রসময়বাবু তাঁর গ্ৰামের একজন খুব গন্যমান্য ব্যক্তি। কিন্তু তিনি ছিলেন মহাকিপ্টে। এই স্বভাবের জন্য তাঁকে কেউ পছন্দ না করলেও, সব বিষয়ে অগাধ জ্ঞানের জন্য
সবাই তাঁকে সম্মান করতো। গ্ৰামের যেকোনো অনুষ্ঠানেই ওনার নিমন্ত্রন থাকতো।
রসময়বাবু বিয়ে-থা করেননি। বয়স পঞ্চান্ন বছর। চেহারাটা বেশ নাদুস-নুদুস। তিনি মিষ্টি খেতে খুবই ভালোবাসেন। তাই বলে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে কখনো খান না। কোনো নিমন্ত্রন বাড়িতে গেলে তখনই খান। একবার কোনো একটা বিয়েবাড়িতে গিয়ে প্রথমবার রসগোল্লা খেয়ে তাঁর ভীষণ ভালো লেগেছিল। তারপর থেকে তিনি যখনই কোনো নিমন্ত্রন বাড়িতে যেতেন, কম করে দু-তিন বালতি রসগোল্লা একাই সাবড়ে দিতেন। এই কারণে পাড়ার লোকেরা আড়ালে ওনাকে "রসগোল্লা" বাবু বলে ডাকতো।
শোনা যায়, রসময়বাবুর এইরূপে রসগোল্লা খাওয়ার কারণে এক বিয়েবাড়িতে কনের বাবাকে ভীষণ অপমানিত হতে হয়েছিল বরযাত্রীদের কাছে।
****************************
গ্ৰামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের বিয়েতে যথারীতি রসময়বাবু নিমন্ত্রন পেলেন। নিমন্ত্রনের দিন দরকারী একটা কাজ পরে যাওয়ায় রসময়বাবুর বিয়েবাড়ি পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল।
বিয়েবাড়িতে রসময়বাবুর আদর-আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি হলো না। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে, তাই পরের ব্যাচেই উনি খেতে বসে পরলেন।
সময়মতো কনের ভাই বিমল এসে খাবার পরিবেশনকারীকে রসময়বাবুর ব্যাপারে বলে এক বালতি রসগোল্লা দিয়ে গেল। পরিবেশনকারী রসময়বাবুর সামনে রসগোল্লার বালতিটা বসিয়ে দিয়ে গেল।
এক বালতি রসগোল্লার প্রায় অর্ধেক মত বাকী..হঠাৎ রসময়বাবুর পেটটা কেমন যেন কামড়ে উঠলো। প্রথমে সেটা অগ্ৰাহ্য করে আরো খান দশেক রসগোল্লা পেটে চালান করে দিলেন। ব্যাস আর যাবেন কোথায়! পেটের মধ্যে অস্বস্তি যেন আরো বেড়ে গেল। পেটের ভিতরটা মোচড় দিতে লাগলো। আর থাকতে না পেরে তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে কোনোরকমে ধুতির কাছা দিয়ে হাত মুখ মুছে বাথরুমের দিকে দৌড়লেন। বাথরুমে লম্বা লাইন পরেছে দেখে তিনি বিয়েবাড়ি থেকে সোজা গ্ৰামের ভিতরের রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের দিকে দৌড় লাগালেন। জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে ঢুকে সেখানেই একটু পরিষ্কার জায়গা দেখে বসে পরলেন।
****************************
রসময়বাবু বসে নিশ্চিন্ত মনে পেট খোলসা করছিলেন। আচমকা তাঁর মাথার পিছনে কি জানি একটা ঠকাস করে এসে লাগলো।
- বাপরে..জ্বলে গেলো রে!
রসময়বাবু পিছন ঘুরে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন এমন অবস্থা যে তিনি উঠতেও পারছেন না। অগত্যা মাথার পিছনটা হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে আবার পেট খোলসা করার কাজে মন দিলেন।
মিনিট দু'য়েক পর আবার মাথার পিছনে ঠকাস করে লাগলো।
মাথার পিছনটা হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে চেঁচিয়ে উঠলেন- অ্যাই কোন হতচ্ছাড়া রে?
- কিঁ রেঁ রঁসগোল্লা..তুঁই শাঁলা আঁমার থাঁকার জাঁয়গায় এঁসে পেঁট খোঁলসা কঁরছিস, আঁবার আঁমাকেই ধঁমকাচ্ছিস! বাঁপরে কিঁ গঁন্ধ..কিঁ গঁন্ধ!
খনা গলায় গাছের উপর থেকে আওয়াজ আসলো।
রসময়বাবু ভূতকে খুব ভয় পেতেন। আচমকা রাত-বিরেতে খনা গলার আওয়াজ শুনে পেট খোলসা করা মাথায় উঠে গেল। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বললেন- হে ভূতঠাকুর খুব ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিন। আসলে বিয়েবাড়িতে একগাদা রসগোল্লা খাওয়ার পরই পেটটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। চাপতে না পেরে..
- চুঁপ কঁর হঁতচ্ছাড়া! তাঁই বঁলে আঁমার থাঁকার জাঁয়গায় এঁসে নোঁংরা কঁরবি!
ফররর্..থপ্!
- ইঁসস্ ম্যাঁগো, আঁবার ধুঁতি নোঁংরা কঁরে ফেঁললি! নেঁহাত আঁজ তোঁর শঁরীরটা ভাঁলো নাঁ..তাঁই ছেঁড়ে দিঁচ্ছি। আঁর কোঁনোদিন কোঁনো অঁনুষ্ঠান বাঁড়িতে গিঁয়ে তুঁই যঁদি গাঁন্ডেপিন্ডে রঁসগোল্লা গিঁলেছিস, সেঁদিন আঁমি তোঁর পিঁছন দিঁয়ে রঁসগোল্লার ফোঁয়ারা ছুঁটিয়ে দেঁবো বঁলে দিঁলুম। যাঁ ভাঁগ এঁখান থেঁকে।
রসময়বাবু সেখান থেকে এক নিঃশ্বাসে দৌড় লাগিয়ে একেবারে বাড়ির সামনে এসে থামলেন।
এই ঘটনার পর প্রায় একমাস মত অসুস্থ ছিলেন রসময়বাবু। তারপর থেকে ভয় তিনি রসগোল্লা খাওয়াই ছেড়ে দিলেন। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, সুগারের ভয় তিনি আর রসগোল্লা খাচ্ছেন না।
****************************
সেই রাতের ঘটনার কথা রসময়বাবু আর কাউকে বলেননি। কিন্তু তিনি এটা জানতেন না যে এই ঘটনার কথা তিনি ছাড়াও আরো দু'জন জানতো- বিমল আর নন্টে।
আসল ঘটনা হলো সেদিন রসময়বাবুকে কোনো ভূতে ভয় দেখায়নি। ভয় দেখিয়েছিলো বিমল আর নন্টে মিলে।
নন্টের দিদির বিয়েতে রসময়বাবু একাই প্রায় দুই বালতি রসগোল্লা সাবাড় করে দিয়েছিলেন। একেই অভাবের সংসার, তার উপর মেয়ের বিয়েতে অনেক খরচা হয়ে যাওয়াতে নন্টের বাবার পক্ষে সেদিন আর রসগোল্লার অ্যারেঞ্জমেন্ট করা সম্ভব হয়নি। সেই কারণে বরযাত্রীর লোকজন খুব করে কথা শুনিয়েছিল তাদের। রসময়বাবুর জন্যে তার বাবাকে বরযাত্রীদের কাছে অপমানিত হতে দেখে নন্টে সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে রসময়বাবুকে একদিন উচিত শিক্ষা দেবে।
সেই সুযোগ এসে গেল তার প্রানের বন্ধু বিমলের দিদির বিয়েতে। দু'জনে মিলে আগে থেকে প্ল্যান করে এক বালতি রসগোল্লায় অনেকটা জোলাপ মিশিয়ে রেখেছিল। রসময়বাবুর খাওয়ার সময় সেই বালতিটাই পরিবেশনকারীর কাছে দিয়ে এসেছিল বিমল। তারপর রসময়বাবু যখন পেট মোচড়ানোয় থাকতে না পেরে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিলেন, দুই বন্ধুও তাঁর পিছু পিছু গেছিলো। বিমলের হাতে ছিল গুলতি আর ছোট ছোট পাথরের টুকরো। তারপর সুযোগ বুঝে বিমল গাছের আড়াল থেকে গুলতি ছুঁড়ে আর নন্টে গাছের উপর থেকে ভূতের গলা নকল করে ভয় দেখাচ্ছিল।
****************************
সেদিনকের ঘটনার পর থেকে রসময়বাবু রসগোল্লা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন জানতে পেরে নন্টে খুবই আনন্দ পেল।
- তুই সেদিন আমাকে সাহায্য না করলে "রসগোল্লা"-কে জব্দ করা যেত না রে বিমল। বুকে আয় ভাই।
****************************
(সমাপ্ত)
রচনাকাল : ৪/৯/২০২০
© কিশলয় এবং শুভেন্দু ভৌমিক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।