(কল্পবিজ্ঞানের গল্প)
ইমারা
মোঃ তোফায়েল হোসেন
ইয়াকুব আলী একজন জন্মান্ধ মানুষ। তার বয়স যখন তিন বছর তখন যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গেলেন। সে সময় তারা শহরের পাশে একটা বস্তিতে থাকতেন। ইয়াকুব আলীর পরিবার এমনিতেই মানবেতর জীবন যাপন করতো; তাই সংসারের একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি মারা যাওয়ায় মা আর ছেলের দিনগুলো অনাহারেই কাটতে লাগলো।
বারো বছর বয়সে অন্ধ ইয়াকুব আলী মাকেও হারলেন। বাবা মারা যাওয়ার সময় তার বুঝ না থাকলেও, মা মারা যাওয়ার সময় যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তার মা’ও বাবার মতো একটা জটিল রোগে ভোগে মারা গেছেন। ইয়াকুব আলী পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছিল তার মায়ের নাকি ক্যান্সার হয়েছিল।
ইয়াকুব আলীর একমাত্র মা বাবা ছাড়া আত্মীয়-স্বজন আর কেউ ছিলেন কি-না তা তিনি জানতেন না। কখনো কোনোদিন সে রকম কারও উপস্থিতি তিনি অনুভব করেননি। তবে তার মা তাকে একাকীত্ব বুঝতে দেননি কখনো। অন্ধ ছেলের প্রতি মায়ের বিশেষ একটা দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদাই ছিল। তাই মা মারা যাওয়ার পরই তিনি নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে পারলেন। আর তখনই নিষ্টুরতার মুখোমুখি হলেন। মা হারানোর ছয় দিনের দিন বস্তির সেই ঘর থেকে তাকে বের করে দেওয়া হলো।
তিনি রাস্তায় নেমে এলেন। জীবিকা নির্বাহের পন্থা হিসেবে ভিক্ষাকেই বেছে নিতে বাধ্য হলেন। সেই থেকেই অন্ধ ভিক্ষুক ইয়াকুব আলী নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করলেন।
ইয়াকুব আলীর বয়স এখন কত তা তিনি নিজেও জানেন না। অন্ধ মানুষের দিনরাত সবই সমান। তাই তিনি নিজের বয়সের হিসাব রাখার কথা একবার চিন্তাও করেননি। তবে ধারনা করা যায় তার বয়স প্রায় ষাট এর কাছাকাছি হবে।
গত বিশ বছর ধরে ইয়াকুব আলী এই রেল স্টেশনে বসে ভিক্ষা করেন। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা অন্ধ ইয়াকুব আলীকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। তারা নিজেদের সাধ্যমতো তাকে সাহায্য সহযোগিতাও করেন। ইয়াকুব আলীর কাছেও স্টেশনের আশপাশের সব জায়গাই পরিচিত। কোথায় টিউবওয়েল, কোথায় বাথরুম, কোথায় কদম আলীর হোটেল, কোথায় বারিক মিয়ার চা দোকান, কতদূর গেলে স্টেশন মাস্টারের ঘর, কত কদম হাটলে প্লাটফর্মের শেষ মাথায় পৌঁছা যায় তার সবই তিনি জানেন। কোনো সমস্যা ছাড়াই তিনি স্টেশনের সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারেন।
ইয়াকুব আলী যদিও অন্ধ মানুষ তবু তার শ্রবণ শক্তি খুবই প্রকট। তিনি বুদ্ধিমানও। রাত কখন গভীর হলো আবার কখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো তা তিনি চারপাশের বিভিন্ন শব্দ থেকেই অনুমান করে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ইয়াকুব আলীর দীর্ঘ জীবনে একবারও কোনো ভুল হয়নি। রাত ঘনালে তিনি প্লাটফর্মের শেষ মাথায় নির্জন একটা জায়গায় শুয়ে পড়েন। আবার ভোর হলেই কখনো স্টেশন মাস্টারের রুমের পাশে আবার কখনো ওয়েটিং রুমের দরজার পাশে ছোট্ট একটা থালা নিয়ে বসে পড়েন।
ইদানিং ইয়াকুব আলীর শরীরটা যে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে তা তিনি ভালো ভাবেই অনুভব করতে পারছেন। এখন আর আগের মতো ঘুমও হয়না। খাবারের রুচিও কমে গেছে হঠাৎ করেই। ভয় ভীতি যেন বেড়ে গেছে খুব তীব্রভাবে। তিনি অনুমান করলেন- বয়স তো আর কম হলো না; হয়তো মৃত্যু খুব কাছে চলে এসে এভাবেই তার সংকেত দিচ্ছে।
ইয়াকুব আলীর এমন মৃত্যু ভাবনার একটা কারণও অবশ্য আছে। গত তিন দিন যাবত তিনি শুয়ে পড়লেই তার চারপাশে কি একটা যেন ঘুরে বেড়ায়। শেয়াল, বেড়াল, কুকুর ধরনের প্রাণীগুলোও ইয়াকুব আলীর কাছে অপরিচিত নয়। পায়ের শব্দ শুনেই তিনি এদের পরিচয় বলে দিতে পারেন। কিন্তু যে জিনিসটা তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা তিনি কিছুতেই সনাক্ত করতে পারেছেন না। তার দীর্ঘ অন্ধ জীবনে তিনি শব্দ আর গন্ধের মাধ্যম্যে আশপাশের সবকিছুকে নিজের কাছে পরিচিত করে নিয়েছেন। অথচ যে জিনিসটা তাকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরে বেড়ায় সেটা তার কাছে অদ্ভুত আর অজানা কিছুই মনে হলো। তাই তার অবচেতন মন এটাকে মৃত্যুর আগমনী সংকেত বলেই সনাক্ত করলো।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত এ স্টেশনে কোনো ট্রেন থামে না। তাই স্টেশনটা সেদিন সন্ধ্যার পরপরই একদম নিরব হয়ে যায়। শুধুমাত্র স্টেশনে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী, ঠিকানাহীন কয়েকজন মানুষ, কয়েকটা কুকুর আর দুই তিনটা বিড়াল ছাড়া আর কেউই এখানে থাকেনা। শেয়ালেরা ভ্রম্যামানদের মতো হঠাৎ করে এসে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারপর চলে যায়। এ রাতে ইয়াকুব আলী অন্য রাতের তুলনায় কিছুটা আগেই তার স্থানে চলে যান এবং ঘুমিয়ে পড়েন।
সেদিনও তিনি চটের বস্তাটা প্লাটফর্মে বিছিয়ে রেখে তাতে উঠে বসলেন। এমন সময় সেই জিনিসটা এসে উপস্থিত হলো। তিনি প্রাণীটার অস্তিত্ব অনুভব করলেন। ক্ষণকাল পরেই তিনি তার গায়ে হীম শীতল কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলেন। ইয়াকুব আলী ভয় পেয়ে চমকে উঠলেন। কিন্তু এমন সময় খুব কাছেই মিষ্টি কন্ঠে কথা বলে উঠলো কেউ। কন্ঠটা ইয়াকুব আলীর কাছে আট দশ বছরের একটা মেয়ের কন্ঠের মতোই মনে হলো।
মেয়ে কন্ঠটা অভয়ের সাথে বলেতে লাগলো- আমি ইমারা। দূরের একটা গ্রহ থেকে এসেছি। শুধুমাত্র অন্ধত্বের কারণেই আপনি জীবনভর কষ্ট ভোগ করেছেন বুঝতে পেরে আমারও খুব কষ্ট লাগলো। আপনার অসহায়ত্ব আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আপনার চোখ ভালো করে দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ে চতুর্থবারের মতো এ পৃথিবীতে এসেছি।
এতটুকু শুনেই ইয়াকুব আলী ভাবলেন কোনো ছোট্ট মেয়ে হয়তো তার সাথে মজা করছে। আবার পরক্ষণে ভাবলেন রাতের বেলা এই নির্জন প্লাটফর্মে এসে ছোট্ট একটা মেয়ের মজা করার কোনো প্রশ্নই আসেনা। ইমারার অস্তিত্ব তার কাছে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হতে লাগলো। তিনি তার সাথে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু ইমারা একটা ভেজা কাপড় দিয়ে ইয়াকুব আলীর মাথাটা ঢেকে দিল। ইয়াকুব আলী জ্ঞান হারানোর আগে শুধু এটুকুই অনুভব করতে পারলেন- শীতল কিছু একটা তার দু’চোখের ওপর চেপে ধরেছে কেউ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই ইয়াকুব আলী নিজের মধ্যে বিশাল একটা পরিবর্তন অনুভব করতে পারলেন। মুহূর্তেই আনন্দে আত্নহারা হয়ে পড়লেন। তার পৃথিবী এখন আলোকিত! তিনি এখন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পারছেন। চারপাশের জগৎটা যে এত সুন্দর তা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি।
ইয়াকুব আলীর উৎফুল্ল মন কিছুটা শান্ত হলে তিনি নিজের শরীরের দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টি দিলেন। নিজের চোখে নিজের শরীরের যতটা দেখা যায় তিনি খুব ধীর স্থিরভাবে অনেক্ষণ সময় নিয়ে তার সবটাই দেখলেন। তারপরই এক লাফে দাঁড়িয়ে গেলেন। পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন সারা স্টেশন।
অন্ধ ইয়াকুব আলীকে এমন স্বচ্ছন্দে দৌড়াতে দেখে পরিচিতজনরা অবাক হয়ে গেলেন। অন্ধ একজন মানুষ কিভাবে এমন করে কোথাও কোনো ব্যঘাত না ঘটিয়ে দৌড়াতে পারেন- কেউ তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না!
স্টেশন মাস্টার জুলফিকার সাহেব এসে ইয়াকুব আলীকে থামালেন। কন্ঠ শুনেই ইয়াকুব আলী স্টেশন মাস্টারকে চিনে ফেললেন। এ লোকটা তাকে খুবই স্নেহ করেন। প্রতি রাতে তিনি ইয়াকুব আলীকে ভাত খাওয়ান। এবার ইয়াকুব আলী এই মহৎ লোকটাকে দেখতে পারছেন। তার চোখের আনন্দ অশ্রু শুভ্র দাড়ি ভিজিয়ে দিতে লাগলো।
সবাই জেনে গেল অদ্ভুত ভাবে হঠাৎ করেই ইয়াকুব আলীর চোখ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে কি হলো জানতে চাইলে- কি জানি কি এক কারণে ইয়াকুব আলী ইমারার কথা কাউকে বললেন না। তিনি শুধু বললেন- সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখেন তার চোখ ভালো হয়ে গেছে।
স্টেশন মাস্টার জুলফিকার সাহেবের দৃষ্টিতে একটা ব্যতিক্রম ধরা পড়লো যা আর কেউ খেয়াল করেনি। তিনি দেখলেন ইয়াকুব আলীর চোখ দুটো মানুষের চোখের মতো নয়। তবে তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না চোখ দুটোর সাথে পৃথিবীতে বসবাসরত কোন প্রাণীর চোখের মিল রয়েছে। একেকবার একেক প্রাণীর চোখের মতো মনে হয় ইয়াকুব আলীর চোখগুলো।
পরদিন রাতে ইয়াকুব আলী যখন এ স্টেশনের প্লাটফর্মের শেষ মাথায় তার বিশ বছরের মায়া জড়ানো জায়গায় শুয়ে শুয়ে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করছিলেন তখন ইমারা এসে উপস্থিত হলো তার পাশে। ইয়াকুব আলী ইমারাকে যদিও এর আগে দেখার সুযোগ পাননি তবুও ইমারার পায়ের শব্দেই তিনি তাকে চিনে ফেললেন। তিনি দেখলেন ইমারা ছোট্ট একটা মেয়ে। তবে মানব শিশুর শরীরের সাথে অনেক তারতম্য তার শরীরের।
ইয়াকুব আলী ইমারার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। পরক্ষণে তিনি আবিষ্কার করলেন ইমারার যেখানে চোখ থাকার কথা সেখানে সেগুলো নেই। বুদ্ধিমান ইয়াকুব আলী দ্রুত বুঝে গেলেন বিষয়টি। তিনি এগিয়ে গিয়ে ইমারাকে বুকে টেনে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
ইমারাকে বিদায় দেওয়ার আগে তিনি শুধু এ কথাই বলতে পারলেন- আমি তো জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি এই অন্ধ দুটো চোখ নিয়েই। বাকি জীবনটাও এভাবেই চলতে পারতাম। কিন্তু তুমি কেন তোমার জীবনটাকে এমন করে দিলে।
ইমারা চলে যাওয়ার পর ইয়াকুব আলীর চিন্তা চেতনা স্তবির হয়ে পড়লো। ইমারার ত্যাগ তাকে আবেগ আপ্লুত করে তুলল। হাজার হাজার মানুষ অন্ধ ইয়াকুব আলীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে। হাজার হাজার মানুষ অন্ধ ইয়াকুব আলীকে দেখে শুধু আফসোস করেছে। কিন্তু মানুষ হয়েও কেউই অন্ধ ইয়াকুব আলীর জন্য কিছুই করেনি। অথচ ভিন গ্রহের ইমারা নামের ছোট্ট একটা মেয়ে কি অসাধারণ ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ইয়াকুব আলীকে চির ঋণী করে দিল।
ইয়াকুব আলী জানেন ইমারা আর কোনোদিন আসবে না। তবুও তিনি প্রতিরাতে সেই রেল স্টেশনের প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে শুয়ে শুয়ে ইমারার জন্য প্রতীক্ষা করেন।
***
রচনাকাল : ১১/৯/২০২০
© কিশলয় এবং মোঃ তোফায়েল হোসেন কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।