ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (দশম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ভাদু তুমায় আনব্য মা গ পুজব সব্বাই আজিকে
রাখব তুমায় যতন কইর্যেই মাণিক হঁইয়ে থাকব্যে বুকে
সোনার বাঁউটি দিব ভাদু যায়ো না’ক কুথাকে
আমার ঘরে থাক মা গ গড় করি মা তুমাকে…
ভাদ্রমাসে ভাদুর জন্ম ও মৃত্যু। তাই সারামাস ধরে ভাদুর আরাধনা করা হয়। আমাদের ভাদুমণি, রাজকুমারী ভদ্রাবতী। ছোট্ট একরত্তি এক আঞ্চলিক দেবী যিনি আসেন আদিবাসী অধ্যুষিত পূর্বেকার জঙ্গলমহল আর মানভূমের ঘরে ঘরে। বলতে গেলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম জেলার কিছু অংশে আর মানভূম ঘেঁষা বর্ধমানের কিছু জায়গায়। ভাদু দেবীর কাহিনি রূপকথার মতো।
শোনা কথা, ভাদুর গল্প, কাহিনী। মানভূমের ঘরে ঘরে শোনা যায় ভাদুর দুঃখের কাহিনি। তাই তো সেই দুঃখে দুঃখী হয়ে মেয়েরা আরাধনা করে ভদ্রাবতী নামে মানভূমের পঞ্চকোট রাজার সেই পালিতা কন্যাকে যিনি রাজকন্যা ভদ্রাবতী, আবার দেবী হয়ে ভাদু নামে পূজিতা হন ঘরে ঘরে। এ যেন ভাদুর দুঃখের বারমাস্যা যা লোককথা হয়ে প্রচারিত হয় মেয়েদের গানে গানে।
তাঁকে আনা হয় আদর করে, পুজো করা হয় আদর করে। তুমি থাক আমাদের মাঝে, আর চলে যেওনা তোমার প্রেমিকের খোঁজে দূর- দুরান্তরে। আমরা তোমায় যতন করে রাখব আমাদের মাঝে।
মানভূমের পঞ্চকোট রাজ্যে রাজা নীলমণি সিংদেও এর রাজত্ব। তাঁর রাজত্বের সীমানায় এক গ্রামে রাজার কাছে সন্ধান মিলল এক পরমাসুন্দরী সুলক্ষণা কন্যার, যিনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। রাজা সেই কন্যাটিকে চাইলেন নিজের কন্যা রূপে গ্রহণ করতে। কিন্তু মেয়েটির পিতা তাতে রাজি নন। রাজা শেষে সেই মেয়েটিকে রাজার ঘরের মেয়ের মত সুখ-সুবিধা দিয়ে নিজের কন্যারূপেই দেখতে লাগলেন। পিতার ঘরে রাজকন্যার মত বড় হতে লাগলেন ভদ্রাবতী।
দেশে তখন সিপাহী বিদ্রোহের ঝড়। রাজা নীলমণি সিংদেও ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হলেন। জেল থেকে ফিরে এসে শুনলেন রাজকন্যা ভদ্রাবতী কবিরাজের পুত্রের প্রেমে পাগলিনী। কোন কবিরাজ? তিনি সেই গাঁয়ের, নাকি পাশের গাঁয়ের লোক? কি নাম সেই কবিরাজ পুত্রের? কেউ বলে তাঁর নাম অঞ্জন, আবার কেউ বলেন –কি কইর্যে জানব্য, আমরা কি দেখ্যেছি? সুনা কথা, যেমন সুনি, তেমনি জানি’।
বীরভূম অঞ্চলে প্রচলিত আছে যে, ভদ্রাবতী হেতমপুর রাজপরিবারের কন্যা। আগেই বলেছি, লোককথা বা রূপকথা রূপান্তরিত হয়, পরিবর্তিত হয়। সেভাবেই এই লোকথাগুলিও এত বছর ধরে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে নতুন আকার ধারণ করেছে।
ভাদ্র মাসের আজকের দিনটিতে তাঁর পূজা, পূজার পর তাঁকে স্থানীয় নদীর জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। আগে ভাদুর কোন প্রতিমা বা মূর্তিপূজার চল ছিল না। ঘরের কুলুঙ্গিতে একটি পাত্রে কিছু ফুল রেখে তাঁকে কল্পনা করে ভাদু গান গাওয়া হত।
কিন্তু বর্তমানে ভাদুর প্রতিমা বা মূর্তি নিয়ে আসা হয়। কোন কোন মূর্তির কোলে থাকে কৃষ্ণের ছোট একটি মুর্তি। কখনও বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি। এই ভাদুকে কেন্দ্র করে চলে গান, নাচ। গানগুলি মূখ্যতঃ প্রেমের গান, বিবাহের গান, দুঃখের বারমাস্যাও আছে যা ভাদুর কাছে মনের কথা ব্যক্ত করেন মেয়েরা, কুমারীরা। একদা রাজকন্যা ভদ্রাবতীও যে কুমারী! আছে প্রেমিকের জন্য, প্রেমের জন্য আত্মোৎসর্গের কথাও। ভাদু, ভদ্রাবতীর জীবনদানও তো প্রেমের জন্যই! হয়ত সে কারণেই ভাদু প্রতিমায় কোলে থাকে কৃষ্ণের বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি, যা চিরন্তন প্রেমের প্রতীক।
আজ ভাদু-পুজার দিনে তাঁর উদ্দেশে বলি—
ভাদুমণি দুখ পাঁইয়েছ্যে বেথা তাকে দিও না
ভাদু বিটি বড় দুখী, তুমরা কিছু বইল্য না……
[ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে পুজো করেন গ্রামের মেয়েরা। আবার বহু জায়গায় লক্ষ্মীর আদলে ভাদু মূর্তিও তৈরি হয়। প্রসাদ হিসেবে তৈরি হয় বিশেষ জিলিপি আর খাজা। এই নিয়ে একটি আঞ্চলিক ভাদুগান ও আমার গীতিকবিতা।]
আঞ্চলিক ভাদুগান ও আমার গীতিকবিতা (দশম পর্ব)
কথা - আঞ্চলিক সুর - অপ্রচলিত
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ভাদু তুমার তরে,
রসগোল্লা এন্যাছি মালসায় করে।
বর্ধমানের মিহিদানা গো.... সীতাভোগ আর মতিচুর,
আয় সরলা, আয় কমলা, শ্বশুর-শাশুড়িকে দিবি তুর।
ভাদু তুমার তরে,
রসগোল্লা এন্যাছি মালসায় করে।
লবশনের মোরব্বা ভালো গো হিজলগড়ার বাতাসা,
শক্তিগড়ের ল্যাংচা ভালো খ্যাইলে মিটিবেক আশা।
ভাদু তুমার তরে,
রসগোল্লা এন্যাছি মালসায় করে।
দুবরাজপুরের কদমা ভালো গো দোমাহানির জিলিপি,
আয় সরলা, আয় কমলা বল না মিষ্টি তুই খাবি কি?
ভাদু তুমার তরে,
রসগোল্লা এন্যাছি মালসায় করে।
জামুড়িয়ার খাজা গজা গো রাণীগঞ্জের চিত্তরঞ্জন,
আসানসোলের রাজভোগ খ্যাইলে পরে ভরে মন।
ভাদু তুমার তরে,
রসগোল্লা এন্যাছি মালসায় করে।
রচনাকাল : ১১/৯/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।