ভাদুর গান ও গল্পকাহিনী (তৃতীয় পর্ব)
আনুমানিক পঠন সময় : ৩ মিনিট

লেখক : লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
দেশ : India , শহর : New Delhi

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , সেপ্টেম্বর
প্রকাশিত ৯৩৫ টি লেখনী ৭২ টি দেশ ব্যাপী ২৬৭৪৪৭ জন পড়েছেন।
বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ বাড়িতেই ভাদ্র মাস এলেই একটা উৎসব শুরু হয়ে যায়। মহিলা’রা ছোট ছোট দল বেঁধে ভাদু’র মূর্তি নিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি করে বেরাবে। সে মূর্তি’র হাতে থাকবে ধানের শীষ, মিষ্টি, পান, সঙ্গে থাকবে নাচ, গান, আনন্দ আর তলে তলে ভাদু চলে যাওয়ার বেদনাও। চলে যাওয়ার বলছি, কারণ ভাদুকে নিয়ে যত গল্প আপনি শুনবেন, প্রত্যেকটির শেষ হচ্ছে ভদ্রেশ্বরী বা ভদ্রাবতী’র আত্মহনন দিয়ে। মানে যত ক্ষণ রয়েছে, প্রাণোচ্ছ্বল, আর যাওয়ার বেলা, করুণ সুর।

গল্পে আছে, পুরুলিয়া’র কাশিপুর অঞ্চলের রাজা নীলমণি সিংহ খোঁজ পেয়েছিলেন এই ‘সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকুর’-এর। ছোট্ট ভদ্রেশ্বরীতে এমনই মজে গেলেন নীলমণি, যে তাকে মনে মনে রাজকন্যা ভেবে ফেললেন। কিন্তু তার পালক পিতা তো ভদ্রেশ্বরীকে কিছুতেই কাছছাড়া করবেন না, অতএব সে থেকে গেল, ওই গ্রামেই। বড় হয়ে সে প্রেমে পড়ল পাশের গ্রামের অঞ্জনের। নীলমণি মানস-কন্যাকে আরও ভাল হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তাই অঞ্জনকে কারাগারে আটক করে রাখলেন। দুঃখিনি ভদ্রেশ্বরী এ বার, দুই সখাকে নিয়ে সারা রাজ্য ঘুরতে লাগল। চোখ খুঁজে চলেছে অঞ্জনকে আর মুখে গান। যদি অঞ্জন এক বার শুনে চিনে ফেলে...যত দিনে অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন নীলমণি, তত দিনে ভদ্রেশ্বরী আর নেই, ভাদু হয়ে গিয়েছে, আর তার ওই গান, ভাদু গান।

ওই সব অঞ্চলের রুখা মাটিতে এই ভাদ্র মাসেই আউশ ধান পাকে আর সেই আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে ভাদু পুজো। ধান চাষ করে ঘরে তোলার কাজটা মূলত পুরুষ’রা করলেও, ভাদু কিন্তু নারী-উৎসব। সারা বছরের হাড় ভাঙা খাটুনির পর এই সময়টাই তো খানিক মুখ তোলার অবসর। আর মুখ তুলে ও দেশের মেয়েরা যা বলেন, তার থোক মানে হল, আজ তাঁদের কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না, এমনকী মরদ’রাও না। আজ শুধুই ‘র্যান্ডম ফুর্তি’। ভাদু গানে বলে ‘ভাদু পুজার দিনে, সারা রাত উড়াব ফুর্তি হে, কাটাব জাগরণে, বাকি আজ রাইখনা কিছু, যা ইচ্ছা মনে, রাখ লোক-লজ্জা, দাও দরজা, মহাপুজা এইখানে...’


যেটা বেশি করে চোখে পড়ছে, তা হল নারী’র মুখের, শরীরেরও, স্বাধীন ভাষা, ভঙ্গি। খেয়াল করলে হয়তো দেখবেন, এই অবস্থা, বছরের অন্য কোনও সময়ে পাওয়া যায় না। এই সময়ে, মহিলা’রা দল বেঁধে উঠোনে জমিয়ে গান বাঁধেন। গান শুরু হয় এক জনের মুখ থেকে, তার পর চক্কর খেতে খেতে যায় অন্যের কাছে, এমনটা চলতে থাকে, যত ক্ষণ না একটা গোটা গান তৈরি হয়ে যাচ্ছে। গান বানাচ্ছেন মেয়েরাই, কিন্তু এখন ও সব অঞ্চলে গেলে দেখবেন, অনেক চটি বই পাওয়া যায় (অনেকটা কিশোর-রফি’র লিরিক বইয়ের মতো), যেখানে ভাদু গানের কথা লিখে ছাপাচ্ছেন কিছু পুরুষও, অবশ্যই নারীর স্বরে। ঠিক যেমন বিচ্ছেদী গানে রাধা’র ব্যথার কথা লেখেন পুরুষ’রা। এই সব গানে যেমন ঝুমুর গানের প্রভাব খুব থাকে, তেমনই দেখা যায় যে রামপ্রসাদী সুরেরও অসম্ভব ঝোঁক। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কিন্তু এটা, কারণ রামপ্রসাদী গানের ধুয়ো ধরে লোক সঙ্গীতে বিশেষ চর্চা হয় না।
পৌরাণিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়কেই ভাদু গানে তুলে ধরা হয়। মূলত পাঁচালির সুরেই চার লাইনের ভাদুগান গাওয়া হয়। সারারাত জেগে গান গাওয়ার পর শেষ রাতে সকলে মিলে ভাদুকে বিসর্জন দিতে যান। সেই সঙ্গে করুণ সুরে সকলে গেয়ে ওঠেন...

'ভাদু যায়ো না জলে
কোলের ভাদু যায়ো না মোদের ছেড়ে
গটা ভাদর থাকলে ভাদু গো
মা বলে ত ডাকলে না
যাবার সময় রগড় লিলে
মা বিনে ত যাব না'।




রচনাকাল : ৮/৯/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 2  China : 9  Europe : 1  France : 6  Germany : 2  India : 113  Ireland : 26  Romania : 1  Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 1  
Sweden : 12  Ukraine : 6  United States : 126  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 2  China : 9  Europe : 1  France : 6  
Germany : 2  India : 113  Ireland : 26  Romania : 1  
Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 1  Sweden : 12  Ukraine : 6  
United States : 126  
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভাদুর গান ও গল্পকাহিনী (তৃতীয় পর্ব) by Lakshman Bhandary is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৩৯৩০৯
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী