , নতুন সবকিছু , তাই অনেক কৌতূহল লুকিয়ে ছিলো এগুলো দেখার । বেলা বারতেই দাদার সঙ্গে বেরিয়ে পরলাম দাদার অফিসে , দাদার অফিস আন্ধেরি ওয়েস্টে , যাওয়ার সময় দেখছিলাম রাস্তাঘাট , গাড়িঘোড়া সবকিছু । দাদার মুখেই শুনলাম এই শহরে বাইক খুব একটা চলে না , অধিকাংশ লোকই স্কুটি চালায় ,আর ওখানে ট্যাক্সি খুব কম চলে ,তার জায়গাতে চলে অটো সর্বত্র আর সকলেরই জানা আছে মুম্বাইয়ের অটো ফেমাস । আরো দেখলাম ওখানে এখনো ডবল দেকার বাস চলে ।খুব ভালো লাগলো দেখে। এবার আসি খাওয়াদাওয়াতে , মুম্বাইয়ে প্রচুর স্পাইসি খাবার আছে , মিসাল পাও , বারা পাও , পাও ভাজি , মাসালা চাটনি পাও , সবই বিখ্যাত খাবার কিন্তু সত্যি বলতে আমার তেমন ভালো লাগেনি , কোলকাতার স্পাইসি খাবার ধের ভালো তবুও প্রথমবার খেয়েই ফেললাম প্রত্যেকটা , তারপর পানিপুরি , সেও পুরি , এখানে আমরা যেটাকে দই ফুচকা বলি সেটাই , তবে আগাম বলে রাখছি কেউ কিন্তু পানিপুরি ট্রাই করবেন না , একদমই ভালো না , ঘুগ্নিসেদ্ধ ভরে দেয় ,যাইহোক ট্রাই করেই ফেললাম।
এরপর দিনগুলো বেশ ভালোই কাটতে লাগলো , সকালবেলা উঠে হাটতে যাওয়া , সকালের নীরবতায় শহরটাকে চেনা , ওহ হ্যাঁ রোজ সকালে হেটে আসার পথে এক কাপ চা খেতাম অবশ্যই , ওখানে গেলে কিছু না খেলেও চা ট্রাই করবেন , সত্যি অমৃত আর ওখানে লিকার চা কে কাটিং বলে , স্বাদে অসাধারণ । মুম্বাইয়ে দেখার মধ্যে অনেক জায়গাতেই গেছিলাম , যেমন ওখানকার প্রধান আকর্ষণ জুহু চৌপাটি ,সিলভার বিচ এক কথায় যেন স্বর্গ , আমি গেছিলাম সূর্যাস্তের সময় তাই আমার অতুলনীয় লেগেছিল , জুহু বিচ একটু বেশি ভিড় থাকে , আমাদের এখানে যেমন দিঘা তবে পাশেই সিলভার বিচ সেটা অতটা ভিড় থাকে না। তো এই বিচে ট্রাই করলাম , ভুট্টা এক কথায় ফাটাফাটি , আর মুম্বাই কা গোলা , ফেমাস এখানকার। আমি খেলাম কালাখাট্টা গোলা , দারুন দারুন লাগলো । এখানে মুম্বাইয়ে বিচের সব থেকে ভালোলাগার জিনিস হলো এখানে আপনি সমুদ্রের সামনে বসে যেনো এক অন্য স্তরে হারিয়ে যাবেন , এতো মনোরম এতো সুন্দর লাগে , একটা মাদুর পেতে বসে পরলে আপনার উঠতেই ইচ্ছে করবে না , মনে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। বিচের পাশেই মাদুর পাওয়া যায় ,দাম ৩০ টাকা । একদিন গেলাম সন্ধেবেলা ব্যান্দ্রা দিকে , মুম্বাইয়ের যতো রুপোলী পর্দার কলা কুশলীরা সব ব্যান্দ্রা সাইডেই থাকে , দেখলাম মান্নাত , ল্যান্ডস এন্ড , গ্যালাক্সী , জলসা । এগুলো হলো শারুখ খানের বাড়ি , সাল্মান খানের বাড়ি এবং অমিতাভ বাচ্চানের বাড়ি। সবার বাড়ির সামনেই গেছি , সব জায়গাতেই ভিড় লেগেই থাকে , কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে সেলফি তোলার জন্য । ব্যান্দ্রা ব্যান্ডস্ট্যান্ডের কাছেই আরেকটা বিচ আছে যেটাকে বলা হয় ব্যান্দ্রা বিচ , এটাও এক কথায় অসাধারণ। এরপর গেলাম একদিন মাউন্ট মেরী চার্চ , সেটাও ব্যান্দ্রাতেই , মোম জ্বালিয়ে প্রার্থনা করলাম প্রভু যীশুর সামনে সকলের মঙ্গলকামনাতে , বিশ্বাস করুন মনটা ভালো হয় গেলো । এরমধ্যে দুদিন গেছিলাম মুভি দেখতে আন্ধেরি ওয়েস্টে , সিটি মলে , আমাদের এখানকার ইনক্সের মতোই , খুব ভালো লাগলো গিয়ে ...একটা আলাদাই অভিজ্ঞতা , মুম্বাইয়ে বসে মুভি দেখছি , দারুন এক অনুভূতি । একদিন মল ঘুরলাম , ও হ্যাঁ ওখানে বিখ্যাত মলে যদি যেতে চান তাহলে চলে যাবেন ফিনিক্স মল অথবা অরবিট মল ...আমাদের এখানে যেমন কোয়েস্ট বা সাউথ সিটি মল।
একদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর গেছিলাম মেইন শহরের দিকে ,হ্যাঁ বিখ্যাত কোলাবার দিকে , হ্যাঁ যেখানে রয়েছে বিখ্যাত গেটওয়ে আর তাজ পেলেস যা ২৬/১১তে প্রধান হামলা হয়েছিলো , হ্যাঁ ওইখানেই গেছিলাম সি লিঙ্ক হয়ে ...অভিজাত দিক এটা মুম্বাইয়ের ...ওখানে ডিনার করলাম বড়ে মিয়াঁ তে , ওখানকার ফেমাস হোটেল । তারপর ঘুরে দেখলাম গেটওয়ে , হারবার পয়েন্ত , তাজ পেলেস আর লিওপল্ড ক্যাফে । তারপর দেখলাম ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম , আম্বানি হাউস , নরিমান পয়েন্ত , ট্রাইদেন্ত আর অবেরয় হোটেল। পাশেই মুগ্ধ করা , মায়াবী কুইন্স নেক্লেস , যেটাকে মেরিন ড্রাইভ নামেও বলা হয় , দূর থেকে দেখলে মনে হবে হীরের নেক্লেস চকচক করছে এমন ভাবেই সুসজ্জিত । অনেকক্ষণ বসে ছিলাম ওখানে , ফেরার পথে দেখলাম হাজি আলি দর্গা তবে দূর থেকেই আর দেখলাম ধারাভি ...সবথেকে বড়ো চল , আমাদের এখানে আমরা যেটা বস্তি বলি ওটাই ওখানে চল...জায়গাটা অবশ্য খুব একটা ভালো না , এক কথায় ভুলভুলাইয়া। একদিন গেছিলাম লোখান্ডওয়ালা মার্কেট , আমাদের এখানকার নিউ মার্কেট ধর্মতলার মতো , যা কেনার ওখানে কিনতে পারেন , অনেক সস্তায় হয় আর হ্যাঁ ওখানকার যারা সিরিয়ালে অভিনয় করেন ওনারা ওখানেই থাকেন। একদিন গেলাম ভারসভা বিচ , দুরদান্ত লেগেছিলো সূর্যাস্তের সময়। ফেরার আগের দিন গেছিলাম মাদ আইল্যান্ডে , ফেরিঘাট পার করে যেতে হয় , জায়গাটা কোলাহলের অনেক দূরে , পুরো নিরিবিলি , ফেরিঘাট পার করে চলে গেছিলাম আক্সা বিচে , আমার দেখা সেরা বিচ , অনেক মানে অনেকটাই নিরিবিলি , অসাধারণ বললেও বোধহয় অনেক কম বলা হবে , অনেকক্ষণ ছিলাম , প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ওখানে , খেলাম কান্দা ভাজ্জি , ভেজ ম্যাগি , ভুট্টা , সেও পুরী , তারপর একটু রাত হতেই ফেরিঘাট ক্রস করে আবার বাড়ি ফেরা।
আমি দাদার বাড়ি , অর্থাৎ মুম্বাইয়ে ছিলাম ২৫শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ , ১০ সেই মার্চ আমার ফ্লাইট ছিলো ফেরার বেলা ১১.৪০ এর। মনটা খারাপ হয়ে গেছিলো যে এতদিন একটা জায়গায় থাকার পর চলে যেতে হচ্ছে আবার কবে আসবো তার ঠিক নেই , মন খারাপ লাগলেও এই কদিনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে বিদায় জানালাম স্বপনের শহরকে আর দাদাকে আর রওনা দিলাম।
বেলা ১১.৪০ এ ইন্দিগোর ফ্লাইটে ফিরলাম কোলকাতা ।
আমার কাছে এই শহরটা একটা স্বপ্নের শহর যেখানে সবাই প্রত্যেকদিন হাজার হাজার স্বপ্ন নিয়ে যায় , সেই শহর যা ব্যাস্ততার মধ্যে ছুটে চলে নিজের গন্তব্যে...
রচনাকাল : ১৫/৯/২০২০
© কিশলয় এবং আকাশ দত্ত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।